বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানুষ কত রকম আত্মত্যাগ স্বীকার করলেন। কত মানুষ প্রাণ দিলেন। কত নারী নির্যাতিত হলেন। কত মানুষ মরণের ভয়কে জয় করে, অস্ত্রহাতে যুদ্ধে অংশ নিলেন। সকলের স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশে তারা সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে বসবাস করবেন। ন্যায়বিচার পাবেন। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে খুব স্বল্প সময়ের ভিতরে দেশটি দখল করে নিয়েছিলো লুটেরারা। সরকারের ভিতর বহু মানুষ খুব আন্তরিকভাবে সেই লুটেরাদের বাধা দিতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তারা ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ হলেন কেন? কাউকে এর জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে দায়ী না করেও বলা যায়, সরকারি নীতির মধ্যে নানা ভ্রান্তি ছিল। সরকারের ভিতর যেমন ছিলেন বহু ত্যাগী মানুষ, ঠিক একইভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল বহু লুটেরা। মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি অংশ নেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের প্রাপ্য সনদপত্রের একটা অংশ চলে গেল কিছু অসৎ মানুষের কাছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীরা, লুটেরারা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে ফেললো স্বাধীন দেশে। ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের টিকে থাকার জন্য, স্বভাবতই নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা প্রতিহত করা গেল না কেন? নিশ্চয় সরকারের, সেই একই সঙ্গে বিরোধী দলগুলির তৎকালীন রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলি ভুল ছিল, না হলে মুক্তিযুদ্ধের সুফল কেন লুটেরাদের হাতে চলে যাবে? স্বাধীন দেশে খুব দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নানা দলে, গোত্রে বিভক্ত হয়ে গেল। বিভক্তিটা যুদ্ধকালীন সময়ও ছিল, তা অনেকটা প্রকট হয়ে উঠলো যুদ্ধশেষে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে। মতাদর্শগত বিরোধ যেটা ছিল, সেটা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বার্থের দ্বন্দ্বটাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে যে বিরোধ, প্রতিপক্ষের জন্য ষড়যন্ত্র করবার, নিজেদের অবস্থান শক্ত করবার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কী হতে পারে ! কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবীরা কি এসময়ে বিভেদ কমাবার জন্য গঠনমূলক কোনো পরামর্শ দিতে পেরেছিলেন? না পারেননি। কারণ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশটাই এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। নিজেরা তারা কোনো ঝুঁকির মধ্যে যাননি। যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রাণ দেয়ার চেয়ে, নিজেদের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নির্বিগ্নে সময় কাটাতে চেষ্টা করেছেন। সরাসরি যুদ্ধ করেছেন দেশের নিম্নবর্গের মানুষরা, যারা বুদ্ধিজীবী নন, সমাজে সম্মানিত নন। যারা দিনে আনেন দিনে খান আর কায়িক শ্রম দিয়ে জীবন যাপন করেন।
সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন যারা তাদের পঁচাশি শতাংশ ছিলেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। বাকি পনেরো শতাংশ শিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী, তরুণ যুবসমাজ। ফলে এ কথা ভাবার কারণ নেই যে, দেশের শিক্ষিত সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই যুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও, এদের কিছু সংখ্যক আলাদাভাবে মুক্তিযুদ্ধে নানারকম ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার যে কৃষক, দিনমজুররা যুদ্ধে অংশ নেননি, তারা আর একভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। যদি তারা যুদ্ধের ভিতরে নানা আতঙ্কিত অবস্থায় থেকেও চাষাবাদ না করতেন, তাহলে দুর্ভিক্ষে এবং না খেয়ে দেশের অনেক মানুষ মারা পড়তেন। স্বাধীনতার পরের বছর দেশের ভিতর যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি, তার কারণ হলো এই তথাকথিত ছোটলোক চাষাদের কার্যক্রম। নানারকম লুটপাটের পরেও এই দেশটাকে যারা সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রাখেন নিজেদের রক্তঘাম দিয়ে তারা হলেন এই চাষারা, দিনমজুররা, যাদেরকে আমরা ছোটলোক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। ক’দিন আগে এই চাষাবাদকারীদের দুর্বিসহ জীবনের চিত্র পত্রপত্রিকায় দেখা গেল। নিজেদের শ্রমের মূল্য তারা পাচ্ছেন না, ফসলের ন্যায্য দাম দূরের কথা, উৎপাদনের খরচাও পাচ্ছেন না। বহুজনই তাদের নিয়ে এবার অনেক কথা বলেছেন, তাদের প্রতি সহানুভুতি দেখিয়েছেন। বহুজন প্রতিবাদ করেছেন তারা তাদের শ্রমের কিংবা ফসল উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না বলে। বহু মানুষের আত্মত্যাগের পর দেশের স্বাধীনতা যেমন চলে যায় লুটেরাদের হাতে; ঠিক একইভাবে কৃষকদের শ্রমে উৎপাদিত ফসলের পুরো সুফল ভোগ করে লুটেরারা। বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি এবং অর্থনীতির এই চেহারাটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করলে, এই রাষ্ট্রের সঙ্কটের আসল কারণটা চিহ্নিত করা যাবে। রাজনীতিকে, দেশের সঙ্কটকে অর্থনীতির চোখ দিয়ে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। রাষ্ট্রটির সঙ্কটের আসল কারণ বুঝতে হলে তাই “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ”এইসব সস্তা বুলি বাদ দিয়ে প্রকৃত সত্যের সামনে দাঁড়াতে হবে। তার মানে এ নয় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু ছিল না, তার মানে এ নয় যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ছিল না। সবই ছিল আর তার সবই এখন ঘোলাটে হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের বিপরীত পক্ষরাই এখন বেশি বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করছেন। মুক্তিযুদ্ধের নামে এই ফেরি করা চেতনা আসলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা নয়। বহু দেশপ্রেমিক মানুষরাও না বুঝে এই চেতনা ফেরি করছেন। প্রতিপক্ষেরই লাভ হচ্ছে তাতে। কারণ প্রকৃত দেশপ্রেমিকরাই এই চেতনার নামে নিজেরা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন, দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র বহু ভুয়া লোকরা পেয়েছে, আর শঠতার মধ্য দিয়ে সনদপত্র লাভ করে তারা বড় বড় বুলি দিচ্ছে, তাদের কাছে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” কথাটি নিরাপদ হয় কী করে? কখনোই কি তারা প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করবে তা বিশ্বাস করা যায়? মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র যারা লুট করেছে, তারা দেশও লুট করবে। দেশের সম্পদ লুটপাট করার জন্যই তারা মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র লুট করেছে, আর তাদের লুটপাটের দায় নিতে হচ্ছে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে, সমগ্র দেশবাসীকে। সনদপত্র দখল করা এই অপশক্তি কি কখনো, প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রচার করতে পারে, স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে পারে?
যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, ভুখণ্ডের প্রায় সব মানুষই এই যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। সরাসরি সবাই যুদ্ধে অংশ নেননি কিন্তু প্রায় সকলে মনে প্রাণে পাকিস্তানের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করতে চেয়েছেন। সমগ্র দেশের বিবেচনায় সামান্য কিছু মানুষ যারা স্বাধীনতা চাননি, তাদের বাদ দিলেও, একথা মনে রাখতে হবে, দেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, যখন যুদ্ধ চলছিল পাকবাহিনীর নির্মমতার হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য, ঠিক একই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা লুটেরারা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশ নিয়েছিল, কারণ এই যুদ্ধ থেকে তারা ব্যক্তিগত ফায়দা নিতে চেয়েছিল। স্বাধীন দেশে লুটপাট করে তারা বড়লোক হতে চেয়েছিল। কারণ পাকিস্তানে বসে তাদের পক্ষে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। যখন দেশ স্বাধীন হল, এই মানুষগুলোর কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে সত্যিই কিছু ছিল না। যে চেতনার কথা তারা বলতো, তা ছিল এক ধরনের রূপকথা, মিথ্যাচার। এই মানুষগুলির মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, লুটপাট চালানো। মুখে এদের দেশপ্রেমের বড় বড় বুলি ছিল, কিন্তু আসলে এরা ছিল মুখোসধারী। সরকারি দলের ভিতরে এরা যেমন ছিল, বিভিন্ন দলেই এরা ছিল। বামরাজনীতির সঙ্গেও এদের অনেকে যুক্ত ছিল। যারা জনগণের চেয়ে নিজের ভাগ্য পাল্টাতে বেশি ব্যস্ত ছিল। ফলে এরা স্বাধীনতার পর প্রয়োজনে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে কাছে টেনেছিল। যদি বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাগুলি, যেমন ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, গণকণ্ঠ ইত্যাদিতে যে কেউ চোখ বুলান এ কথার সত্যতা মিলবে। শাসক দলের কতো লোক যে স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে লাফালাফি করেছে, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করেছে, তার প্রচুর খবর আছে ঐসব পত্রিকাগুলিতে। বিশেষ করে সরকারি দলের এই যে মানুষগুলির কথা বলা হচ্ছে, এদেরই কর্মকাণ্ড দেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিলো। এই গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। স্মরণ রাখতে হবে, তখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জন্ম নেয়নি। পঁচাত্তরের আগেই স্বাধীনতা বিরোধীদের যে লালন করা হয়েছে, তার জন্য বর্তমান রচয়িতার এই বার্তাটিকে বিশ্বাস না করে, উল্লেখিত পত্রিকাগুলি পড়ে দেখাটাই উচিৎ হবে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় দেখা যাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান তখন কীভাবে হচ্ছিলো। কথাটা হলো এই যে, এর জন্য আওয়ামী লীগ বা সরকারি দলকে দায়ী করলে, কথাটা একপেশে বা অর্ধসত্য হয়ে দাঁড়াবে। লুটপাটকারীরা সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয় বা দলের মধ্যে ওৎ পেতে বসে থাকে। কথাটা যেমন আজকের জন্য সত্য, সেদিনের জন্যও তা সত্যি ছিল। ফলে আওয়ামী লীগ নামের পুরো দলটির কর্মীদের ত্যাগ তিতিক্ষাকে বাদ দিয়ে, মাত্র কিছু লোকের অপরাধের জন্য দলটিকে দায়ী করা, বা দলের সাধারণ কর্মীদের দেশপ্রেমকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পরপরই নানান অন্তর্বিরোধে দলটি প্রধানত দুটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আন্তরিকভাবে বুঝতে গেলে, এইসব ঘটনাগুলিকে আগে বুঝতে হবে, এই সব ঘটনার কারণগুলিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত রাজনীতিকে স্পষ্ট এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে, “স্বাধীনতা পক্ষ-বিপক্ষ”, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” এই সব কথাগুলির সঠিক অর্থ বা এইসব নিয়ে বিভ্রান্তিগুলিকে আবিষ্কার করা যাবে না। আর আওয়ামী লীগে বা বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দলে কী করে বাইরের শক্তি প্রভাব বিস্তার করে, প্রকৃত ত্যাগী কর্মীদের হটিয়ে দিয়েছে সে সত্যিটাও বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না। মনসার সাপ কী করে লক্ষীন্দরের বাসর ঘরে ছোট ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ে, আর কীভাবে সেই ছিদ্রটি তৈরি হয়, এটা না বুঝলে নিজেরই ক্ষতি। যদি সেটা না বুঝতে চেষ্টা করি, তাহলে বন্ধুকে শত্রু বানিয়ে, আপনপক্ষকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিজেরা বিভক্ত হবো, শক্তি ক্ষয় করবো আর সেই সুযোগে কালসাপ প্রভাব বিস্তার করবে। ফলে পুরো ইতিহাসটা আবার সকলের ফিরে দেখা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলি বুঝতে হলে মুক্তিযুদ্ধের মূল জায়গাটায় বারবার ফিরে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে যুদ্ধের মাঠে যেখানে সংগঠিত হচ্ছিল যুদ্ধটা। বাংলাদেশের সেই সব শিক্ষিতরা, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বয়স বিশ বা তার উর্ধ্বে ছিলো তারা কি সবাই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন? দেননি সেটা পরসিংখ্যানে প্রমাণিত। না দিতেই পারেন। কিন্তু নিজে যুদ্ধে যোগ না দিয়ে যখন তখন যাকে তাকে, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বলে দিচ্ছেন কোন যুক্তিতে। নিজের তার অবদান কী মুক্তিযুদ্ধে? বিশ বছরের যুবকের নানাভাবে তখন অবদান রাখার সুযোগ ছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মীর অবদান ছিলো, সকলের নয়। বেশিরভাগেরই নয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বা তার আগের রচিত বিপ্লবী গানগুলি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল। প্রশ্ন যদি করা হয়, যারা এখন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান কী? অনেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন, অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন। কৃষকরা দেশের ভিতর থেকে চাষাবাদ করাতে মৃক্তিযুদ্ধের পর দেশ উপকৃত হয়েছে, যুদ্ধের সময়ও দেশ উপকৃত হয়েছে। কিন্তু যারা সরকারি চাকরি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মহাবিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন, যারা অধ্যয়ন করেছেন, তাদের দ্বারা যুদ্ধের কী উপকার হয়েছে? বরং যুদ্ধের ভিতরে ঢাকায় বসবাস করে সরকারি বা আধা সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন। এইসব কথা বলার লক্ষ্য এই নয় যে, কাউকে হেয় করা, বরং একটি মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা তুলে ধরা; যাতে করে আবেগ বাদ দিয়ে সঠিকভাবে যুদ্ধটাকে মূল্য়ায়ন করা যায়। পৃথিবীর সকল ছোট বড় রাজনৈতিক ঘটনা, বিপ্লব, স্বাধীনতা যুদ্ধ মূল্যায়ন করতে হলে, সর্বাগ্রে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থানটা বিচার করা দরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমাজের সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণীর অংশগ্রহণটা খুব খুশি হবার মতো নয়। মুক্তিযুদ্ধ বা তৎকালীন সময়ের কথা বাদ দিলে বর্তমান সময়ে যখন রাষ্ট্রের ভিতরে অন্যায় অত্যাচার হয়, সুবিধাভোগীরা কজন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে নামেন? সুবিধাভোগীদের চেহারা এখনো পাল্টায়নি। বর্তমানে তারা বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দলের হয়ে বিভাজিতভাবে যোগ্যতার অতিরিক্ত বা বহুগুণ সুবিধা নিচ্ছে মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলেন। যুদ্ধে অবদান রাখার জন্য কিছুই দাবি করলেন না। মনে করলেন, যুদ্ধের সুফল সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে ভোগ করবেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সুফল চলে গেল ভদ্রলোক আর বুদ্ধিজীবীদের দখলে, আমলাতন্ত্রের হাতে। যারা যুদ্ধে অংশ নেননি, তারা হলেন এখন রাষ্ট্রের কর্ণধার, আর যুদ্ধ করেছিলেন যারা জাতি তাদেরকে আর চিনতে পারছে না। কারণ সমাজের নীচের অংশ থেকে তারা এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এ সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, সঠিক রাজনীতিটি করতে পারেননি। যদি তারা সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারতেন, তাহলে এমন হবার কথা নয়। কারণ স্বাধীনতার পরের রাজনীতিতে অনেক বেশি আবেগ দেখা গেছে, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়নি। স্পষ্ট প্রমাণ হলো এই যে, তাজউদ্দীন মন্ত্রীসভা থেকে বাদ পড়লেন, আর খুনী মোশতাক ক্ষমতায় রয়ে গেলেন। নিশ্চয় রাজনীতির ভুল এখানে ছিল, শুধু ভুল নয় মারাত্মক ভুল। রাজনীতির এই ভুলগুকে বাদ দিয়ে হঠাৎ মাঝপথ থেকে ইতিহাসকে বিচার বিশ্লেষণ করা যাবে না। তাতে নিজেদের মধ্যে বিভেদ বাড়বে, লাভ হবে ষড়যন্ত্রকারীদের। লুটপাটকারীদের। সত্যিকারের যারা দেশপ্রেমিক, জনগণের বন্ধু তারা যে বিশেষ একটি দলেই থাকবে এমন কথা নেই। আর সর্বত্রই শাসকদল লুটপাটকরিীদের ভীড়ে ঢাকা পড়ে যায়। দলটির প্রকৃত ত্যাগী কর্মীদের তখন আর দেখা যায় না। দলে তারা থাকেন কিন্তু অন্যদের প্রভাবে দৃষ্টির বাইরে চলে যান।
বর্তমান লেখাটি কেন লিখছি? বিশেষ করে প্রায় দিন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবেদনা পাঠ করে, মনে ভিতরে কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। স্মরণ করার চেষ্টা করতে চাইছি, মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবরতী ঘটনা শ্রেণী বিভাজিত মানুষের যে ইতিহাস, সেই প্রকৃত ইতিহাস কি রচিত হয়েছে? খণ্ডিতভাবে বহু কিছু লেখা হলেও, সামগ্রিকভাবে নিরপেক্ষ বা সঠিক ইতিহাসটি লেখা হয়নি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তা হলো সুবিধাভোগীদের লেখা ইতিহাস। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালী সংস্কৃতি, ঈদ উৎসব, পহেলা বৈশাখ সবকিছু দেশীয় সুবিধাভোগী আর বহুজাতিক ব্যবসায়ী লুটেরাদের দখলে। সবকিছুকে তারা বাজারে পরিণত করেছে। ফলে বাঙালীর সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবগুলি বিষয় ক্রমাগত ঘোলাটে হয়ে, জনগণের মধ্যে বিভেদ বাড়াচ্ছে। কারণ জনগণের মধ্যকার এই বিভেদে, বিভিন্ন রকম ঘোলাটে প্রচারণায় মুনাফাখোর, দেশী বিদেশী শক্তির লাভ। দেশের বুদ্ধিজীবী আর সুবিধাভোগীরা রয়েছে তাদের সঙ্গে। কিন্তু এই সুবিধা ভোগীরা সবসময় নিজে দেশের জন্য কতোটা অবদান রেখেছেন, তা প্রচার করতে ব্যস্ত। কিন্তু নিম্নবর্গের যে মানুষগুলি, যারা পঁচাশি শতাংশ সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তারা কখনো নিজেদের অবদান প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন না। যুদ্ধ শেষ করে তারা আবার নিজের নিজের কাজে নিজনিজ পেশায় ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রের লুটপাটে তারা স্বস্তিতে থাকতে পারেননি। নিজেদের আহার বাসস্থান পর্যন্ত তাদের জোটেনি। তারপরেও শ্রমজীবী এই মানুষরা, তথাকথিত চাষারা আজও দেশের জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে চলেছেন, খ্যাতি বা তারকা হবার জন্য নয়। নীরবে এই কাজ করে যাওয়াটাই তাদের জীবনের বৈশিষ্ট। জাতির জন্য তাদের অবদান যে কতো বৃহৎ তা তারা নিজেরা জানেন না, বলেনও না। কিন্তু তবুও তারা নিজেদের উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষের রাজনীতি শুরু হোক এখান থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের কে বিপক্ষে আর কে পক্ষে সেই বিতর্ক বাদ দিয়ে, নিজেরাই নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বানিয়ে অপর পক্ষকে প্রতিপক্ষ না ভেবে, কৃষকের পক্ষে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে কারা আছেন, তা দিয়ে বিচার করা হোক কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। যিনি প্রকৃত দেশ প্রেমিক, যিনি জনগণের প্রকৃত বন্ধু, তিনি কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। যিনি কৃষক-শ্রমিক আর মেহনতী মানুষের পক্ষে, যিনি তাদের মুক্তির পক্ষে তিনিই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। যিনি তা নন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক নন। ফলে কে কাকে ভোট দিল, কে কার নির্বাচনের পক্ষে প্রচার চালালো, বা কোন্ মার্কায় ভোট চাইলো, তা দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিচার না করে, বিভ্রান্তি সৃষ্টির মধ্যে না গিয়ে, সহজ পথ রয়েছে তা বিচার করবার। যারা সাধারণ মানুষের পক্ষে, কৃষক-শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা লাভের পক্ষে, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে, লুটপাটকারীদের জমি দখলের বিরুদ্ধে, ব্যাঙ্কের টাকা আত্মসাত করার বিরুদ্ধে, সবসময়ে বাক স্বাধীনতার পক্ষে; তারাই এই দেশের মানুষের মুক্তির পক্ষে। তারাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা হলো, শ্রেণীহীন সমাজ, শোষণমুক্ত সমাজ, কৃষক শ্রমিকের মুক্তি আর সব ধরনের বাক স্বাধীনতা অর ধর্মনিরপেক্ষতা। যে এইগুলি অর্জন করতে মাঠে থাকবে, সেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, এই যোদ্ধারা চিরকাল থাকবে দেশে দেশে এবং তাদের কোনো সনদপত্র দরকার হবে না।
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক