…নুরুল কাদের খান পাবনা ট্রেজারির যে কয়েক কোটি টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সেই টাকাই ছিল মূলতঃ মুজিব নগর সরকারের আর্থিক সম্বল। আগরতলা অঞ্চলেও খান সংস্থাপন সচিবের কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নূরুল কাদের খান অভাবনীয় প্রতিভার পরিচয় দেন। সেক্টর, সাব-সেক্টর ইত্যাদি বেসামরিক প্রতিষ্ঠান মূখ্যতঃ তারই ধ্যান-ধারণা। ১৭০০ মাইল বর্ডারে এই সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ কিরূপ কঠিন হতে পারে তা হয়ত অনেকের ধারণায় আসবে না।…
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড থেকে কিছু লাইন টুকে নিলাম। নুরুল কাদের খান। একাত্তরে ছিলেন পাবনা জেলার প্রশাসক। মুজিবনগর সরকার গঠনের পেছনে যে অর্থ লেগেছিল সেটা তিনিই যোগান দেন। শুধু তাই কি? তার ইতিহাস বলতে গেলে কম বলা হবে। পাবনায় প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু করেছিলেন মুজিবনগরের আগেই। ‘ বাংলাদেশ সরকার’ রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহার করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার যখন শপথ গ্রহণ করে সেখানকার ভূমিকা তো বললামই। এরপর চলে যান কলকাতায়। যোগদান করেন মুজিবনগর এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে। ইতিহাসে নাম লেখালেন বাংলাদেশের প্রথম সচিব হিসেবে। সব মন্ত্রণালয়ের একমাত্র সচিব। তারপর পেলেন সাধারণ প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সান্নিধ্যে। তারপর বিজয় দিবসের পর মুজিবনগর থেকে সরকার ঢাকায় স্থানান্তরেও প্রথম ব্যক্তি ছিলেন নুরুল কাদের। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি খানসেনাদের অমানবিক কার্যক্রমের প্রতি ঘৃণার প্রতিবাদরূপে পারিবারিক পদবি ‘খান’ ত্যাগ করেন।

মুজিবনগর সরকারের পরিচয়পত্র
মোহাম্মদ নুরুল কাদের ১৯৩৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল লতিফ খানও ছিলেন সরকারি চাকুরে। ঢাকার আরমানীটোলা হাইস্কুলে তাঁর ছাত্রজীবন কাটে। ১৯৫০ সালে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। কলেজ পাট চুকিয়ে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে যুক্ত ছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। মোহাম্মদ নুরুল কাদের ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। প্রথম চাঁদপুরের মহকুমা প্রশাসক বা এসডিও হিসেবে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাবনার জেলা প্রশাসক পদে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইটের পাশাপাশি রাজশাহী থেকে পাবনায় ৩৫০ জন সুসজ্জিত সৈন্য সমন্বয়ে দুই কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্য আসে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নুরুল কাদের নিজস্ব পরিকল্পনা অনুয়ায়ী স্থানীয় পুলিশ, আনসার ও মুক্তিসংগ্রামী ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করেন। স্থানীয় পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২৭ মার্চ রাত ১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনসে আক্রমণ করলে ২১ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পুলিশ লাইনসের এ সম্মুখ যুদ্ধে বীর-দেশপ্রেমিকের ভূমিকা রাখেন পাবনার তদানীন্তন সহকারী পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম। ওই সময় থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে রাজশাহী থেকে আগত পাকিস্তানি বাহিনী জেলা প্রশাসকের বাসভবন, যেখানে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিল, ১১টি স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে সাতটি যুদ্ধে নুরুল কাদের সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব হিসেবে তিনি মুজিবনগর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় আসেন। শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর সচিবালয়ে প্রশাসনিক ক্রিয়াকর্ম আরম্ভ করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়ী জীবন শুরু করেন। প্রথমে ওই সময় বঙ্গোপসাগরে তেল অনুসন্ধানে নিয়োজিত একটি বিদেশী তেল কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন। কালক্রমে তিনি কয়েকটি বৃহৎ বিদেশী কোম্পানির স্থানীয় এজেন্সিশিপ গ্রহণ করেন। এ সময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের ধারণা লাভ করেন তিনি। দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে টেকনিক্যাল ও মার্কেটিং কলাবোরেশন চুক্তি করে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম প্রসেস টেকনোলজিভিত্তিক শতভাগ রফতনিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানা দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড স্থাপন করে। দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে কলাবোরেশন চুক্তিটি ছিল বাংলাদেশের বেসরকারি সেক্টরে সর্বপ্রথম অনুরূপ চুক্তি।
নুরুল কাদের দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৩০ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রফতানিমুখী পোশাক তৈরির উৎপাদন ব্যবস্থাপনার কারিগরি জ্ঞান বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ব্যাক টু ব্যাক এলসি পদ্ধতি চালু করে, বন্ডেড ওয়্যার হাউজিং পদ্ধতি চালু করে এবং আমেরিকার সঙ্গে দরকষাকষি করে কোটাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে এ শিল্পকে শক্ত ভিত্তি প্রদান করেন। কালক্রমে এ শিল্প বিকশিত হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং ৪০ লাখ কর্মসংস্থানের দাবি করছে।
পোশাক শিল্পের রফতানি আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যয় হয় কাপড় আমদানিতে। তাই মূল্য সংযোজন বাড়ানোর লক্ষ্যে রফতানি মানের কাপড় দেশে উত্পাদনের জন্য ১৯৮৬ সালের দিক থেকেই নুরুল কাদের কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল স্থাপনের ধারণা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মহলে আলোচনা করেন। নুরুল কাদের স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন যে, কোটা পদ্ধতির অবলুপ্তি ঘটলে ভারত, পাকিস্তান বা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কাপড় পাওয়া দুষ্কর হবে। কারণ তখন ওইসব দেশ কাপড় রফতানি করার চেয়ে কোটার অবর্তমানে পোশাক তৈরি করে রফতানিতেই বেশি আগ্রহী হবে। এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের তাগিদে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সম্ভাব্যতা জরিপ করা হয় এবং তাতে দেশে কমপক্ষে ২৫টি কম্পোজিট টেক্সটাইল প্রকল্প স্থাপন করার সুপারিশ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এসব তথ্য বিশ্লেষণে এটা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আজকের বিকশিত রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে বীজ বপনে ভূমিকা রেখেছিলেন একজন দক্ষ সাবেক আমলা।
বর্তমানে দেশ গার্মেন্টস পরিচালনা করছেন ভিদিয়া অমৃত খান, নুরুল কাদিরের কন্যা। নারী ক্ষমতায়নের কথা উনিই বলেন-
‘দেশ গার্মেন্টস বাংলাদেশের প্রথম শতভাগ রফতানিকারক পোশাকশিল্প। গোড়ার দিকে ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৩০ জনকে নিজ উদ্যোগে পাঠালেন। যার মধ্যে ১৮ জনই ছিল তরুণী। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশ গার্মেন্ট। কিন্তু পুঁজি কোথায়। চালু করলেন ব্যাক টু ব্যাক এলসি। প্রকৃতপক্ষে ব্যাক টু ব্যাক এলসি মাধ্যমেই মোড় ঘুরে যায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আন্দোলনের চাকা। একে একে এগিয়ে আসেন অন্য উদ্যোক্তারা। ১৩০ জনের অনেকেই কয়েক বছরের মধ্যে আলাদা শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন- যা ছিল গার্মেন্ট শিল্পের পথিকৃৎ নুরুল কাদেরের স্বপ্ন। এখন শুধু দেশ গার্মেন্টেই কাজ করে ৭ শতাধিক নারী শ্রমিক। সংখ্যাধিক্যই শুধু নয় নেতৃত্বেও নারীদেরই প্রাধান্য সেই কারখানায়। দেশ গার্মেন্টে কাটিং ইনচার্জ, লাইনের সুপারভাইজার এবং কোয়ালিটি ইন্সপেক্টরও নারী। আর নারী শ্রমিকদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা যেমন : ন্যায্য বেতন-বোনাস, ওভারটাইম, মাতৃত্বকালীন ছুটি, যাতায়াতের জন্যে বহনের ব্যবস্থা এমনকি ফ্যাক্টরিতে নারী শ্রমিকদের সন্তানদের রাখার জন্যে আছে চাইল্ড কেয়ার ইউনিট।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের পথিকৃৎ মোহাম্মদ নুরুল কাদেরের নামে বিজিএমইএ তাদের মিলনায়তনের নাম রেখেছে। কিন্তু যে মানুষটির কারণে আজকে বাংলাদেশ কোটি কোটি ডলার প্রতি বছর আয় করছে, যার কারণে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, একজন অর্থনৈতিক বিপ্লবী হিসেবে এটা অবশ্যই তার প্রাপ্য।’
নুরুল কাদের স্বপ্ন দেখতেন এ শিল্প একপর্যায়ে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পরিণত হবে। আর ইতিমধ্যে তা হয়েছেও। তারপরও থেমে নেই। আকাশ আজ তাদের সীমা। তাঁরই প্রচেষ্টায় গার্মেন্টস শিল্পে এল বড় রকম প্রণোদনা। এর প্রধানতম হচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়া সহজীকরণ। ব্যাক টু ব্যাক এলসি আর বন্ডেড ওয়্যারহাউসের চিন্তা তিনিই করেন। এটা বাস্তবায়নেও সরকারকে সম্মত করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
আজ পরোক্ষভাবে ৫ কোটি লোকের জীবিকার ব্যাবস্থা করে দেয়ার পেছনের কারিগর বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের।
বাঙালীয়ানা/এআর