বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রদান এবং রবীন্দ্রনাথ । রাহমান চৌধুরী

Comments

বাংলা ভাষা আন্দোলনের পিছনের মূল লক্ষ্যটা ছিলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা মানে সর্বস্তরের শিক্ষার বাহন হবে বাংলা। স্বভাবতই দেশের উচ্চ শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বাহনও হবে বাংলা ভাষা। বাংলা তথা ভারতে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রচলন করেন ইংরেজ শাসকরা উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে, ইংরেজরা বঙ্গদেশের ক্ষমতা দখলের সাতাত্তর বছর পর। সকল ইংরেজরা এদেশে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার বাহন করতে চাননি। শিক্ষা পর্ষদের দশজন ইংরেজ সদস্যর পাঁচ জন মাতৃভাষায় আর পাঁচজন ইংরেজি ভাষার পক্ষে ছিলেন। শিক্ষার মাধ্যমরূপে ইংরেজিকে গ্রহণ করে ভারতীয় ভাষাসমূহের উন্নতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলো ইংরেজ শাসকরা। যখন অন্যরা ভারতে ইংরেজি চালু করার ব্যাপারে উদগ্রীব জেমস মিল তখন মাতৃভাষার প্রশ্নটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। তাঁর মতে, ভারতের মতো জনবহুল দেশে বেশির ভাগ মানুষকে ইংরেজি শেখানো অসম্ভব। আর এই অসম্ভবকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে অনেক প্রয়োজনীয় কর্তব্যই অবহেলিত থাকবে। বরঞ্চ ইউয়োপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইয়ের অনুবাদ করে দেশীয় ভাষায় শিক্ষা দিলে অনেক তাড়াতাড়ি অনেক বেশি লোককে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত করা সহজ হবে।

রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী ইংরেজি শিক্ষার কুফল নিয়ে বহু কথা বলেছেন। গান্ধী লিখছেন, ‘শত শত যুবকের বিশ্বাস যে, ইংরেজির জ্ঞান ছাড়া ভারতের মুক্তি অসম্ভব। সমাজে এমনভাবে ঘুণ ধরেছে যে, বহু স্থলে ইংরেজিতে জ্ঞান থাকাই হচ্ছে শিক্ষার একমাত্র অর্থ। আমার কাছে এসব হীনতা এবং দাসত্বের লক্ষণ’। তিনি অন্যত্র ইংরেজি শিক্ষিত ভারতবাসীদের সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিদেশী ভাষায় এই সম্প্রদায় এমন শিক্ষা পেয়েছে যে, জনসাধারণের মধ্যে তারা কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। সকলে তারা জানসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করতে চায় কিন্তু পারে না। নিজেদের তারা ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মতোই ভাবে। কারো কাছেই তারা হৃদয়ের দুয়ার খোলে না। তাদের চিন্তা জনসাধারণের মধ্যে কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা জাগায় না।’ গান্ধী ঠিকই বলেছিলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নাগরিকদের মধ্যে প্রভু আর অধীনস্তের সম্পর্ক তৈরি করে। যাঁরা কায়িকশ্রম করেন তাঁদের দেখা হয় খুব নীচু চোখে আর শিক্ষিত সুবিধাভোগীরা নিজেদের মনে করেন প্রভু। প্রভু সবসময় তার কর্তৃত্ব দেখাতে গিয়ে সাধারণের নাগরিক অধিকারকে বাধাগ্রস্থ করে।

বাংলাদেশের বহু সজ্জন ব্যক্তি মনে করেন, শিক্ষার মাধ্যমটা ইংরেজি হওয়া দরকার। না হলে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। বিনয়ের সাথে তাদের বক্তব্যের উত্তরে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের ইংরেজি বা অন্য ভাষা শিখলে তাতে কারো আপত্তি নেই, পৃথিবীর উন্নত দেশের শিক্ষিত মানুষ ন্যূনতম দুটো ভাষা শেখে। কিন্তু তাদের সকলেরই শিক্ষার বাহন হচ্ছে মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের নীতি গ্রহণ করার পরই সেসব দেশ উন্নতি লাভ করেছে। ইউরোপের রেনেসাঁর মূল কথা ছিলো মানবতাবাদকে প্রতিষ্ঠা দান এবং মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ। পাশ্চাত্যে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হতে শুরু করলো সেদিন থেকেই। কারণ মাতৃভাষায় তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করলো, মাতৃভাষার প্রতি জোর দেওয়া শুরু হলো সর্বক্ষেত্রে। বিশ্বে আজকে যে-সব দেশ উন্নত বলে পরিচিত – ফ্রান্স, জার্মানী, সুইডেন, নরওয়ে, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি সকলের শিক্ষার বাহন নিজেদের মাতৃভাষা। জাপান কিছুদিন ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করে, দ্রুত মাতৃভাষায় ফিরে এলো। এগুলি ইতিহাস।

ভারতবর্ষে যিনি শিক্ষার বাহন এবং দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি চালু করেছিলেন সেই ব্যবিংটন মেকলে বলেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ভারতে এমন এক সম্প্রদায় জন্ম নেবে, যারা রক্তে মাংসে চেহারায় দেখতে ভারতীয়দের মতো হলেও ব্রিটিশদের অনুগত হবে। ইংরেজদের দিয়ে যাওয়া চিন্তা চেতনাকেই লালন করবে। ভারতের জাতীয়তা বা স্বাধীনতা আন্দোলনে সে সত্যটা যেমন ধরা পড়েছিলো, ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্ন সভা সমাবেশে জনগণকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে যেসব বক্তৃতা দিতেন সেগুলি দিতেন ইংরেজিতে। বাংলার নেতারা যখন বিদেশী দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশী হবার কথা বললেন, সেগুলির ঘোষণাপত্র, বক্তৃতা সব ইংরেজিতে দেয়া হয়েছিলো। ব্যতিক্রম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর গান্ধী। বঙ্গভঙ্গের সমালোচনা করে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তেজস্বী ভাষায় জনগণের সামনে যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন, তা পুরোটাই ইংরেজিতে। পঞ্চাশ হাজার লোকের জনসমাবেশে আনন্দমোহন বসু রচিত যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিলো সেটাও ইংরেজিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেটা বাংলায় অনুবাদ করে সকলকে শুনালেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের কাছে ইংরেজি ভাষার দাসত্ব একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের আগে বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি জানা ভদ্রলোকদের বাবু বলে সম্বোধন করে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘যাহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাঁহারাই বাবু। মহারাজ! এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাঁহারা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে ঠিক লিখেছিলেন, বাঙালির ছেলের মতো এমন হতভাগ্য আর কেহ নয়। কেননা শিক্ষার প্রধান অবলম্বন হলো ইংরাজি। এই বিদেশী ভাষাকে আয়ত্ত করতে করতেই জীবনের মহেন্দ্রক্ষণ অতীত হয়ে যায়। যখন ওই বিদেশী ভাষা আয়ত্তে আসে, তখন আর যথার্থ শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকে না। ফলে ভাষা ভাব ও আচরণের মধ্যে কোনো স্বাভাবিক সমন্বয় গড়ে ওঠে না। শিক্ষা ও জীবন যাপন পদ্ধতি পরস্পরকে খণ্ডন ও বিদ্রুপ করতে থাকে। শিক্ষার বাহন প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ইংরেজি শিখিতে পারিল না এমন ঢের ঢের ভালো ছাত্র বাংলাদেশে আছে। তাদের শিখিবার আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যমকে একেবারে গোড়ার দিকেই আটক করিয়া দিয়া দেশের শক্তির কি প্রভূত অপব্যয় করা হইতেছে না? মাতৃভাষা বাংলা বলিয়াই কি বাঙালিকে দণ্ড দিতে হইবে?’ তিনি বিভিন্ন ভাষা শেখা নিয়ে কোনো আপত্তি করেননি। কিন্তু বারবার এই কথা বলে গেছেন, শিক্ষার ও গবেষণার উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদ্যাচর্চার একমাত্র বাহন হওয়া চাই বাংলা।

শিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সে উনিশশো ছত্রিশ সালের কামনা ছিলো এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম থেকে উচ্চতম পর্যন্ত সমস্ত বিভাগেই সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি সব বিষয়েই শিক্ষার একমাত্র বাহন হতে হবে মাতৃভাষা। ব্রিটিশ রাজত্বে যাঁরা ইংরাজি ভাষা যথাযথভাবে আয়ত্ত করতে অক্ষম ছিলেন, শিক্ষাজগৎ থেকে তাঁদের নির্বাসিত করার কিংবা তাঁদের ললাটে চিরমূর্খতার ছাপ মারার পক্ষপাতী তিনি একেবারেই ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ নিজের ছেলেবেলা সম্পর্কে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, ‘যখন চারদিকে খুব কষিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে, তখন সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বর্গগত সেজদাদার উদ্দেশ্যে সকৃতজ্ঞ প্রণাম নিবেদন করিতেছি।’ তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমি, সম্পূর্ণ বাংলাভাষার পথ দিয়েই শিখেছিলাম ভূগোল, ইতিহাস, গণিত, কিছু পরিমাণ প্রাকৃত-বিজ্ঞান। আমার বারো বৎসর বয়স পর্যন্ত ইংরেজিবর্জিত এই শিক্ষাই চলেছিল।’

রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন বাংলা ভাষায় তাঁর দখল সেভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি বলেন মাতৃভাষার উপর পারদর্শিতার কারণেই তিনি তার চিন্তাকে স্বচ্ছন্দে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি শিক্ষার দূর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর সমালোচনা করে জাতির উন্নয়ন প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, দেশের অধিকাংশ লোকের শিক্ষার উপর যদি দেশের উন্নতি নির্ভর করে এবং সেই শিক্ষার গভীরতা ও স্থায়ীত্বের উপর যদি উন্নতির স্থায়ীত্ব নির্ভর করে তবে মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো গতি নাই। তিনি আরো লিখছেন, ‘শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে হইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে, তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়! যে ভাষা দেশের সর্বত্র সমীরিত, অন্তঃপুরের অসূর্যস্পর্শ্য কক্ষেও যাহার নিষেধ নাই, যাহাতে সমস্ত জাতির মানসিক নিশ্বাসপ্রশ্বাস নিষ্পন্ন হইতেছে, শিক্ষাকে সেইভাষার মধ্যে মিশ্রিত করিলে তবে সে সমস্ত জাতির রক্তকে বিশুদ্ধ করিতে পারে, সমস্ত জাতির জীবনক্রিয়ার সহিত তাহার যোগসাধন হয়। ’ বিদ্যা বিস্তারের বাধাটা কোথায় সে সম্পর্কে বলেন, ‘বিদ্যাবিস্তারের কথাটা যখন ঠিকমত মন দিয়া দেখি, তখন তার সর্বপ্রধান বাধাটা এই দেখিতে পাই যে, তার বাহনটা ইংরেজি।’
বাংলাদেশে বাংলা ভাষা আন্দোলনের জন্য মানুষ প্রাণ দিলো, স্বাধীনতার পর ভাষার নামে দেশটির নাম হলো বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম প্রায় সবক্ষেত্রেই ইংরেজি।

বাংলাদেশে চল্লিশটির বেশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তার মধ্যে কি একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা গেল না, যার শিক্ষার বাহণ হবে সম্পূর্ণ বাংলা। রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাদানের জন্য। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তিনি ইংরেজ সরকারের অনুমোদন লাভ করতে পারেননি। ভারত স্বাধীন হবার আগেই তিনি শেষ নিংশ্বাস ত্যাগ করলেন। কিন্তু তারপরেও সেখানে কেউ বাংলা ভাষা চালু করলো না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র, বঙ্কিম চন্দ্র, মধুসূদন সকলেই স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা। মাতৃভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানের বিরুদ্ধে সম্ভবত প্রথম প্রশ্ন তুলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ আর প্রফুল্লচন্দ্র কতো শত বাক্য ব্যয় করেছেন বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষা আর বিজ্ঞান শিক্ষা দেবার জন্য। গান্ধীও বারবার বলে গেছেন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা। বাংলার সেই সব মনীষীদের কথা স্মরণ করে এবং ভাষা আন্দোলনের সকল সংগ্রামী এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক, যেখানকার সম্পূর্ণ শিক্ষার বাহন হবে বাংলা। তাহলেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার সুযোগ বাড়বে।

লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
Raahman Chowdhury

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.