বাংলা ভাষা আন্দোলনের পিছনের কারণটা সত্যিকার অর্থে কী ছিলো, মনে হচ্ছে সেটা নিয়ে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করবার রয়েছে। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ছিলো কি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি, নাকি ‘উর্দু ভাষা’র প্রতি ক্রোধ বা বিদ্বেষ? বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য কি আমরা সত্যিই এই লড়াই করেছিলাম? নাকি এই আন্দোলনে সামান্যতম মতাদর্শগত জায়গা ছিলো না, ছিলো মাত্র বিরোধের জন্য বিরোধিতা? জিন্নাহ যখন ইংরেজিতে বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা, সভায় তখন নাকি প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় ‘নো নো’ বলে। মানে না না। ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণীর মুখ থেকে প্রতিবাদের ‘না’ টা ধ্বনিত হয়েছিলো ইংরেজি ‘নো’ শব্দ দিয়ে। সঙ্গে আরো স্মরণ রাখা দরকার, উনিশশো আটচল্লিশ সালে প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু এবং বায়ান্নতে গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালীরা ‘মুসলিম লীগ’-এর বিরুদ্ধে বিকল্প যে জাতীয়তাবাদী দলগুলি গঠন করে তার নাম হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’, পরে ‘আওয়ামী লীগ’ আরো পরে বিভক্ত ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’। নামগুলির কোনটাই বাংলা নয়। রাজনৈতিক দলগুলির মূল নামটা ইংরেজি আর উর্দুতেই রাখা, ভাষা আন্দোলনের লড়াইটা তবে কীসের জন্য ছিলো? ঘটনাটা খুব ছোট, কিন্তু এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না, ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকরা যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলা ভাষার পক্ষে লড়াইয়ে তাদের চিন্তার জায়গাটা স্বচ্ছ ছিলো না। কথাটা হলো বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দান বা সর্বস্তরে তা চালু করার বাসনা তাদের মনে কি আদৌ ছিলো? থাকলে বাংলা ভাষার বর্তমান হাল কি এইরকম হতো? আরো স্মরণ রাখতে হবে, আমরা বাংলা তারিখ ৮ই ফাল্গুন না নিয়ে গ্রহণ করেছি একুশে ফেব্রুয়ারি।
বাংলা ভাষার পক্ষে লড়তে গিয়ে প্রতিবাদের ধ্বনিটা যেমন বাংলা ছিলো না, জাতীয়তাবাদী দলের নামগুলি বাংলায় রাখা হলো না। সত্তর বছরেও সর্বস্তরে বাংলা চালু করা গেল না। তারপরেও কি মনে করতে হবে এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলা ভাষার মর্যাদা দান? বাংলা ভাষাকে সম্মানদানের নমূনা কি এই যে, বাংলাদেশের শিক্ষার বাহন বাংলা নয় বরং অধিক ক্ষেত্রেই ইংরেজির আধিপত্য। বাংলাদেশের বহু স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা শিশুকাল থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করে, বহুজনের সন্তানরা বাংলা বলতে পারলেও বাংলায় লিখতে এবং পড়তে পারে না। বাংলার প্রতি প্রেমে এতই পরকাষ্ঠা তারা যে, সুযোগ থাকলে প্রায় সকলেই সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতো। হতেই পারে এটা তাদের ব্যক্তিগত অধিকার যে সন্তানকে তারা ইংরেজি পড়াবে, নিজেরা ইংরেজি চর্চা করবে। কিন্তু তাহলে এতো ঘটা করে বাংলা ভাষার নামে কেন প্রতিবছর তারা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছে। যারা বাংলায় কথা বলে, বাংলা সংস্কৃতিকে ধারণ করে গ্রামের সেইসব কৃষকরা ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে না। বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে তারাই জীবন্ত রেখেছেন, কোন আনুষ্ঠানিকতা ভন্ডামী না করেই। রাষ্ট্রভাষা যদি উর্দু হতো তাহলেও তারা বাংলাই বলতো। ভিন্ন প্রশ্নটি হলো, রাষ্ট্র যে ঘটা করে প্রতিবছর বহু টাকা ব্যয়ে সারাদেশ জুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে, রাষ্ট্রের তাহলে দায়টা কী? বাংলা ভাষার মর্যাদা কতোটা রক্ষা করছে রাষ্ট্র বা সরকারগুলি? যখন দেশ স্বাধীন হয়, তখন বেশ কয়েকটা চিকিৎসা শাস্ত্রের বই লেখা হয়েছিলো বাংলায়। ধারণা করেছিলো, স্বাধীনদেশে সব শিক্ষার বাহন হবে বাংলা। কিন্তু হলো না। রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ, ভাষা দিয়ে রাষ্ট্রের নামের শুরু। কিন্তু ভাষার মর্যাদা নেই সত্যিকারভাবে। ইংরেজির দাপটে বাংলা পলাতক নগরজীবনে, সরকারী বেসরকারী চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে।
জিন্নাহ রাষ্টভাষা উর্দু চেয়েছিলেন, তিনি নিজে উর্দু জানতেন না এবং তাঁর নিজের মাতৃভাষা ছিলো গুজরাটি। জিন্নাহ ইংরেজিটাই ভালো জানতেন, তবুও ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেননি। তিনি যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিরেন, পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের সেটা ভাষা ছিলো না। দ্বিতীয়ত তিনি বিশেষ কোনো প্রদেশের ভাষা না নিয়ে, নিলেন নিরপেক্ষ এমন একটি ভাষা যা ভারতবর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে বিবেচিত হতো। নিজে সবসময় তিনি ইংরেজিতে কথা বলতেন, জনসভায় বক্তৃতা দিতেন, সেই জিন্নাহ ব্রিটিশ শাসকদের ভাষা গ্রহণ না করে ভারতীয় একটি ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে চাইলেন কেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। জিন্নাহ এই ভাষা গ্রহণের পক্ষে কোনো যুক্তি দেখাননি। জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করতে চাইলে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিলো। নিঃসন্দেহে বাঙালীর এই প্রতিবাদ ছিলো যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালীর প্রতিবাদেরই বা মূল কারণটি কী ছিলো তা স্পষ্ট নয়। ধরা যাক, যদি জিন্নাহ সেদিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা না করে যদি ভারতের মতো ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইতেন, শিক্ষিত সুবিধাভোগী বাঙালীর ভূমিকা কী হতো? সকলেই তাঁরা কি প্রতিবাদ করতেন? বর্তমান বাস্তবতা প্রমাণ করে, তা করতেন না হয়তো। জিন্নাহ তাহলে খলনায়ক না হয়ে হয়েতো ইংরেজি শিক্ষিত সুবিধাভোগী বাঙালীর প্রাণের নায়ক হতেন। কথাটা বলার পিছনের যুক্তিটা দেয়া যাক।
ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালী ভদ্রলোকদের প্রায় সকলেরই যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে ইংরেজি ভাষার প্রতি, কিছু মুসলমান কট্টোর ধার্মিকদের যেমন আরবী ভাষার প্রতি। দুপক্ষের চিন্তায় খুব ফারাক নেই। নিজের ভাষা বাদ দিয়ে দুপক্ষই বিদেশী ভাষার অনুগত। ইংরেজি ভাষার পক্ষে যাঁরা তাঁরা মনে করেন, ইংরেজির চর্চা ছেড়ে দিলে বা শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি রাখা না হলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। যুক্তি হলো তাঁদের, বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই ইংরেজি জানে কম, সেখানে ইংরেজি বাদ দিয়ে বাংলায় শিক্ষা দিলে দেশটা নিশ্চিত ধ্বংস হবে। সকল উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্থ হবে, দেশটা পিছিয়ে পড়বে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নে কাদের ভূমিকা বেশি? ইংরেজি জানা ভদ্রলোকেদের নাকি ইংরেজি না জানা কম শিক্ষিতদের। ইংরেজি জানা শিক্ষিতরা যখন লুটপাট করছে, তখন ইংরেজি না জানা মানুষরাই দেশের উন্নয়নের ভিত গড়ে দিচ্ছে। ইংরেজি না জানা মানুষগুলি হাত গুটিয়ে ফেলুক, দেখা যাবে ইংরেজি শিক্ষিতরা কী উন্নয়ন বয়ে আনতে পারে! বিশ্বের যেসব দেশ উন্নত যেমন: ফ্রান্স, জার্মানী, সুইডেন, নরওয়ে, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি সকলের শিক্ষার বাহন নিজেদের মাতৃভাষা। রোমান সাম্রাজ্যের ল্যাটিন ভাষা, যা শাসকদের ভাষা ছিলো সেটা বাদ দিয়ে যখন মাতৃভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা আরম্ভ হলো, তখনই এই সকল দেশ এগিয়ে গেল। জাপান কিছুদিন ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করে, দ্রুত মাতৃভাষায় ফিরে এলো। এগুলি ইতিহাস।
সকল ইংরেজরা এদেশে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার বাহন করতে চাননি। শিক্ষা পর্ষদের দশজন ইংরেজ সদস্যর পাঁচ জন মাতৃভাষায় আর পাঁচজন ইংরেজি ভাষার পক্ষে ছিলেন। খুবই উন্নাসিক প্রকৃতির মেকলে যখন ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন, তিনি স্পষ্টই বলে দিয়েছিলেন এর মধ্যে দিয়ে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীকে শাসকদের দালাল হিসেবে তৈরি করা সম্ভব হবে, যারা সর্বদাই ইংরেজদের গুণগান করবে। তিনি বলেছিলেন, রক্তে মাংসে দেখতেই শুধু ভারতীয় হবে, কিন্তু নিজ দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে শাসকদের পক্ষ নেবে। শিক্ষার মাধ্যমরূপে ইংরেজিকে গ্রহণ করে তিনি ভারতীয় ভাষাসমূহের উন্নতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। স্যার জন ম্যালকম তার পূর্বে আঠারশো আটাশ সালে লিখেছিলেন, একদল ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়দের আমাদের শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন শাখায় নিযুক্ত করা দরকার। তিনি স্পষ্টই বলেন, সরকারের অধিক সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য ভারতীয়দের ইংরেজি শিক্ষিত করা একান্তই জরুরী। যখন অন্যরা ভারতে ইংরেজি চালু করার ব্যাপারে উদগ্রীব জেমস মিল তখন মাতৃভাষার প্রশ্নটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। তাঁর মতে, ভারতের মতো জনবহুল দেশে বেশির ভাগ মানুষকে ইংরেজি শেখানো অসম্ভব। আর এই অসম্ভবকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে অনেক প্রয়োজনীয় কর্তব্যই অবহেলিত থাকবে। বরঞ্চ ইউয়োপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইয়ের অনুবাদ করে দেশীয় ভাষায় শিক্ষা দিলে অনেক তাড়াতাড়ি অনেক বেশি লোককে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত করা সহজ হবে।
রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী ইংরেজি শিক্ষার কুফল নিয়ে বহু কথা বলেছেন। গান্ধী লিখছেন, ‘শত শত যুবকের বিশ্বাস যে, ইংরেজির জ্ঞান ছাড়া ভারতের মুক্তি অসম্ভব। সমাজে এমনভাবে ঘুণ ধরেছে যে, বহুস্থলে ইংরেজিতে জ্ঞান থাকাই হচ্ছে শিক্ষার একমাত্র অর্থ। আমার কাছে এসব হীনতা এবং দাসত্বের লক্ষণ’। তিনি অন্যত্র ইংরেজি শিক্ষিত ভারতবাসীদের সম্পর্কে লিখেছেন, বিদেশী ভাষায় এই সম্প্রদায় এমন শিক্ষা পেয়েছে যে, জনসাধারণের মধ্যে তারা কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। সকলে তারা জানসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করতে চায় কিন্তু পারে না। নিজেদের তারা ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মতোই ভাবে। কারো কাছেই তারা হৃদয়ের দুয়ার খোলে না। তাদের চিন্তা জনসাধারণের মধ্যে কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা জাগায় না। যারা মনে করছেন, ইংরেজি না হলে উন্নয়ন হবে না, গান্ধীর বিভিন্ন লেখায় বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ইংরেজি শিক্ষার কুফলই ধরা পড়ছে।
বাংলা ভাষা আন্দোলনকে সফল করতে হলে, শহীদ মিনারে শুধু ফুল দিয়ে সেটা হবে না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার মধ্য দিয়েই সেটা হতে হবে। শহীদদের প্রতি, ভাষা আন্দোলনের সকল সংগ্রামীদের প্রতি সেটাই হবে সত্যিকার সম্মান জানাবার উপায়।
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক