বিশ শতকের বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ সালে কাজী নজরুল ইসলামের জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খুব দুঃখ করি আমরা কাজী নজরুলের জীবনের মর্মান্তিক এরকম ঘটনার জন্য। কখনো কি ভিন্নভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখেছি। যদি নজরুল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কথা বলতে পারতেন, কবিতা লিখতে পারতেন, গান গাইতে পারতেন কী ঘটতো তাহলে? তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখে যেতেন। নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার পর স্বাধীন ভারতের সরকারের বিরুদ্ধে লিখে যেতেন কিংবা তা না হলে দলের মন্ত্রী হয়ে সরকারি দলের চাটুকারি করতেন। যদি তিনি চির বিদ্রোহী থেকে স্বাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লিখে যেতেন, কদিন পর দেখা যেতো হয়তো আইন করে সরকার তাঁর জবান বন্ধ করে দিয়েছে। নজরুলকে বাকস্বাধীনতা দেয়ার সাহস সরকারের হতো কি না সেটা একটা প্রশ্ন। নজরুলকে বাকস্বাধীনতা দেয়ার মতো বিপদ ঘাড়ে নেয়ার সাহস খুব কম সরকারে থাকতো। নজরুলের জবান থাকলে নজরুল সাতাত্তর বছর বেঁচে থাকবার সুযোগ পেতেন কিনা, সেটাই বসে ভাবতে হবে। তিনি গুম হয়ে যেতে পারতেন, খুন হতে পারতেন। কিংবা ভাষা আন্দোলনের মিছিল গুলি খেয়ে প্রাণ দিতে পারতেন। বহু কিছু ঘটতে পারতো যদি তিনি বিদ্রোহী থেকে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ যদি ভারতের স্বাধীনতার পর কিছুদিন শক্তিসামর্থ নিয়ে বেঁচে থাকতেন, সন্দেহ তাঁর গান জাতীয় সঙ্গীত হবার মর্যাদা পেতো কিনা? রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় চুপ করে থাকতেন না সরকারের কোনো অপরাধ লক্ষ্য করলে। বিদ্রোহী বা সমালোচক রবীন্দ্রনাথের গান তাহলে জাতীয় সঙ্গীত হতো কি না লক্ষ টাকার প্রশ্ন সেটা। নজরুল আর রবীন্দ্রনাথ যদি দুজনেই রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন তখন? দুজন মিলে কী একটা কাণ্ড যে ঘটাতেন! বিদ্রোহী হলে রবীন্দ্রনাথ কি কারাগারের বাইরে থাকতে পারতেন? স্বাধীন ভারতের সরকারের সামান্য সমালোচনার করে স্বয়ং গান্ধীর জীবনে কী ঘটেছিল তা আমরা অনেকেই জানি। ভারতের উৎপল দত্ত সে বিষয় নিয়ে “একলা চলো রে” নামে নাটক লিখেছেন।
স্বাধীন দেশের বাকস্বাধীনতার নমূনা দেখে কথাগুলি বারবার মনে হচ্ছে আজকে নজরুল জন্মজয়ন্তীতে। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ শাসনে বারবার একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ব্রিটিশরা চলে গেলে যারা শাসন ক্ষমতায় আসবে তারা কি খুব ন্যায়পরায়ণভাবে দেশ চালাবে? তিনি বলতেন দুর্বলের শাসন ভয়ঙ্কর। তিনি বহুবার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, ইংরেজরা চলে গেলেই স্বাধীন ভারতে জনগণ ন্যায়বিচার পাবে কি না তা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এসব ব্যাপারে ছিলেন খুব নৈর্ব্যক্তিক। স্বাধীন ভারত আর রবীন্দ্রনাথের কথা বাদ দেই। কারণ এসব এখন কল্পনা। কী হলে কী হতো বলাটা মুশকিল। কিন্তু তারপরেও মনে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার যে নমূনা, নজরুলের বাক থাকলে তাকে কি সহ্য করা যেতো? রবীন্দ্রনাথের যদি আয়ু হতো নব্বই বছর, কী ঘটতে পারতো তবে স্বাধীন দেশে? তিনি কি স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারতেন। উৎপল দত্তের নাটকে দেখতে পাই, স্বাধীন মতামত দেয়ার জন্য প্যাটেল গান্ধীকে স্বাধীন দেশে বলে বসলেন আপনি রাষ্ট্রদ্রোহী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেল ভয় দেখালেন গান্ধীকে রাষ্ট্রীয় বিধানের। কিছুদিন পর প্রায় নিরাপত্তাহীনভাবে জাতির জনক গান্ধী নিহত হলেন। রবীন্দ্রনাথের মর্যাদা কি বেশি হতো জাতির জনক গান্ধীর চেয়ে রাষ্ট্রের কাছে? যাক, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যা হয়নি তা হয়নি। সে নিয়ে ভাবনা থাক। নজরুলের প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
মূল কথাটা হলো, নজরুল বাকশক্তি হারিয়ে ফেলাতে যে আমরা এত কান্নাকাটি করেছিলাম বা এখনো যে মন খারাপ করি; যাদের এ সমাজে বাক আছে তাদের তাহলে বাকস্বাধীনতা হরণ করছি কেন? নজরুল বেঁচে থাকলে তাঁর লেখনি যে এখন যাঁরা বাকস্বাধীনতা দাবি করেন, নিজের কথাটা বলতে চান তাঁদের চেয়ে তীক্ষ্ণ হতো সেটা কি অস্বীকার করতে পারি? রাষ্ট্রকে সমালোচনা করার জন্য সেই নজরুল সত্যি কি বাকস্বাধীনতা পেতেন যদি তাঁর জবান বন্ধ না হয়ে যেতো? যদি নজরুল বাকশক্তি হারিয়ে ফেলাতে আমরা কষ্ট পেয়ে থাকি, তাহলে যাঁরা এখন কথা বলতে চান, আইন করে সবরকম বাকস্বাধীনতা হরণ করে তাঁদের বাকরুদ্ধ করে রেখেছি কেন? বাকস্বাধীনতায় আমাদের এত ভয় কেন? নজরুলের বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়াতে তবে কি রাষ্ট্র স্বস্তি পেয়েছিল যাঁর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত আর নতুন করে বাকরুদ্ধের আইন করতে হয়নি। বাকরুদ্ধ না হলে নজরুল কি কারাগারের বাইরে দীর্ঘদিন মুক্তজীবন যাপন করতে পারতেন? যাদের জবান আছে তাদের যখন কথা বলতে দিচ্ছি না, যাদের জবান নেই তাদের জন্য আর হা হুতাস করে কী হবে?
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক