১৯৭৫ সালের ০৬ জুন। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র— এই চারটি মূলনীতি নিয়ে ঘোষিত হয় বাকশালের গঠনতন্ত্র। বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ‘বাকশাল’ সম্পর্কে এতো বেশি মিথ্যাচার ও গুজব ছড়ানো হয়েছে যে— আজকাল এ নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের সদস্যরাও খুব বেশি কথা বলতে চান না। অথচ আমি জানি না, ঠিক কতোজন মানুষ সত্যিকার অর্থেই বাকশালের গঠনতন্ত্রটি পড়েছেন। বাকশাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যে বক্তব্যগুলো দিয়েছিলেন, তার কতোটুকুই বা সামলোচকরা শুনেছেন বা পড়েছেন— আমার জানা নেই। যে মানুষগুলো বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের সিংহভাগই এখনও বেঁচে আছেন। অথচ পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রীয় মদদে যখন বাকশাল সম্পর্কিত বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছিলো, একের পর এক মিথ্যাচার করা হয়েছিলো বাকশাল সম্পর্কে; তখন কতোজন এর প্রতিবাদ করেছিলেন?
তবে প্রতিবাদ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। বাকশাল সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অসংখ্য বইপত্তর পাওয়া যায়, সেগুলো সহজলভ্যও। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাকশালের সত্য ইতিহাস তুলে ধরে তখন বই লেখা হয়নি। গুটিকয়েক বই লেখা হয়েছিলো, কিন্তু একে তো সেগুলো সহজলভ্য নয়, দ্বিতীয়ত বেশ কয়েকটি বইয়ের খোঁজই এখন আর পাওয়া যায় না।
ফলে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর পক্ষে বাকশাল সংক্রান্ত মিথ্যাচার ছড়িয়ে দেয়া সহজ হয়েছিলো। যে পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতা বা দলগুলো বাকশালের অন্তর্ভুক্ত ছিলো, তারাও কেনো এইসব মিথ্যাচারকে চ্যালেঞ্জ করলেন না— এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
বাকশালের গঠনতন্ত্র পড়ার পর আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটুকু বুঝি, বাঙলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দল এতোখানি উদারনৈতিক ও বৈশ্বিক ধারণা তাদের গঠনতন্ত্রে ধারণ করতে পারেনি। গঠনতন্ত্রের প্রথম ধারাভুক্ত ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’ অংশের দুটো উপধারা পড়লেই বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধের মৌলনীতির সঙ্গে ‘মানব-সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের স্বীকৃতি’, ‘মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি’ ও ‘শোষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা’ বাকশালের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। আমি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের নাতিদীর্ঘ অনুচ্ছেদ দুটো থেকে এই কথাগুলো তুলে আনলাম এ কারণেই যে, আমাদের বুদ্ধিজীবীমহল গত পঞ্চাশ বছর ধরে এইসব গুণাবলীসম্পন্ন সমাজ গঠনের কথাই বলে আসছেন। তাহলে বাকশালে তাদের পোষালো না কেনো?
এই প্রশ্নের উত্তর বঙ্গবন্ধুই দিয়ে গেছেন তাঁর সংসদ বক্তৃতায়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন— “মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমি একদিন এই হাউজে বলেছি, আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড়ো বড়ো অর্থশালী লোক, যারা বিদেশ থেকে ভোট কেনার জন্য পয়সা পায় তাদের গণতন্ত্র নয়— শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের। এবং সে কারণেই আজকে আমাদের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে”।
বাকশাল সম্পর্কে বলতে বা লিখতে গিয়ে অনেকেই দেখেছি ‘একদলীয় শাসনব্যবস্থা’ বা ‘স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা’ শব্দযুগল ব্যবহার করেন। বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়ে প্রশ্নও করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক আবীর আহাদ। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন— “সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ পুঁজিবাদী সমাজসভ্যতা ও শোষক পরজীবীদের দৃষ্টিতে বাকশাল তো একদলীয় শাসনব্যবস্থা হবেই! কারণ বাকশাল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি বহুজাতিক পুঁজিবাদী শোষক, তাদের সংস্থাসমূহের লগ্নিকারবার এবং তাদের এদেশীয় সেবাদাস, এজেন্ট, উঠতি ধনিক গোষ্ঠীর একচেটিয়া শোষণ ও অবৈধ প্রভাব-প্রতিপত্তি-দুর্নীতি-প্রতারণার সকল বিষদাঁত ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি”।
বস্তুত বাকশাল ছিলো জাতীয় দর্শন ও আদর্শভিত্তিক একটি ঐক্য, যে ঐক্যকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘একচুয়াল যেটা পিপল’ তাদের ঐক্য। এই ঐক্য মানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে দেশের মঙ্গলের জন্য একটি রাজনৈতিক ঐক্য— খাতা-কলমে অনেকে যেটাকে ‘জাতীয় সরকার’ বলে থাকেন। এমন জাতীয় সরকারের দাবি কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই মওলানা ভাসানীসহ অনেকে করে এসেছেন, কিন্তু বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর উনাদের সেটা ভালো লাগেনি। কেনো? জাতীয় দর্শন ও আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যের কথা বলা হয়েছিলো বলে? তাহলে বাহাত্তরের পর থেকে জাতীয় সরকার চাওনেওয়ালারা কী চেয়েছিলেন? হক-মতিন-তোয়াহা-নিজামী-গোলাম আযমসহ সকল চিন ও ইসলামি যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হোক? সেই খায়েশে বাকশাল জল ঢেলে দিয়েছিলো বলেই সাংবিধানিকভাবে বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল করেও তার বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করেনি তারা।
আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করা উচিৎ, সেটি হলো— বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। বাকশালে তারা ছিলেন, আবার বাকশালের শর্ত না মেনে গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির কাঠামোও অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। বাকশাল সম্পর্কে দুটো ভালো যুক্তি দেখালেই কেউ কেউ বলেন, সিপিবির পরামর্শ মতোই বঙ্গবন্ধু বাকশাল করেছিলেন। আবার বাকশালের সমালোচকদের সামনে গিয়ে পার্টি কাঠামো অক্ষুন্ন রাখার দাবি করেন। প্রথমটি মিথ্যে হলেও, দ্বিতীয়টি সত্য। বাকশালে যোগ দেয়া ছাড়া সিপিবির আর কোনো ভূমিকা ছিলো না। এই কথা সিপিবির গোপন দলিল ও জনাব নূহ-উল-আলম লেনিন নিজের ডায়রির বরাত দিয়ে আমাদের জানিয়েছেন। সুযোগ মতো তারা বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় মদদে যখন এর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ছড়ানো শুরু হলো, তখন ঠিক পাশ কাটিয়ে গেলেন। কোনোদিন এইসব মিথ্যাচারের প্রতিবাদ তারা করেননি।
এখন বাকশাল সম্পর্কে কিছু নথিপত্র পাওয়া যায়। অগ্রজ অনেকের কাছেই এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে ঠিকঠাক উত্তর দেন। কেউ কেউ আগের মতোই নানা বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে থাকেন, তখন তার সামনে গঠনতন্ত্রটা মেলে ধরলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন— এটা পাওয়া যায়?
জ্বি, পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে যেসব নথিপত্র আপনারা নাই বলে ধরে নিয়েছিলেন, সেগুলো আদতে আছে। একটু হদিশ করলেই পাওয়া যায়। ভবিষ্যত প্রজন্মকে যেনো ওইটুকু হদিশও করতে না হয়, সে ব্যবস্থাও করা হবে নিশ্চয়ই। নির্দোষ চায়ের ক্যান্টিনের আড্ডা কেবল কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বা রেডবুকেই যেনো আটকে না থাকে, প্রজন্ম জানুক তার ‘বাকশালের গঠনতন্ত্র’ও আছে— যুগের পর যুগ, যার বিরুদ্ধে কেবল প্রোপাগান্ডাই ছড়ানো হয়েছে।
মগজে সত্যটুকু থাকলে বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করা যায়। ৪০-৪৫ বছর পরে হলেও যায়।
লেখক:
মারুফ রসূল, লেখক ও ব্লগার