বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

Comments
বাঙালীর প্রেম, আবেগ, বাস্তবতা এবং নির্মেদ রোমান্টিসিজম নিয়ে রুপালী পর্দায় গোটা একটা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন নায়ক থেকে মহানায়ক। একটা প্রজন্মকে বিশাল সময়জুড়ে অভিনয়, সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন। সেলুলয়েডের সেই মোহাবিষ্ট জগতে নিজের মেধা, প্রজ্ঞা এবং অনন্য পরিশ্রম দিয়ে যিনি সফলতার সিড়ি বেয়ে পৌঁছেছেন স্বর্গের দরজায়, তিনি মহানায়ক উত্তম কুমার । মৃত্যুর এত বছর পরেও বাঙালির সুপ্ত আবেগ ও নস্টালজিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যিনি জড়িত, তিনি উত্তম কুমার।
বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

মহানায়ক উত্তম কুমার

অরুন কুমার চট্টোপাধ্যায়। সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ঠাকুমা আদর করে ডাকতেন উত্তম। ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে কলকাতার আহিরীটোলায় মামারবাড়িতে জন্ম উত্তম কুমারের। তার পিতৃনিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। পিতা সাতকড়ি চ্যাটার্জী এবং মা চপলা দেবী। দু’ভাই বরুণ এবং তরুণ। উত্তম যখন নিতান্তই শিশু তখন একবার তাদের বাড়িতে আসেন পরিবারের কুলগুরু। তিনি শিশু উত্তমকে কোলে নিয়ে বলেন- “এই ছেলে একদিন হাসিতে ভুবন ভোলাবে।” যে কথাটি পরবর্তীতে ফলেছে উত্তম রূপেই। সেই হাসিতে হৃদয় কেঁপেছে লাখো তরুণীর। সেই হাসির খ্যাতি ছড়িয়েছে দুনিয়া জোড়া।

কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুলের ছাত্র ছিলেন উত্তম। অভিনয় জগতে আসার পেছনে তার পরিবারের প্রভাব ছিলো গুরুত্বপূণ। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। পাড়ার থিয়েটারেও অভিনয় করতেন।   সংস্কৃতিমনা উত্তমের বাপ-চাচারা পাড়া-প্রতিবেশীর সহায়তায় গড়ে তুলেছিলেন ‘ সুহৃদ সমাজ’। বিভিন্ন উৎসবে সুহৃদ সমাজ থেকে যাত্রাপালার আয়োজন করা হত। বাপ-চাচাদের যাত্রাপালায় অভিনয় দেখে উত্তমের অভিনয়ের খায়েশ জাগে। আর তার জের ধরেই স্কুলে থাকতেই উত্তম কুমার তার মহল্লায় নাট্যসংগঠন লুনার ক্লাব-এ জড়িয়ে পড়েন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুকুট’ নাটিকায় অভিনয় দিয়ে শুরু হয় মহানায়কের অভিনয় জীবন।

আরো পড়ুন
অন্য উত্তম

উত্তমের মাথায় চেপে বসলো সিনেমার ভূত। যে করেই হোক সিনেমায় অ্যাক্টিং করতে হবে। তখনকার দিনে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সাথে গান জানা অপরিহার্য ছিল। তাই তৎকালীন অনেক নামী-দামী শিল্পী যেমন-কানন দেবী, অমিতবরণ, রবীন মজুমদার, পাহাড়ী স্যান্নাল, কুন্দন লাল সায়গল সবাই গান জানতেন। উত্তম কুমার তাই গান শিখতে কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত শিক্ষক নিদান ব্যানার্জীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

ছেলের জন্মদিনে উত্তম কুমার।

সংসারে অভাব থাকায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি দিনে পোর্ট কমিশনার্স অফিসের ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি নেন আর রাতে ভর্তি হন ডালহৌসির গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি ১৯৪৫ সালে বি. কম. পাস করেন।  তবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি। তার আগেই চাকরি নেন কলকাতার পোর্টে। এদিকে ১৯৪৮ সালে প্রেম করে বিয়ে করেন গৌরী চ্যাটার্জিকে। একদিকে চাকরি আর সংসার অন্যদিকে অভিনয়ের আগ্রহ। মধ্যবিত্ত ঘরের এই তরুণের পক্ষে বেশ কঠিন হয়েছিল সিনেমায় সুযোগ পাওয়া। অনেক পরিচালকের নির্মম বিদ্রুপেরও শিকার হতে হয়েছে। সেসব দিনের কথা উত্তম বলেছেন তার আত্মজীবনী ‘আমার আমি’তে।

অভিনয় পাগল উত্তম কুমার চলচ্চিত্রের সংগে সংগে সমান তালে মঞ্চেও কাজ করে যান । স্টার থিয়েটারে এক নাগাড়ে ‘শ্যামলী’ নাটকের ৪৮৬ টি প্রদর্শনীতে তিনি অভিনয় করেন। চাকরীর পাশাপাশি সুহৃদ সমাজ নাট্যগোষ্ঠীতে তিনি অভিনয় করতেন নিয়মিত। এটি তাদের পারিবারিক নাট্যগ্রুপ হিসেবে খ্যাত। নিতীন বোস পরিচালিত মায়াডোর নাটকে তিনি সকলের নজর আকর্ষণ করেন। এরপর নীতিন বোসের পরিচালনায় দৃষ্টিদান ছবিতে ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

নায়িকাদের সাথে তাস খেলায় ব্যস্ত উত্তম কুমার।

উত্তম কুমারের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘দৃষ্টিদান।’ ১৯৪৮ সালে দৃষ্টিদান ছবিতে নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ঐ বছরেই তিনি গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন। প্রথম নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৪৯ এ ‘কামনা’ ছবিতে। তবে সেখানে তার নাম ছিলো উত্তম চট্টোপাধ্যায়। উত্তম কুমার নামে অভিনয় করেন ১৯৫১ তে ‘সহযাত্রী’তে। আর ওই বছরই তার ছেলে গৌতমের জন্ম হয়।

উত্তম ততদিনে ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে নাম লেখালেও পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হননি। তার ভাগ্য খুলে দেয় প্রথম হিট ছবি ‘বসু পরিবার’। ‘বসু পরিবার’ মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে। ছবিটি ব্যবসা সফল হওয়ার পাশাপাশি দর্শক-সমালোচক-মিডিয়া মুখরিত হয় তাঁর প্রশংসায়। প্রচুর কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি। শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদুস্তুর অভিনেতা বনে যান।

বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয় ১৯৫৩ সালে এমপি প্রোডাকশনের হাসির ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তির মাধ্যমে। “সুচিত্রা সেন উত্তম কুমার” জুটি বাংলা সিনেমার অমর জুটি নামে খ্যাত। অগ্নি-পরীক্ষা ছবি মুক্তির পর প্রমাণিত হলো বাংলা ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী জুটি উত্তম-সুচিত্রা। তারা দুজন এক সাথে প্রায় ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং সবক’টি ছবি চুড়ান্ত সাফল্য লাভ করেছে। তাদের অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হল – হারানো সুর, অগ্নী পরীক্ষা, প্রিয় বান্ধবী, শাপমোচন, ইন্দ্রাণী, সপ্তপদী ইত্যাদি এই জুটি প্রায় কুড়ি বছর ধরে সেরা জুটির শিরোপা ধরে রেখেছিল।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

সুচিত্রা সেন ছাড়াও উত্তম কুমারের সাথে যে নায়িকার জুটি প্রায় সমানে সমানে আলোচিত তিনি হলেন সুপ্রিয়া দেবী। সোনার হরিণ থেকে তাদের জুটির জয়যাত্রা শুরু। এরপর তারা একে একে উত্তরায়ণ, কাল তুমি আলেয়া, সন্যাসী রাজা, বন পলাশীর পদাবলী, বাঘ বন্দীর খেলা ইত্যাদি জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেন।

উত্তম সুচিত্রা এবং উত্তম সুপ্রিয়ার ক্রেজ শেষ হওয়ার পর শেষ দিকে উত্তম কুমারের সাথে সাবিত্রী চ্যাটার্জীর জুটি খুবই জনপ্রিয় হয়। উত্তম কুমার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সাবিত্রীকে প্রতিভাশালী অভিনেত্রী অ্যাখ্যা দিয়ে এসেছেন। তাদের করা উল্লেখ যোগ্য কিছু ছবি হল হাত বাড়ালেই বন্ধু, দুই ভাই, নিশি পদ্ম, মোমের আলো ইত্যাদি। ধন্যি মেয়ে বা মৌচাকের মত কমেডি ছবিতে সাবিত্রীর সাথে জুটি বেঁধে উত্তম কুমারের হাসির অভিনয় আজও সকল দর্শকের মন জয় করে।

সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, মাধবী মুখোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় নায়িকার বিপরীতে অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবিতে অভিনয় করলেও সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তার জুটি বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি বলে এখন পর্যন্ত বিবেচিত।

১৯৬২ সালে স্ত্রীর সঙ্গে উত্তমের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ততদিনে মিডিয়ায় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর সংগে তার সম্পর্কটির বিষয় কারো অজানা নয়।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

পরিবারের সঙ্গে উত্তম কুমার।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, প্লে ব্যাক সিংগার, মিউজিক কম্পোজার হিসেবে একাধারে কাজ করেছেন। উত্তম কুমারের বেশীরভাগ ছবি ব্যবসায়িক ভাবে সাফল্য পেলেও, পাশাপাশি ন্যাচারাল অভিনয়ের জন্য চলচ্চিত্র সমালোচক, বোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন অঢেল। ১৯৬৭ সালে যখন ভারত সরকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার চালু করে, তখন উত্তম কুমার ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ ও ‘চিড়িয়াখানা’র জন্য সর্বপ্রথম সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। প্রায় ২১২ টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা উত্তম বিভিন্ন ভাবে নিজেকে পর্দায় হাজির করতে ভালোবাসতেন। ‘নায়ক’, ‘বিচারক’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘সপ্তপদী’ সহ আরো অনেক কালজয়ী সিনেমা উত্তমকে পরিচয় করিয়ে দেয় মহানায়ক হিসেবেই।

বাঙালি জীবনের এমন কোনো চরিত্র চিত্রণ নেই, যেখানে আমরা উত্তম কুমারকে পাইনি। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির এই মানুষটি কখনো ধুতি, কখনো ট্রাউজার, কখনো স্যুট, কখনো পাঞ্জাবি আবার কখনো বা গ্রামবাংলার আটপৌরে রূপে যেন বহুরূপী। অরুণ কুমার চ্যাটার্জি থেকে জীবন-সংগ্রামে ক্রমাগত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উত্তম কুমার হন তিনি।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

উত্তম কুমার এবং সুপ্রিয়া দেবী।

উত্তম কুমারের খুব ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ ছাড়া কেউই প্রায় জানতেন না শুটিং চলার ফাঁকে ফাঁকে উত্তম কুমার লিখছিলেন তার আত্মজীবনী। একজন মহান অভিনেতা তার আত্মজীবনী লিখবেন এটা অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু পিলে চমকানোর মতো ঘটনা ছিলো অন্য। তার মৃত্যুর দিনেই উধাও হয়ে যায় তার আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিটি। তার মৃত্যুর বহু পরে খুঁজে পাওয়া যায় সেটি। পরে প্রকাশ করা হয় বই আকারে। বইয়ের নাম ‘আমার আমি’। এই বইয়ে রয়েছে অনেক না জানা ঘটনা, আছে বন্দরের কেরানি অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের উত্তম কুমার হয়ে ওঠার গল্প। আছে তার সংগ্রাম, সাফল্য, ব্যর্থতা, সম্পর্ক, পরিবার এসব নিয়ে অনেক কথা। খুব বেশিভাবে এ বইজুড়ে রয়েছে এক অভিনেতার একাকীত্বের কথাও।

উত্তম অভিনীত অনেক সিনেমাই হয়তো মেলোড্রামাটিক কিংবা বিশ্বমানের নয়। কিন্তু তিনি আন্তর্জাতিক মাপেও অসামান্য অভিনেতা ছিলেন। ‘স্পেল বাউন্ডে’ গ্রেগরি পেকের অভিনয়ের সঙ্গে তুলনায় ‘হারানো সুরে’ উত্তমের অভিনয় কোনো অংশে নিচু মানের নয়। ‘ওগো বধূ সুন্দরীতে’ তিনি কোথাও কোথাও ‘মাই ফেয়ার লেডি’র রেক্স হ্যারিসনকেও অতিক্রম করে গেছেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ধারা পাল্টে দেন। লাউড অভিনয়ের ধারা পাল্টে তিনি আন্ডারটোন এবং স্বাভাবিক অভিনয়ের ধারার সূচনা করেন। বাস্তব জীবনে মানুষ যেভাবে হাঁটা-চলা, কথা-বার্তা বলে তিনি ক্যামেরার সামনে তাই করতেন।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

সন্যাসী রাজাতে উত্তম কুমার।

উত্তম কুমার ছিলেন বাঙালির প্রাণের নায়ক। স্বাভাবিক অভিনয় এবং নায়কোচিত গ্ল্যামার তার মধ্যে মিশেছিল সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার দৈহিক সৌষ্ঠব, সুন্দর চেহারা এবং অনাবিল হাসি। তবে শুধু রোমান্টিক নায়ক নয় অনেক ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তম যা তাকে অভিনেতা হিসেবে সার্থক প্রমাণিত করেছে। ধরা যাক অষ্টাদশ শতকের ফিরিঙ্গি কবি অ্যান্টনির কথা। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। এখানে তার বিপরীতে ছিলেন তনুজা। একজন কবির আবেগ, হতাশা, যন্ত্রণা, কবির লড়াইয়ে উত্তেজনা সবই সার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন উত্তম। কিংবা ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবির উন্মত্ত যুবক থিরুমলের কথা বলা যায়। যেখানে তার বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় গৃহভৃত্য রাইচরণের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন উত্তম। বিমল মিত্রের উপন্যাস নিয়ে ‘স্ত্রী’ ছবিতে লম্পট অথচ সরলমনা জমিদারের চরিত্রেও তিনি অনন্য। তিনি এখানে খলনায়ক হয়েও প্রধান ভূমিকায়। নায়কের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘বিচারক’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। বিচারকের মনোজগতের দ্বন্দ্ব সার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরেন তিনি।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

হাসি ঠাট্টায় উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন।

‘মায়ামৃগ’ সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেও দৃষ্টি কেড়ে নেন। ‘শেষ অংক’ ছবিতে তিনিই যে স্ত্রীর হত্যাকারী এ বিষয়টি দর্শককে চমকে দেয়। ‘সপ্তপদী’তে ফাদার কৃষ্ণেন্দ, ‘অগ্নিশ্বর’ ছবির চিকিৎসক, ‘নিশিপদ্ম’ ছবির মাতাল, ‘থানা থেকে আসছি’র ইন্সপেক্টর, ‘দেবদাসে’র চুনিলাল এসব চরিত্র নায়ক উত্তমকে নয় বরং অভিনেতা উত্তমকে তুলে ধরে। ‘আমি, সে ও সখা’ ছবিতে ডাক্তার সুধীরের ভূমিকায় তার অভিনয়ও ছিল অসাধারণ।

সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন দারুণ মানানসই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘গৃহদাহ’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘কমললতা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথের দাবী’ ও ‘বড়দিদি’তে তিনি নায়ক চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন। এর মধ্যে পাঁচটিতেই তিনি জুটি বেধেছিলেন সুচিত্রা সেনের সঙ্গে।

আরো পড়ুন
অন্য উত্তম

উত্তম কুমার তার রোমান্টিক ইমেজের বাইরেও সিনেমায় চরিত্রের বৈচিত্রের জন্য সব মহলে প্রশংসিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ নভেম্বর একই সিনেমার জন্য গ্রেটেস্ট এক্টর ‘মহানায়ক’ পদক জিতেন। এরসাথে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এওয়ার্ড পেয়েছিলেন ৮ বার। ভারতীয় চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

উত্তম কুমার ২০২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ৩৯টি ছবি ব্লকবাস্টার হিট, ৫৭টি সুপারহিট  ও ৫৭টি ছবি ব্যবসা সফল হয়েছে। শক্তি সামন্ত পরিচালিত উত্তম অভিনীত হিন্দি ছবি ‘অমানুষ’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ সুপারহিট হয়। এ দুটি ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় ছিলেন অসাধারণ। ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সে বছর (১৯৬৭) তিনি সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬১ সালে ‘দোসর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যও সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ‘হারানো সুর’, ‘হ্রদ’, ‘সপ্তপদী’, ‘নায়ক’, ‘গৃহদাহ’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘অমানুষ’, ‘বহ্নিশিখা’ ছবির জন্য ৮ বার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার লাভ করেছেন।

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

বাংলা সিনেমার আরেক কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ও ‘ চিড়িয়াখানা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন। ‌’ অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্যও তিনি জাতীয় পুরষ্কার পান। এছাড়া তিনি নিউইয়র্ক, বার্লিন চলচ্চিত্র প্রভৃতি সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবের অতিথির সম্মানও অর্জন করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে উত্তম কুমার অভিনেতা থেকে প্রযোজক হয়ে ‘হারানো সুর’ চলচ্চিত্রটির জন্য রাষ্ট্রপতি ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’ সম্মান পায়।

উত্তম কুমারকে নিয়ে অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী বলেন ‘‘এ রকম খাঁটি বাঙালি আমি কম দেখেছি। আমি নিজে ধুতি পাঞ্জাবি, কালোজিরে দিয়ে পারশে মাছের ঝোল, ঘরে পাতা দই, এ সবই পছন্দ করি। তবু বলব উত্তমদার মতো এমন ভাবনাচিন্তায়, হাঁটাচলায়, কথাবার্তায়, খাওয়াপরায় বাঙালি আমি বোধহয় কোনদিন হয়ে উঠতে পারব না।’’

আরো পড়ুন
অলোকসুন্দর উত্তমকুমার

গুণি অভিনেতা উত্তম কুমারকে নিয়ে সৌমিত্র বলেন, ‘‘অনেকেই ভাবেন আমি উত্তম কুমারের অভিনয়ের তীক্ষ্ম সমালোচক। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। ওঁর মতো বড় মাপের অভিনেতা আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। আমি ওঁর অভিনয়ের ভক্ত, গুণমুগ্ধ। আসলে কিছু ছবিতে ইমেজসর্বস্ব অভিনয়ে দেখে এই ভেবে ব্যথা পেয়েছি, এই হ্যাংওভারটা কাটিয়ে উঠতে পারলে ওঁর অভিনয়ের মাত্রা কোন্ জায়গায় গিয়ে পৌঁছোত। দুঃখটা পেয়েছি একজন গুণমুগ্ধ হিসেবেই। সমালোচনা করেছি উত্তমকুমারের অভিনয়ের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আছে বলেই।’’

বাঙালীর মহানায়ক উত্তম

সপ্তপদী ছবিতে উত্তম সুচিত্রা।

বাংলা চলচ্চিত্রে প্রতিভাবান অভিনেতার অভাব নেই। কিন্তু মহানায়ক একজনই। তিনি উত্তম কুমার। হয়তো সে কারণেই সত্যজিৎ রায় তার ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রে সাধারণ তরুণ থেকে চিত্রনায়ক হয়ে ওঠা অরিন্দম চ্যাটার্জির ভূমিকায় উত্তম ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারেননি। উত্তম কুমার তার অভিনয়, নায়কোচিত সৌষ্ঠব ও তারকাদ্যূতিতে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করে আছেন। ভুবনভোলানো হাসির এই মহা মানবটি আমাদের ছেড়ে ২৪ জুলাই ১৯৮০, রাত ০৯ টা ৩০মিনিটে, বেলভিউ ক্লিনিক, কলকাতা থেকে চির বিদায় নেন। তার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন আমাদের মহানায়ক হয়ে।

আত্মজীবনীতে মহানায়ক উত্তম লিখেছিলেন, “আমার হৃদয় জানে”- এই আলো এই ঔজ্জ্বল্য কিছুই একদিন থাকবে না। এই আলো একদিন নিভে যেতে পারে, আমাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে গভীর অন্ধকারে’। তিনি আজ নেই। কিন্তু ম্লান হয়নি তার স্মৃতি। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বাঙালির ‘মহানায়ক’ হয়েই।

বাঙালীয়ানা/টিএইচ

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.