শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অমর কাব্যশিল্পী। পল্লী জীবন, পল্লী সমাজ, পল্লীর মানুষের মনকে তিনি কলমের আঁচড়ে তুলে এনেছেন তাঁর রচনায়। পল্লী মানবের মানস ও ব্যক্তিত্ব পল্লীর সংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার আঘাতে কতটা রক্তাক্ত হতে পারে তারই রূপায়ণ তাঁর গল্প ও উপন্যাস।

বর্মার রেঙ্গুনে (১৯০৩-১৯০৬) বর্তমানে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতী পত্রিকায় তাঁর উপন্যাস ‘বড়দিদি’ প্রকাশিত হয়। এটি বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। অবশ্য ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে রেঙ্গুন যাওয়ার আগে তিনি কলকাতার বৌ বাজারে বসবাসরত গিরিন মামার অনুরোধে গল্প লিখে কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন। ‘মন্দির’ নামের গল্পটির লেখক হিসেবে তিনি নিজের নাম নয় মামা ‘সুরেন্দ্রনাথ’ এর নাম দিয়েছিলেন। দেড়শ’ গল্পের মধ্যে ‘মন্দির’ সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয় এবং কুন্তলীন পুস্তিকামালায় প্রকাশিত হয় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দেই। সে মতে ‘মন্দির’ শরৎচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত রচনা।
শরৎচন্দ্র লেখালেখির প্রেরণা উত্তরাধিকারসূত্রে তার পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। যখন তিনি স্কুলের নিচের ক্লাসে পড়তেন সে সময় স্কুলের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তার পিতার আলমারির দেরাজ খুলে গল্পের বই বের করে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন।
নিজেই বলছেন- ‘পিতার কাছ থেকে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্য-অনুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি। পিতৃপ্রদত্ত প্রথম গুণটি আমাকে ঘরছাড়া করেছিল। আমি অল্প বয়সে সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছি আর দ্বিতীয় গুণটির ফলে জীবনভর কেবল স্বপ্ন দেখেই গেলাম’।
১৮৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শরৎচন্দ্র যখন মাত্র ১৭ বছর বয়সে পদার্পণ করেন তখন তিনি কলকাতার দেবেন্দ্রপুরে বাস করতেন। তিনি তখন হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের ছাত্র। এসময়েই তিনি ‘কাকবাসা’ লেখেন যা তার লেখা প্রথম গল্প অবশ্য পরে গল্পটি নিজেরই পছন্দ হয়নি বলে তা ছিঁড়ে ফেলে দেন।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে চাকরি করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা, গান-বাজনা এবং সাহিত্য চর্চাও করতেন। এখানে তিনি বার্নাড ফ্রি লাইব্রেরী নামের একটি লাইব্রেরীতে পড়তেন। প্রায়দিন তিনি অফিসের পর লাইব্রেরীতে চলে যেতেন এবং অনেক রাত অবধি সেখানে পড়াশোনা করতেন। বই বাড়ীতে এনেও পড়তেন।
মিস্ত্রি-পল্লীতে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারী তাঁর কাঠের বাড়ীর নিচতলায় আগুন লাগে। আগুনে তাঁর কয়েকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও লাইব্রেরীসমেত বাড়ীটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সে বছরে অক্টোবর মাসে তিনি এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। তখন তাঁর পরিচয় হয় যমুনা সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ পালের সঙ্গে। তাঁর অনুরোধে রেঙ্গুনে ফিরে তিনি তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পটি পাঠিয়ে দেন। গল্পটি ১৩১৯ সালের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হলে শরৎচন্দ্র এই গল্প লিখেই একজন শক্তিধর লেখক হিসেবে সাহিত্যিক ও পাঠক মণ্ডলে পরিচিত হন। ইতোপূর্বে ১৩১৪ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের ‘বড়দিদি’ প্রকাশিত হয়েছিল। সে গল্প পড়ে রবীন্দ্রনাথও তাঁকে প্রতিভাবান লেখক বলে বুঝেছিলেন। ‘রামের সুমতি’ প্রকাশিত হলে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি ‘ভারতবর্ষ’ এবং ‘সাহিত্য’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতে থাকেন। তখন ভারতবর্ষ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স তাঁর বইও প্রকাশ করতে শুরু করেন। অবশ্য যমুনা-সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথই প্রথম তাঁর ‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন।

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র হঠাৎ দুরারোগ্য পা-ফোলা রোগে আক্রান্ত হন। তখন তিনি রেঙ্গুনের চাকরি ছেড়ে সস্ত্রীক দেশে চলে আসেন। হাওড়ায় থাকাকালীন শরৎচন্দ্র তাঁর বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাই ওই সময়টাকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। হাওড়ায় থাকাকালীনই শরৎচন্দ্রের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম-সাক্ষাত পরিচয় হয়। পরিচয় হয়েছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতেই বিচিত্রার আসরে। পরে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন প্রয়োজনে তিনি শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকোয় কবির কাছে গিয়েছেন। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল।
রেঙ্গুনে শরৎচন্দ্র শহরের উপকণ্ঠে বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে থাকার সময় তিনি শান্তি দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের একটি পুত্র সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু পুত্রের এক বছর বয়সের সময় প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও শিশু পুত্র দুজনেরই মৃত্যু হয়। পরে তিনি রেঙ্গুনেই হিরণ্ময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। হিরণ্ময়ী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেই শরৎচন্দ্র সুখে দিন কাটিয়েছেন।
হুগলী জেলায় দেবানন্দপুর গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২৮৩ সালের ৩১ ভাদ্র) শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। অভাব-অনটনের কারণে বিহারের ভাগলপুরের মামাবাড়ীতে চলে আসে তাঁর পরিবার। তাঁর কিশোর ও প্রথম জীবন কাটে এই ভাগলপুরেই। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি দেবানন্দপুরের হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল ও ভাগলপুরের দুর্গাচরণ স্কুলে অধ্যয়ন করেন। তারপর জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর ওই একই কলেজে এফএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু দারিদ্রের কারণে তাঁর শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
ছোটগল্প
মন্দির (১৯১৪)
পরিণীতা (১৯১৪)
বিন্দুর ছেলে (১৯১৪)
রামের সুমতি (১৯১৪)
পথ-নির্দেশ (১৯১৪)
মেজদিদি (১৯১৫)
আধাঁরে আলো (১৯১৫)
দর্পচূর্ণ (১৯১৫)
বৈকূন্ঠের উইল (১৯১৬)
অরক্ষণীয়া (১৯১৬)
নিস্কৃতি (১৯১৭)
কাশীনাথ (১৯১৭)
স্বামী (১৯১৮)
ছবি (১৯২০)
বিলাসী (১৯২০)
মামলার ফল (১৯২০)
মহেশ (১৯২৩)
হরিলক্ষী (১৯২৬)
অভাগীর স্বর্গ (১৯২৬)
অনুরাধা (১৯৩৪)
সতী (১৯৩৪)
পরেশ ( ১৯৩৪)
অনুরাধা (১৯৩৪)
সতী (১৯৩৬)
পরেশ (১৯৩৬)