ঢাকা শহরে যানজট কি দেশ উন্নত হওয়ার স্বাক্ষর নাকি অশিক্ষার। অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন

Comments

ঢাকা শহরের যানজটের একটি বড় কারণ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা এবং রাস্তার স্বল্পতা। মানুষ কেন ব্যক্তিগত গাড়ি কেনে? মানুষ বাধ্য হয়ে অনেকেই কেনে আবার কেউ কেউ “আমি কত ধনীরে” ভাব দেখানোর জন্য গাড়ি কেনে। যাদের স্কুলে যাওয়ার মত সন্তান আছে সে জানে সন্তানকে স্কুলে আসা-নেওয়ার জন্য কি পরিমান ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ এই ঢাকা শহরে বাচ্চাদের নিয়ে ওঠার মত মানসম্মত কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। এখন উবার আসায় কিছুটা রক্ষে কিন্তু উবারে দৈনিক তিনচারবার আসা-যাওয়ার মত আর্থিক সামর্থ অধিকাংশ মানুষের নেই। তার প্রমাণ ঢাকা শহরে যেইদিন স্কুল বন্ধ থাকে সেইদিন ট্রাফিক জ্যাম অনেক কমে যায়।

ব্যক্তিগত গাড়ি কেন বেশি? অধিকাংশ ছেলেমেয়েকেই নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকার স্কুলে যেতে হয়। কারণ মানসম্মত স্কুলের স্বল্পতা। ফলে যেকোন মূল্যেই হউক সন্তানকে সেরা স্কুলে পাঠাতে চায় সবাই। সেই জন্য সন্তানকে যদি দিনে চার ঘন্টা রাস্তায় কাটাতে হয় তবুও। যেমন আমার জানা মতে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুলে কেরানীগঞ্জ থেকেও ছেলেমেয়েরা আসে। স্কলাস্টিকা উত্তরায় ধানমন্ডি থেকে যায়। এইরকম আরো উদাহরণ দেওয়া যাবে। আমাদের এমপি বা এলাকার রাজনৈতিক নেতারা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে ঢুকে মফস্বলের প্রায় সকল স্কুলের মান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে সরকারি কর্মকর্তারা এখন আর পরিবার পরিজন নিয়ে মফস্বলের কর্মস্থলে থাকেন না। স্ত্রী সন্তানরা বাসা ভাড়া নিয়ে ঢাকায় থাকে আর উনি সপ্তাহের চার/পাঁচ দিন কর্মস্থলে থাকেন। স্ত্রী সন্তান ঢাকায় থাকেন কারণ তাদের সন্তানরা ঢাকার ভালো স্কুলে পড়ে। মফস্বলের অনেক সচ্ছল পরিবারও একই কাজ করে। শুধু স্কুল কলেজের জন্য কি পরিমান যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে তার একটি গবেষণা করে দেখা যেতে পারে।

ঢাকা শহরের যানজটের আরেকটা অন্যতম কারণ রিকশা। এইরকম একটি ব্যস্ত শহরের রাস্তায় রিকশা এবং বাস/গাড়ি এক সাথে চলতে পারে না। রিকশার কারণে ঢাকা শহরে চলাচলরত সমস্ত গাড়ির শরীরে আঁচড় লাগানো যা দেখতে খুবই দৃষ্টি কটু। রিকশার জন্য সৃষ্ট যানজটের কারণে ভালোমানের বাস নামাতে অনেক বড় বড় কোম্পানি উৎসাহ বোধ করে না কারণ এতে বিশাল পরিমান টাকার লগ্নি উঠে আসার সম্ভবনা কম।

ঢাকা শহরের যানজটের কারণ মিস-ম্যানেজমেন্ট। কোন প্রকার নিয়মনীতির ভিতর দিয়ে এই শহর চলে না। এই শহরের মানুষের টাকা হয়েছে বটে কিন্তু সঠিক শিক্ষা আসেনি ফলে সিভিক সেন্স নেই বললেই চলে। আজ পর্যন্ত একটি কোম্পানির আন্ডারে সমন্বিত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালু করা গেল না। দুই চারটা বাস নিয়ে একটি কোম্পানি। পৃথিবীর কোথায় আছে? লোকসংখ্যার দিক থেকে এত বড় একটি নগরী কিন্তু নগরীর ট্রাফিক সিস্টেম এখনো প্রিমিটিভ ব্যবস্থায় চলছে অর্থাৎ এখনো গাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা ইশারায়। কি আশ্চর্য!

উন্নত যদি হয়ে থাকি তাহলে ওই বাড়তি টাকা কেন একটি ভালো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা তৈরী করা হয় না? হয় না কারণ এর ফলে টোল বাণিজ্য, চাঁদা বাণিজ্য, ইজারা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একটি শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা দিয়ে ওই দেশের মানুষ তথা সরকারের মানের ইনডেক্স হতে পারে। একটি শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা অসভ্য হওয়া মানে ওই শহরের মানুষগুলা এখনো সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না। মানে হলো নেতা নেত্রীদের মান ভালো না। ট্রাফিক জ্যামের সাথে মানুষের সময়, স্বাস্থ, আয়ু, টাকা, কাজ, কাজের মান, পরিবেশ ইত্যাদি অনেক কিছু সম্পৃক্ত। ছেলেমেয়েরা খেলার সময় পেত! তাই এটাকে অবহেলা করা মানে সমস্যার গভীরতা বোঝার দূরদৃষ্টিহীনতার পরিচয় বহন করে।

 

 

লেখক পরিচিতি:

অধ্যাপক কামরুল হাসান

 

 

অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

 

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.