বিজেপির দ্বৈতনীতি, পরিবর্তন হবে না ৩৭১ ধারা

Comments

।। বিশেষ প্রতিবেদন ।।

জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করা হলেও সংবিধানের ৩৭১ ধারকে মোদী সরকার ছুঁয়েও দেখবে না বলে জানিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, উত্তর-পূর্ব পরিষদের (এনইসি) ৬৮ তম প্লেনারী সেশনে অমিত শাহ ৩৭১ ধারা প্রত্যাহার না করার প্রসঙ্গে বলেন, ‘এর আগে সংসদেও বলেছি এমনটা এখানে হবে না। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ৮ জন মুখ্যমন্ত্রীর সামনে আবার বলছি, দুটি ধারা আলাদা। ৩৭১ ধারা ছুঁয়ে দেখবে না কেন্দ্র।’

এই ধারায় উত্তর-পূর্বের নাগরিকদের বিশেষ কিছু সুবিধে দেওয়া আছে। অথচ ‘এক দেশ এক নীতি’ স্লোগান তুলে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের কথা বলেছিল মোদী সরকার। নিজেদের দ্বৈতনীতি আড়াল করতে অমিত শাহ এদিন দাবি করেন ৩৭০ ধারার প্রকৃতি একেবারেই সাময়িক। এই দুই ধারার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে বলে জানালেন অমিত শাহ বলেন, ‘আমি পরিষ্কার করে বলছি ৩৭১ ও ৩৭১ (এ) এই দুই ধারাকে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও বিজেপি সরকার উভয় মর্যাদা দিয়ে থাকে।’

ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩৭১ ধারায় উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নাগরিকদের বিশেষ সুবিধে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারী থেকে ভারতীয় সংবিধানের অংশ হয়ে রয়েছে ৩৭০ ধারা এবং ৩৭১ ধারা। তবে ৩৭১ এ থেকে এইচ এবং ৩৭১ জে ধারা পরবর্তীতে ৩৬৮ নং অনুচ্ছেদের আওতায় সংশোধনী বলে গৃহীত হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। ৩৭১ ধারা বলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৮টি রাজ্য সহ ১১টি রাজ্যের বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা রয়েছে।

মোদী সরকার ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করার পরপরই ৩৭১ ধারার বিষয়েও পদেক্ষেপ নেওয়ার কথা আলোচিত হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। এই প্রসঙ্গে অমিত শাহ অভিযোগ করেন, জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর উত্তর-পূর্বের রাজ্যের নাগরিকদের ভুল তথ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবার ৩৭১ ধারাও বাতিল করে দেবে কেন্দ্র। যারা এই অঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়ন চায় না তারাই এই কাজ করছে বলে অভিযোগ করেন অমিত শাহ।

Amit Shah

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ

পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যেই এনআরসি’র কাজ শেষ হবে। একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকেও দেশে থাকাতে দেওয়া হবে না বলেও এদিন হুমকি দিয়েছেন শাহ।

বিজেপি বিরোধীরা বলছেন, ৩৭০ ধারায় জম্মু ও কাশ্মীরে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। এই মর্যাদার ভিত্তিতেই স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কাশ্মীর। কিন্ত ৩৭০ ধারা বাতিলের দাবি তুলে এক দেশে আলাদা আলাদা নীতি থাকবে কেন? কেনই বা জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে? এমনই প্রশ্ন তুলে প্রচার চালিয়েছিল আরএসএস-বিজেপি সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। জম্মু ও কাশ্মীরে প্রধানত মুসলিম নাগরিকদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ৩৭০ নম্বর ধারা চালু রেখে মুসলিম তোষণের অভিযোগও করা হয়েছে গেরুয়া শিবির থেকে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই সমাজে গভীর ধর্মীয় বিভাজন টানতেই এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। অথচ ৩৭০ ধারায় যে যে সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল তার অধিকাংশই গত ৬৯ বছরের এক এক করে তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৩৭০ নম্বর ধারা ছিল জম্মু ও কাশ্মীরবাসীর স্বাধিকার ও মর্যদার বিষয়। অথচ সেখানকার মানুষের মত না নিয়ে, সেখানকার জনপ্রতিনিধিদের বন্দি করে রেখে, কাশ্মীর উপত্যকাকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে একতরফাভাবে সংসদে সংখ্যাধিক্যের জোরে এই ধারা প্রত্যাহার করে জম্মু ও কাশ্মীরকে টুকরো টুকরো করে মোদী সরকার। মোদী সরকারের এই পদক্ষেপের পরপরই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলিও স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে সোচ্চার হয়। অথচ ৩৭০ ধারা যেমন কাশ্মীরকে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে জুড়েছিল। ঠিক সেইভাবেই উত্তর-পূর্বের ছোট ছোট আদিবাসী প্রধান রাজ্যগুলিকে আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য মর্যদা দিয়ে তাকে রক্ষা করতে ৩৭১ ধারায় বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যার ভিত্তিতেই ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে এদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের এই রাজ্যগুলিকে। ৩৭০ এবং ৩৭১ ধারা নিয়ে মোদী সরকারের দ্বিমুখী ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্নে উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

এদিকে সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, গুয়াহাটিতে নেডা-র (নর্থ-ইস্ট ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স) চতুর্থ অধিবেশনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানালেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আসবেই। কিন্তু তার জেরে কোনও রাজ্যের নিজস্ব আইন বা জনজাতির অধিকার খর্ব হবে না। কেন্দ্র আসাম থেকে অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ালেও তারা পাশের রাজ্যে ঢুকে বাঁচতে পারবে না।

এ প্রেক্ষিতে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা বলেন, “মেঘালয়ে নিজস্ব আবাসিক সুরক্ষা আইন আছে। তিন রাজ্যে আইএলপি রয়েছে। আছে ষষ্ঠ তফশিলের সংরক্ষণ। রাজ্যের আইন ও স্থানীয় জনজাতির অধিকার খর্ব করে যদি কেন্দ্রীয় আইন চাপানো হয়, তা নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। আসামের এনআরসি-ছুটরা মেঘালয়ে ঢুকতে থাকলেও বিপদ।”  একই আশঙ্কা জানান, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীরাও। মিজো মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলেন, কেন্দ্র একতরফা কিছু করলে জনসংখ্যার বিন্যাসে বদল আসবে। প্রতিবাদ হবে।

উত্তরে অমিত আশ্বাস দেন, কোনও অনুপ্রবেশকারীকে আসাম থেকে পালিয়ে পাশের রাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ৩৭১ অনুচ্ছেদ উত্তর-পূর্বের স্থায়ী ও বিশেষ ধারা। তা বজায় থাকবেই। রাজ্যগুলিতে জনজাতিদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে ষষ্ঠ তফসিল ও স্থানীয় আইনে হাত পড়বে না। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরকে ভিত্তি তারিখ রেখে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আনা হবে। তারপরে ভারতে ঢোকা কেউ নাগরিকত্ব পাবে না। নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া কেউ ইনারলাইন আইনের আওতায় থাকা রাজ্যে বাড়ি কিনতে বা স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারবে না।

মুখ্যমন্ত্রীরা জানিয়েছেন, নিজের রাজ্যে ফিরে সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই ফের তারা বৈঠকে বসবেন।

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.