বিতর্ক: শাড়ী । শিশির ভট্টাচার্য্য

Comments

তোমার হলো শাড়ি, আমার হলো সাড়া!

১.
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের এক মন্ত্রী সগর্বে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তরুণ সমাজের বখে যাওয়া রুখতে এবং উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠনের লক্ষ্যে সব পর্ণোসাইট নাকি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। সপ্তাহ কয়েক আগে বাংলাদেশের কোনো এক শহরে এক পুলিশ কর্মকর্তা নাপিতদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তরুণ খদ্দেরদের মাস্তান টাইপ চুলের কাট না দিতে। অন্য এক উপজেলায় এক ক্ষমতাবান ব্যক্তি স্কুলে ঢুকে বেশ কিছু ছাত্রের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছেন। মনে পড়ছে, সত্তরের দশকে রক্ষীবাহিনী প্রথম এই কুন্তল-সংস্কারের অত্যাচার করে সবার বিরাগভাজন হয়েছিল। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের এক ধর্মগুরু বলেছিলেন, মেয়েরা হচ্ছে তেঁতুল, কারণ তাদের দেখলেই নাকি জিভে জল আসে। অতি সম্প্রতি শাড়ি ও নারী শরীর নিয়ে এক নিবন্ধ লিখে সামাজিক গণমাধ্যমে সমালোচনার মুখে পড়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

মনে হতে পারে, এসব ঘটনা একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কহীন, কিন্তু অন্তর্লীন স্তরে এগুলো একই পিউরিটান ‘পদিপিসি’ ব্যাধির ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ মাত্র। পদি পিসি স্বাভাবিক কোনো মানব-প্রবৃত্তি বরদাস্ত করতে পারেন না, তাঁর সব কিছুতে ছিছি। যার নামে এই ব্যাধি তিনি মরে পেত্নি হয়েছেন বহুযুগ আগে, কিন্তু এই সংক্রামক ব্যাধিটি বাংলাদেশের মন্ত্রী, পুলিশ, ধর্মগুরু, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, নারীবাদী কর্মী, নাট্যকর্মীসহ অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। এই রোগের মূল কারণ সম্ভবত যৌন অবদমন, কারণ পদিপিসিরা সাধারণত বালবিধবা হতেন। বিখ্যাত কমিক বুক লেখক অ্যালান মুর লিখেছেন: “যৌনভাবনার দিক থেকে অগ্রসর সংস্কৃতিগুলো আমাদের দিয়েছে অংক, সাহিত্য, দর্শন, সভ্যতা ইত্যাদি আর যৌন অবদমনমূলক সংস্কৃতি থেকে আমরা পেয়েছি অন্ধকার যুগ, গণহত্যা ইত্যাদি।” ওঁর কথার প্রমাণ ইতিহাসে খুঁজলেই পাবেন। বাঙালি মানসের অন্যতম প্রধান সমস্যা যৌন অবদমন, যার মানে হচ্ছে বাঙালির কপালে দুঃখ আছে, হ্যাঁ আরও বহু দিন।

২.
চর্যাপদে আছে: ‘রুক্ষের তেন্তলি কুম্ভীরে খাই’ অর্থাৎ গাছের তেঁতুল কুমিরে খেয়ে নেয়। কুমির নামক প্রাণীটির অন্য যত দোষই থাক, তেঁতুল তার ভক্ষ্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশ এক অদ্ভুত দেশ। এখানে কুমিরে তেঁতুল খায়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফ্যাশন-বিষয়ক নিবন্ধে অশ্লীলতার উপাদান খুঁজে পান, অশীতিপর বৃদ্ধ অধ্যাপক শাড়ি নিয়ে এক অনবদ্য নিবন্ধ ফেঁদে বসেন, যার সমালোচনায় মুখর হয় শাড়ির একমাত্র ভোক্তা নারীরাই। এক নারীবাদী সমাজকর্মী লিখেছেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লুংগি নিয়ে লেখা উচিত ছিল, কারণ তিনি শাড়ির কী বোঝেন! ওঁর মতো এক ব্যক্তিত্ব কোন বিষয় নিয়ে লিখবেন বা লিখবেন না, তা আরেকজন ঠিক করে দেবেন। বুদ্ধির ঢেঁকি আর কাকে বলে!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রথম দাবি: শাড়ি যৌনাবেদনপূর্ণ শালীন পোষাক। ‘শালীন’ শব্দটা নিয়ে কেউ আপত্তি করবেন না হয়তো কিন্তু ‘যৌন’ শব্দটা শোনামাত্র যারা হাঁহাঁ করে উঠেন, তারাও নিশ্চয়ই জানেন যে এই যৌনাবেদন প্রকৃতির সৃষ্টি – স্বাভাবিক, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারীর মনে এই আবেদন থাকেই। যৌনাবেদনের লক্ষ্য নারীপুরুষকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং বংশবৃদ্ধি হওয়া। যৌনাবেদনকে খারাপ মনে করতেই পারেন কেউ, যুগে যুগে অনেকেই করেছেন। প্রকৃতির সব কিছুই কি ভালো? – সওয়াল করতে পারেন তাঁরা – সাপের ছোবলওতো একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তাতে কি প্রাণসংশয় হয় না? কিন্তু তার মানে কি এই যে, কখনও মানুষকে কামড়াতে পারে এই ভয়ে সব সাপের বিষদাঁত আগে থেকে তুলে নিতে হবে? খোদার উপর খোদকারী? একইভাবে যৌনাবেদনকে নিষিদ্ধ করা কিংবা শব্দটি শোনামাত্র ‘গেল, গেল’ রব তোলার অর্থ হচ্ছে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া।

৩.
নারী পুরুষকে আকর্ষণ করবে এবং পুরুষ নারীকে – এটাতো অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ শুধু নয়, প্রাণী জগতেও ব্যাপারটা আছে। পুরুষ পাখি কত বিচিত্র উপায়ে স্ত্রীপাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। যতদিন পর্যন্ত ডোমেস্টিক ইনকিউবেটরে সস্তায় ও অবলীলায় মানবশিশু পয়দা করা না যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষিত হওয়া অপরিহার্য। যৌনতা একটি শারিরীক-মানসিক প্রয়োজন। পর্ণোসাইট নিষিদ্ধ করে মন্ত্রীমহোদয় যে তরুণী-কিশোরীদের জীবন অধিককতর অনিরাপদ করে তোলেননি, সেই নিশ্চয়তাই বা কে দেবে? একইভাবে চুলের মাস্তানকাট না দিলেই কি দেশে মাস্তানী কমে যাবে? উধোর পিণ্ডি বার বার বুধোর ঘাড়ে দিতে থাকলে একদিকে উধোরা লাই পাবে এবং অন্যদিকে বুধোরা হতাশ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে।

নারীশরীর পুরুষের কাছে চিররহস্যময়। পুরোপুরি ঢেকে রাখা হলে সেই রহস্য বাড়ে ছাড়া কমে না। তবে কোনো পোশাক দেহের কোথায়, কতটুকু ঢাকছে, আর কোথায়, কতটুকু ঢাকছে না, নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বটে। অধ্যাপক সায়ীদের দ্বিতীয় দাবি: নারীশরীরকে কিছু কিছু জায়গায় অনাবৃত রাখলে তা ‘রহস্যচকিত’ হয়ে উঠে এবং পোষাক-জগতে একমাত্র শাড়িই এ কাজটা চমৎকারভাবে করতে পারে। ‘রহস্যচকিত’ শব্দের মানে কি ‘চকিতে অর্থাৎ হঠাৎ করে পুরুষকে নারীদেহের রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করা? ‘পথ চলিতে কভূ চকিতে যদি দেখা হয়, পরাণপ্রিয়।’ চকিত মানে হঠাৎ, সব সময় নয়। সব সময় আকর্ষণ করা হলে সেটা আর আকর্ষণ থাকে না, অভ্যাসে পরিণত হয়। অভ্যাস প্রেমের অন্যতম হত্যাকারী। অন্যদিকে ‘চকিত আকর্ষণ’ প্রেমের অন্যতম শৃঙ্গার বটে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, নজরুল-রবীন্দ্র সাহিত্যে, যে সাহিত্য মানসিকভাবে স্বাস্থ্যবান মানুষ সানন্দে উপভোগ করে থাকেন।

৪.
রাণী ভিক্টোরিয়ার আদেশ ছিল, প্রাসাদের সব চেয়ার ও টেবিলের পায়া কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকতে হবে, কারণ রাজভাষা ফরাসিতে টেবিল ও চেয়ার স্ত্রীলিঙ্গ এবং কোনো মেয়ের পা অনাবৃত থাকা উচিত নয়। তাঁর সময়ে সন্তান প্রসবের সময়ও মেয়েদের শরীর যতটা সম্ভব ঢেকে রাখতে হতো। ভিক্টোরিয়ান পিউরিটানিজমের চরম উদাহরণ এগুলো।

উপমহাদেশের লোকজন, বিশেষ করে লেখাপড়াজানা বাঙালির মস্তিষ্ক ভিক্টোরিয়ান ক্যাথলিক ভাবনায় ঠাঁসা। ক্যাথলিক ভাবনায় যৌনতা পাপ। শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নারীপুরুষ মিলিত হওয়া নিষিদ্ধ। ইসলাম এ ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উদার। ক্যাথলিক পঞ্জিকায় লেখা থাকতো, কোন কোন দিন স্ত্রী-সংসর্গ করা যাবে কিংবা যাবে না। বাংলা অঞ্চলে (লোকনাথ/নবযুগ ইত্যাদি) পঞ্জিকায় এখনো সম্ভবত লেখা থাকে, কোনদিন বেগুন বা পটল খেতে নেই কিংবা কোনদিন স্ত্রী নিষিদ্ধ। তবে বাঙালি কিংবা খ্রিস্টানেরা পঞ্জিকার এসব বিধিনিষেধ ঠিকঠাকমতো মেনে চললে পৃথিবীতে এত বাঙালি কিংবা ক্যাথলিক থাকতো না।

মুজতবা আলী তাঁর ‘চুম্বন’ নিবন্ধে যৌনতার প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কয়েকটি গল্প আছে সেই নিবন্ধে। একটি গল্পে বরোদার রাণী গেছেন প্রাসাদের যাদুঘর দর্শনে। সেখানে নগ্ন নারী ও পুরুষমূর্তি দেখে রাণী আদেশ দিলেন, মূর্তিগুলোর উর্ধাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গ গামছা দিয়ে ঢেকে দিতে। একদিন এক দেহাতি কৃষক দম্পতি এসেছে যাদুঘর দেখতে। পিছন পিছন হাঁটছেন আলীসাহেব। ‘হ্যাঁ গা, গত বছর যখন এসেছিলুম, তখনতো এই মূর্তিগুলোর বুকে-কোমড়ে গামছা দেখিনি!’ রাণীর আদেশের কথা তাঁদের জানানো হলো। আলী সাহেব শুনলেন, চুপিসারে স্ত্রীকে বলছেন কৃষক: ‘মহারাণীর পাপ মন!’
আরও একটি গল্প বলেছেন আলী সাহেব একই নিবন্ধে। নগ্ন নারীশরীরের এক চিত্র আঁকার অপরাধে অভিযুক্ত এক চিত্রকর আদালতে দাবি করলেন যে তাঁর চিত্রটি ‘ন্যাকেড’ নয় ‘ন্যুড’। তবে বিচারক চাইলে চিত্রটিকে তিনি ন্যাকেড করে দিতে পারেন। অনুমতি দেওয়া হলো। চিত্রকর নারীশরীরের একটি পা মোজা এঁকে ঢেকে দিলেন এবং দাবি করলেন যে এতেই ন্যুড চিত্রটি ন্যাকেড হলে গেল।

৫.
অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেছেন, অধ্যাপক সায়ীদ নারীকে পণ্য হিসেবে দেখেছেন। প্রথমত, কথাটা সত্য নয়। বিশেষ প্রয়োজনে নারী বা পুরুষ শরীরের বর্ণনা দিলেই নারী বা পুরুষ বস্তু কিংবা পণ্য হয়ে যায় না। অধ্যাপক সায়ীদের বক্তব্য কীভাবে সেক্সিস্ট বা রেপিস্ট হবে (যেমনটা বলেছেন মাসুদা ভাট্টি) তা আমি ভেবে পাই না। আসল জায়গায় চোখ বন্ধ করে যত্রতত্র সেক্স কিংবা রেপ দেখলে চলবে কেন?

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পুরুষ শিল্পিসাহিত্যিকেরা নারীশরীরের বর্ণনা দিয়ে আসছেন। নারীও পুরুষের শরীরের বর্ণনা দিক না কেন, বানাক না কেন পুরুষের মূর্তি, যেমনটা বানিয়েছে ভাষ্কর রোঁদ্যার প্রেমিকা ক্যামি ক্লদেল (প্যারিসের রোদ্যাঁ যাদুঘরে আছে এসব মূর্তি)। গ্রেকোরোমান, ভারতীয় ভাষ্কর্যে চমৎকার সব নারী ও পুরুষ শরীরের মূর্তি রয়েছে। এত ঢাক-ঢাক, গুড়গুড় কীসের জন্যে? মুজতবা আলী, পরিতোষ সেন নারী শরীরের দারুণ সব বর্ণনা দিয়েছেন। আপোলিন্যারের মতো নামীদামী ফরাসি লেখক যৌনসাহিত্য রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু, ইমদাদুল হক মিলন, সৈয়দ সামসুল হকের যৌনগন্ধী সাহিত্য পড়ে কি আমরা অনেকেই বেড়ে উঠিনি? কোনারক-ইলোরার ভাস্কর্য নগ্ন নারীশরীরের মূতি এবং মৈথুনদৃশ্যে সয়লাব। আমরা কামসূত্রের দেশের লোক, যারা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রায় নিরামিশ লেখা পড়ে হাঁরেরে করে তেড়ে আসছি, তাঁরা কি নিজেদের কৈশোর ও প্রথম যৌবনের কথা ভুলে যাচ্ছি?

দ্বিতীয়ত, পণ্য হলেই বা কী! পণ্য জিনিষটাকে খারাপভাবে দেখার অবকাশ নেই। দোকানে আমরা বিভিন্ন পণ্য যেমন সাজিয়ে রাখি, আমাদের জীবন ও ব্যক্তিত্বটাকেও আমরা সাজাই না কি? আমরা তথাকথিত প্রমিত উচ্চারণ শিখি, বিভিন্ন ডিগ্রি নিই, ভাষা শিখি, সুন্দর পোশাক পড়ি, মেক-আপ করি, ফ্যাশন ও যুগের দাবি মেনে চুল কাটাই, পোশাক বানাই। শাড়ি কিনি আমরা, শুধু কি কিনি, ফ্যাশনের দাবি মেনে কেনা শাড়িতে ডলার বসাই, হাজার বুটির কাজ করাই, লেস লাগাই, এম্ব্রয়ডারি করাই, জরি-চুমকির কাজ, ব্লক করাই, ম্যাচ করে ব্লাউজ-অলঙ্কার পরি, এক শাড়ি পড়ে একই বাড়িতে দুবার যাই না, আরও কত কী মেয়েমানুষী করি! প্রথমে দর্শনধারী, পরেতো গুনবিচারি। সাদেকা হালিম কিংবা কাবেরী গায়েন যে চমৎকারভাবে শাড়ি পড়েন, চমৎকার ভঙ্গীতে কথা বলেন, তা কি ব্যক্তিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে অপর বা (ইংরেজিতে) Other-এর পাতে দেবার প্রচেষ্টার অংশ নয়? মানুষ মাত্রেই Other ব্যাপারী। অধ্যাপক সায়ীদ তাদের জাহাজের খোঁজ দিয়ে ঝামেলাটা পাকিয়ে তুলেছেন।

৬.
ফরাসি দার্শনিক রোলঁ বার্থ পোষাককে ভাষার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রতিটি ফ্যাশন-একক হচ্ছে একেকটি দ্যোতক বা সিগনিফাইয়ার। শাড়ি একটি দ্যোতক (টীকা: আসলে ‘শাড়ি’ শব্দটা দ্যোতক, বাস্তবের শাড়িটা ‘নির্দেশিত’ বা বস্তু, যাক, এইসব সেমিওটিক জটিলতায় না যাই বরং)। এইসব দ্যোতক কিংবা সিগনিফাইয়ারের কোনো প্রয়োজন কি আছে, যদি না এর কোনো দ্যোতিত কিংবা সিগনিফাইড সৃষ্টি হয় দর্শকের মস্তিষ্কে, যদি না নিজেকে উপস্থাপনযোগ্য করে গড়ে তোলার ইচ্ছা করি আমরা অন্যের কাছে, এমনকি নিজের কাছেও।

কল্পনা করুন, আপনি একটা দ্বীপে আছেন, একা একটি মেয়ে। আপনি কি আদৌ আপনার পোশাক কিংবা মেকআপ নিয়ে চিন্তিত হবেন? কথাটা মেনে নিতে হয়তো কষ্ট হবে, কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই পণ্য অন্যের দৃষ্টিতে, এমনকি নিজের দৃষ্টিতেও। ঘরে কেন আয়না রাখি আমরা? কোনো অসুখ বা অ-সুখের কারণে চেহারাটা যখন খারাপ হয়ে যায়, শরীরটা ভেঙে যায়, তখন আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়, কারণ আমাদের নিজের চেহারা, নিজের শরীর নিজের কাছেই গ্রহণ-অযোগ্য হতে শুরু করে। ‘গ্রহণযোগ্য’ আর ‘বিক্রয়যোগ্য’ এই দুয়ের মধ্যে তফাৎ সামান্য। গ্রহণ আর ক্রয়ের মধ্যে তফাৎটা এই যে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একটা মূল্য ধরে দিতে হয়। ক্রয়যোগ্য হলে পণ্য, গ্রহণযোগ্য হলে ধন্য।

অধ্যাপক সায়ীদের তৃতীয় দাবি: নারীদেহে উঁচুনিচু ঢেউ আছে এবং শাড়ি এই বন্ধুর (উভয়ার্থে) শরীরকে এমনভাবে আবৃত করে যে ‘রূপের শরীরে এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল বয়ে যায়।’ ‘এমন ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে?’ শাড়ি যেন, অধ্যাপক সায়ীদের ভাষায়, নারীশরীরে জড়িয়ে থাকা এক ‘দীর্ঘ স্বপ্নখচিত জড়োয় গহনা।’ “আমাদের সোনালী ধানখেতগুলো যেমন গোটা বাংলাদেশকে নানা বাঁকে জড়িয়ে দেশজুড়ে বয়ে যায়, শাড়িও তেমনি নারীর সৌন্দর্যের প্রতিটি ঢেউ আর সরণিকে আঁকাবাঁকা, উঁচ-ুনিচু ভঙ্গীতে বিন্যস্ত করে আঁচলের কাছে এসে এক ঝাঁক সাদা পায়রার মতো নীল আকাশে উড়তে থাকে।” লেখক এখানে বাংলাদেশকে নারীদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন, শাড়িকে তুলনা করেছেন সোনালী ধানক্ষেতের সঙ্গে। শাড়ির আঁচল হয়ে উঠেছে এক ঝাঁক সাদা পায়রা যার পশ্চাৎপটে রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশ।

৭.
(অ)সাধারণ একটা পোশাক নিয়ে এমন অনবদ্য নিবন্ধ লেখার যোগ্যতা রাখেন, কিংবা এই বয়সে সাহসটুকু করেন, উভয় বাংলায় এমন কজন লেখক এখনও জীবিত আছেন? লেখা পড়ে সমালোচনাতো করাই যায়! চট্টগ্রামের কুমিরা গ্রামের ষাটের দশকের এক যাত্রার কথা মনে পড়ছে। স্টেজে রাজার ভূমিকায় ধীরেন্দ্রনাথ রায় নিজের পার্ট ভুলে গেছেন দেখে সামনে বসা বাচ্চারা কানাঘুসা করছিল: ‘ভুলি গেইয়ে, ভুলি গেইয়ে!’ দশাশই রাজামশাই (যিনি ছিলেন এলাকার প্রাক্তন জমিদার-জোতদার) স্টেজ থেকে বাচ্চাদের দিকে টিনের তলোয়ার বাগিয়ে বললেন: ‘-দানির পোয়া, তুই আই খছোনা চাই’ (অর্থ: ‘সান অফ এ বিচ, হোয়াই ডোন্ট ইউ কাম টু দি স্টেজ এ্যান্ড সে মাই ডাইলগস ইওরসেল্ফ?’)।

শাড়ি এবং নারিদেহের বর্ণনা দেওয়া যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদই প্রথম এই অপরাধ করেননি। ‘চলে নীল শাড়ি নিঙারি নিঙারি পরাণ সহিত মোর।’ অখিল বন্ধুর গাওয়া গান: ‘কেনগো পড়ো অমন চোখধাঁধানো জরিন শাড়ি। জানো না মিষ্টি চাঁপা রংটি তোমায় মানায় ভারি!’ কিংবা নজরুলের: ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল। কর্ণে দোলাবো দ্বিতীয় তিথির চৈতি চাঁদের দুল!’ ভাগ্য ভালো, এই সব কবি সাহিত্যিক লিখেটিখে ভূতপূর্ব হয়ে গেছেন। আজকের যুগে হলে পশ্চিমের আছর লাগা পদিপিসিরা তাঁদের জীবন বিষময় করে তুলতো।

৮.
অধ্যাপক সায়ীদ কাব্য লেখেননি, প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সঙ্গত কারণেই তাঁর লেখায় নারীদেহের মাপজোকের তথ্য এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির নারীদেহ কাঠামোর তুলনা করেছেন তিনি, তাঁর দৃষ্টিতে কোনোটা বিশাল, কোনোটা উদ্ধত, কোনোটা সুকুমারী লবঙ্গলতিকা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত এবং বাঙালি নারীদেহকাঠামোর তুলনা করেছেন। তিনি মনে করেন, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নারীদের শাড়িতে বেশি মানায় তাদের উচ্চতার কারণে। যে উচ্চতা শাড়ি পড়ার জন্য মানানসই, বেশির ভাগ বাঙালি নারীদেহের উচ্চতা সেই কাম্য উচ্চতার তুলনায় কয়েক ইঞ্চি কম। তাঁর মতে, বাঙালি জাতির মধ্যে শঙ্করায়নের মাত্রা বেশি হবার কারণে উত্তর ভারতের নারীদেহের সুষমতা বাঙালি নারীদেহে সাধারণত থাকে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।

নারী বা পুরুষদেহকে একটি রক্তমাংসের ভাষ্কর্য হিসেবেও দেখা যায়। গ্রীক ভাষ্কর্য প্রমাণসাইজ, কলাম্বিয়ান ভাষ্কর বোতেরোর শিল্পকর্ম সাধারণত বিশালকার। কিছুদিন আগে আমি ইরানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি ৯৯%ভাগ নারীপুরুষের শরীর সুষম, অনিন্দ্যসুন্দর। এই সৌন্দর্য, এই সুষমতা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখিনি। আমার এই অভিজ্ঞতার কথাটা আমি কি নারীবাতিকগ্রস্তদের ভয়ে চেপে যাবো?

৯.
অধ্যাপক সায়ীদের চতুর্থ দাবি, সব শরীরে সব পোশাক মানায় না এবং বাঙালি নারীকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে শাড়িতে। তিনি বিভিন্ন ধরনের পোষাকের তুলনা করেছেন, ধরা যাক, মিনিস্কার্ট বা টাইটজিন্সের সঙ্গে শাড়ি এবং কিমোনোর। মিনিস্কার্ট এবং জিন্স তাঁর দৃষ্টিতে পোশাক না পরারই সামিল। এর মানে হচ্ছে, অধ্যাপক সাঈদ শরীর ঢেকে রাখার পক্ষপাতী, তবে কতটা ঢাকতে হবে এবং কতটা অনাবৃত রাখতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত তিনি তুলে দিচ্ছেন শাড়ির হাতে। অধিকাংশ দেশের পোষাক, তাঁর মতে, নারীদেহকে হয় “রমনীয় গুদামঘর করে তোলে, নয়তো বিবসনা করে রগরগে যৌনতার মৌতাত উদযাপন করে।” শাড়ি এর কোনটাই করে না। রেখেঢেকে চকিত যৌনাবেদন সৃষ্টিতে অধ্যাপক সাঈদের আপত্তি নেই, কিন্তু রগরগে যৌনতায় আপত্তি আছে। এর মানে হচ্ছে, তিনিও মূলত সাবেকি ঘরানারই লোক, যারা তাঁর সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন, অনেকটা তাদের মতোই।

অধ্যাপক সায়ীদের পঞ্চম দাবি: শাড়ি একটি রহস্যময় পোশাক। “নারী দেহকে কতটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে। শাড়ি ছাড়া এমন জাদুকরি রহস্য আর পরস্পরবিরোধী মাধুরী আছে কোন পোশাকে?” – প্রশ্ন করেন অধ্যাপক সায়ীদ – “শরীর নিয়ে এমন শিল্পিত খেলা আর কে খেলতে পারে?” শাড়ির মধ্যে আছে প্রদর্শন ও সংগোপনের মিলিত জাদু। “এ সৌন্দর্যের লালসাকেও বাদ দেয় না আবার আলোয়-ছায়ায়, মেঘে-রৌদ্রে শরীরকে যেন স্বপ্নরাজ্য বানিয়ে দেয়।” শাড়ি নামক পোশাকটির নাকি রয়েছে সহজ প্রীতিময়তা। শাড়ি কিমোনোর চেয়ে উন্নত, কারণ কিমোনোর রঙ এতটাই উচ্চকিত যে নারীদেহের সহজাত মাধুর্যকে তা প্রায়শই ছাপিয়ে যায়। তাছাড়া জাপানের কিমোনো কখনই শরীরের বাঁকগুলোকে সেভাবে প্রকাশ করতে পারে না, যেভাবে পারে বাংলার শাড়ি। সব মিলিয়ে বাঙালি নারীর পোশাক হিসেবে শাড়িই সেরা, শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো পোষাক বাঙালি নারীদেহগঠনের জন্যে অনুকূল নয় -এটাই অধ্যাপক সায়ীদের মত।

১০.
অধ্যাপক সায়ীদ মনে করেন, গড় বাঙালি নারীদেহে সুষমতা এবং উচ্চতার ঘাটতি আছে। থাকতেই পারে, জন্মের উপরতো কারও হাত নেই। কিন্তু এই ঘাতটিটুকু শাড়ি তার নিজগুনেই সমাধান করে দেয়। শরীরের ‘সুষম অংশকে বিবৃত করে এবং অসম অংশকে আবৃত করে শাড়ি এই দুর্লভ কাজটি করে।’ পাঞ্জাবি-পাজামা, উত্তরীয়ও হয়তো সমাধান করে বাঙালি পুরুষদেহের ঘাটতি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা শাড়ি পড়লে তুলনামূলক খাটো মেয়েকে অপেক্ষাকৃত লম্বা দেখাতে পারে, ঠিক যেমন হাঁটুপর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি পড়লে খাটো পুরুষকেও কিছুটা লম্বা মনে হতে পারে। অধ্যাপক সায়ীদের ষষ্ঠ দাবি: শাড়ি এমন একটি প্রীতিময় পোষাক যা দীর্ঘ বা মধ্যম উচ্চতার যে কোনো বাঙালি মেয়েকে প্রিয়দর্শিনী করে তুলতে পারে। শাড়ি তাঁর মতে নিরীহ একটি পোশাকমাত্র নয়, এটি তার চেয়েও বেশি কিছু, শাড়ি একটি মেক-আপ। মেকআপের প্রধান কাজ হচ্ছে রূপের ঘাটতি দূর করা এবং সেই কাজটিই করে থাকে শাড়ি।

অন্য সব পোশাকের চেয়ে শাড়িতে কাপড় লাগে অনেক বেশি। কিন্তু আধুনিক যুগের মন্ত্র হচ্ছে, অধ্যাপক সায়ীদের কথাটা যদি সাধু বাংলায় বলি : ‘ন্যূনতম মহত্তম’, অর্থাৎ যত কম কাপড় পড়া যায় ততই শ্রেয়। প্রয়োজনের কাছে শিল্প পরাজিত হয়েছে – বলছেন অধ্যাপক সায়ীদ। কিন্তু শিল্পহীন জীবন কি আদৌ যাপনযোগ্য একটা জীবন? নারীবাদী ও আ্যাকটিভিস্ট সাদিয়া নাসরিন কিংবা কাবেরি গায়েন যেমনটা দাবি করেছেন, অধ্যাপক সায়ীদ তাঁর নিবন্ধে বাঙালি নারীর পোশাক নির্ধারণ করে দেননি। তিনি শ্রেফ শাড়ির পক্ষে ওকালতি করেছেন। তিনি মনে করেন, শাড়িকে বিদায় দিয়ে বাঙালি নারী একেবারেই আনাড়ির মতো কাজ করেছে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এতটা ‘নাড়ি-স্বাধীনতা’ ভালো নয়, কারণ নাড়ি অতিরিক্ত স্বাধীন হয়ে গেলে  উদরাময় হলে) খামাখা কাপড় নষ্ট হবে! অবশ্য (শিব্রাম চর্কর্বতি যেমনটা বলেছিলেন) খাকি রঙের কাপড় পড়লে কোনো সমস্যা নেই।

১১.
প্রশ্ন হতে পারে, নারী কী পোষাক পড়বে, সেটা একজন পুরুষ হয়ে অধ্যাপক সায়ীদ আদৌ বলতে পারেন কিনা। কোন অধিকারে এবং যোগ্যতায় তিনি ঠিক করে দিতে চাইছেন, মেয়েদের কী রকম পোশাক পরা উচিত? তিনি যেহেতু ফ্যাশন ডিজাইনার নন, সেহেতু তিনি বলতে পারেন কিনা কোন বিশেষ জাতির নারীকে কোন বিশেষ পোষাকে ভালো লাগবে কি লাগবে না? উত্তর ভারতের মেয়েরা বাঙালি মেয়ের চেয়ে লম্বা কিংবা (অতিসংকরতার কারণে) বাঙালি নারীর শরীর সুষম নয় – এই ধরনের কথা বলা এক ধরনের বর্ণবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, ধর্ষকামী মানসিকতার প্রতিফলন কিনা? সাধারণ লোক যা খুশি বলতে পারে, কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো একজন স্বনামধন্য, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি কোনো নারীকে বিষমকায় কিংবা ক্ষুদ্রকায় বললে জনগণের কাছে একটা ভুল বার্তা যায় কিনা?

‘আগেতো দর্শনধারী, তার পর গুনবিচারি’ – এই প্রবাদবাক্যটিই বর্ণবাদী নয় কি? ফেয়ার এন্ড লাভলিসহ যাবতীয় বিউটিক্রিম, ফ্যাশন-দ্রব্য, ফ্যাশনেবল পোশাকের অস্তিত্বও কি বর্ণবাদের আকর নয়? ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কথাটা আমরা মুখে বলি, কিন্তু মনে কি ভাবি? আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সিনেমার নায়িকারা পান্তাভাত কিংবা ভাতের মাড় খেয়ে গায়ে গত্তি লাগাতেন, এখন সবাই চিকনি-চামেলি হতে চান – এই যে সৌন্দর্যের মানদণ্ড বদলে যাওয়া – এটা কি শ্রেফ পুরুষের কারণে হয়েছে, নাকি নারীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই মানদণ্ড নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে? হিন্দু দেবীদের মধ্যে কেউ মোটা নন, দেবতাদের মধ্যে একা গণেশ এবং (শুধু বাংলা অঞ্চলে) গণেশের বাবা শিবঠাকুর মোটা এবং ভূঁড়িদার। দেবীদের মধ্যে কালী এবং দেবতাদের মধ্যে শিব ও কৃষ্ণ ছাড়া বাকি সবাই উত্তরভারতের লোকদের মতো ফর্সা কেন? ঈশ্বর নারীও নন, পুরুষও নন – এ যদি আমরা বিশ্বাস করি, তবে কোনো দেবতা বা দেবীর অর্ধনারীশ্বর কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ মূর্তি নির্মাণ করা হয় না কেন? এর মানে হচ্ছে, প্রগৈতিহাসিক কাল থেকেই ভারতবর্ষের সৌন্দর্যের মানদণ্ডে কালোর উপরে সাদার প্রাধান্য, মোটার উপরে পাতলার প্রাধান্য, লিঙ্গমিশ্রণের বিপরীতে একলিঙ্গতার প্রাধান্য। এই মানদণ্ড আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে থাকবে, কাজে-কর্মে প্রতিফলিত হবে, শুধু মুখে বলা যাবে না – এটা এক ধরনের সামাজিক ভণ্ডামি নয় কি?

‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী’, ‘বাকপ্রতিবন্ধী’ – এই ধরনের তৎসম সমাসবদ্ধ শব্দ দিয়ে আমরা যথাক্রমে ‘অন্ধ’ ও ‘বোবা’ শব্দকে প্রতিস্থাপিত করে ভাবছি, এই প্রতিবন্ধীদের মহা উপকার করে ফেললাম। শব্দ বদলালেই বস্তু বদলায় না। সমাজে প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন দরকার প্রথমে, নাম বদলটা পরে করলেও চলে। যেহেতু প্রতিবন্ধীদের অবস্থা বদলানো আমাদের সাধ্যের বাইরে, নাম বদলানো আমাদের ক্ষমতার ভিতরে, সেহেতু দ্বিতীয় কাজটাই করছি আমরা, যে কোনো ফাঁকিবাজের মতোই। অধ্যাপক সায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোতেও এই ফাঁকিবাজী মানসিকতার প্রতিফলন আছে কিনা সেটাও ভাবা দরকার।

১২.
কৃত্তিবাসী রামায়নের বাঙালি সীতা কিংবা কাশিরাম দাসের মহাভারতের দ্রৌপদীর বসন শাড়ি, যার মানে হচ্ছে, এই পোশাকটি দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ। বাংলার আবহাওয়া, বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে শাড়ি যেভাবে খাপ খায়, অন্য পোষাক সেভাবে খাপ খায় না – এমনটা দাবি করতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মেয়েদের শাড়িই পড়তে হবে। প্রতিটি পোষাকের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, যেমন প্রতিযোগিতা আছে দুই ব্যক্তির মধ্যে। শাড়ি মিনি স্কার্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে কিনা সেটা প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। পুরুষের পোষাক হিসেবে লুঙ্গি প্যান্টের কাছে হেরে গেছে, লুঙ্গির বহু রকম গুন থাকা সত্তেও। শ্রেফ গুন কিংবা সংস্কৃতির অজুহাতে কোনো পোষাক প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না, পারলেও সেটা হবে কিছুদিনের জন্যে। সিরাজদৌল্লার পোশাক পরে কেউ কি অফিসে যাবার সাহস করবে ২০১৯ সালে? যে প্যান্ট আজ সার্বজনীন পোশাকে পরিণত হয়েছে, কালের প্রবাহে সেটাও একদিন হারিয়ে যাবে। শাড়িরও একই পোড়া কপাল হতে পারে।

‘শাড়ি ভালো কিবা মন্দ, দ্বন্দ্বে মাতে শুকসারি। দুঃখ বাসি মনে রে বন্ধু না পড়িলে শাড়ি!’ ‘আবু সায়ীদ আবদুল্লাহরে কী যে ভূতে পাইল। শাড়ির গুন দেখাইতে গিয়া নারীর গাইল খাইল।’ দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা দেহাতি গানে মনের কথাটাই যেন বলা হচ্ছিল। শাড়ির পক্ষে, শাড়িশিল্পের পক্ষে এবং সর্বোপরি বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে কলম ধরে কী বিপদে পড়েছেন অধ্যাপক সায়ীদ, তাও এই বুড়ো বয়সে। হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে উপকারীর ইয়েতে বাঁশ দেয়া বাঙালি চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন বটে। বেশিরভাগ বাঙালির স্বভাব আসলে ‘আওয়ামি’ (‘জনগণের’ অর্থে) যার চারটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : আমরা ১. বন্ধুকে সন্দেহ করি, ২. শত্রুকে বুকে টেনে নিই, ৩. কী আসলেই করা উচিত, তা জানি না এবং ৪. যা একেবারেই দরকার নাই, শুধু তাই করি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখুন, আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের অবকাশ পাবেন না।

১৩.
অধ্যাপক সায়ীদ যেহেতু প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, শাড়ি বাঙালি নারীর জন্য উপযুক্ততম পোশাক, শরীরের মাপজোকের প্রসঙ্গ আবশ্যিকভাবে তাঁর লেখায় এসেছে। তিনি নারীদেহের দৈর্ঘ্যরে মাপ দিয়েছেন, প্রস্থের মাপতো দেননি, যদিও আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নারী কিংবা পুরুষ যে কোনো শরীরের মাপ কেন অশ্লীল হবে? ব্রা-ব্লাউজ-পেটিকোটের মাপ কি আমাদের বলতে হয় না এসব পোশাক তৈরি কিংবা ক্রয়ের প্রয়োজনে, দর্জি কিংবা বিক্রেতাকে। ভুলে গেলে চলবে না যে এই সব মাপ পোশাকের বটে, কিন্তু মাপগুলো মূলত নারীদেহের। জাগতিক প্রয়োজনে শরীরের মাপের উল্লেখ যদি অশ্লীল না হয়, তবে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার প্রয়োজনে একই মাপজোক কেন অশ্লীল হবে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিবন্ধটি নান্দনিকতা ও সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ। তাঁর বিশ্লেষণ ও কমবেশি ছয় দফা দাবির সঙ্গে সবাই একমত নাও হতে পারেন। তোমার হলো শাড়ি, আমার হলো সাড়া। একই টেক্সট পড়ে কিংবা শাড়ি দেখে দুজনের মনে কি একই সাড়া হবে? অসিযুদ্ধ, গদাযুদ্ধের মতো তর্কযুদ্ধেরও কিছু নিয়ম আছে। নিয়মটি হচ্ছে, পাল্টা যুক্তি দেওয়া যাবে, কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ করা যাবে না। এই নিয়ম আমরা অনেকেই মানছি না শুধু নয়, অভদ্রতার সীমাও অতিক্রম করছি। যিনি বা যাঁরা অধ্যাপক সায়ীদের সঙ্গে একমত নন, তাঁরা ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু এ ধরনের নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ফ্যাশন-সংক্রান্ত আলোচনা করাই যাবে না – এমন ফ্যাসিবাদি মানসিকতা লালন করলে জাতি হিসেবে আমরাইতো আগেপরে ফেঁসে যাবো। বাঙালি নারীদেহ এবং এর অনন্য আবরণ-আভরণ শাড়ি দীর্ঘজীবী হোক। বিচ্ছেদহীন এবং চিরযৌবনময় হোক বাংলা এবং শাড়ির মধুর সম্পর্ক। জয় শাড়ি এবং অবশ্যই, জয় বাংলা!

(প্রবন্ধটি দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)

লেখক:
Shishir Bhattacharja
শিশির ভট্টাচার্য্য, ভাষাবিজ্ঞানী, লেখক ও কলামিস্ট

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.