বিনয় মজুমদারের কবিতা

Comments

আগুনের পৃথিবীতে অগ্নিহীনতাকে

 চিন্তাক্ষমদের মনে চিন্তাগুলি আবির্ভূত হয়
 শব্দ বা বাক্যাংশ কিম্বা বাক্যের আকারে, প্রিয়তমা। 
 চিন্তার মাধ্যম নয়, ভাষা হলাে চিন্তাই স্বয়ং।
 সব শব্দ, শব্দাবলী চিন্তাংশের মতাে মনে হয়, 
 অর্থাৎ চিন্তারও ফুট অবয়ব আছে, কান্তি আছে।
 অবয়ব মুক্ত হলে সরল শূণ্যতা পড়ে থাকে
 নিশ্চিন্ত পড়ে থাকে—অবয়ব অস্বীকার করে,
 ঈশ্বরী, যেমন পাই আগুনের পৃথিবীতে অগ্নিহীনতাকে।

স্বপ্নের সুযােগে তুমি দিয়েছিলে সবকিছু

স্বপ্নের সুযােগে তুমি দিয়েছিলে সবকিছু -সব
 সমাজবন্ধের উর্ধে তােমাকেই অনুভব করে
 প্রিয় বাষ্পময় রূপে নিজেকে করেছি অনুভব,
 আবার বিশাল রৌদ্রে মনোলীনা হয়ে গেছাে ভােরে।
 এই যে মুহূর্ত, এই কাব্য, গীতি অমেয় তৃষ্ণার 
 অমেয় আকাঙক্ষা থেকে কত দিন কত কাল ব্যাপী
 রচনা করেছি তা তাে আমি জানি, স্বপ্নের নীলিমা।
 উদ্দাম তড়িতাহত শিশির মধুও হয়ে যায়,
 কুসুমের অভ্যন্তরে মধু হয়ে শান্ত হতে পারে।
 সেহেতু নিদ্রার প্রতি শরীরের, হৃদয়ে আর
 অন্যবিধ বিষয়ের, ব্যাপারের সুনিদ্রার প্রতি
 এখনাে শিথিল প্রীতি আমাদের হৃদয়ে রয়েছে।
 এইভাবে যেন থাকে, যেন কোনাে ভূগর্ভযুগীয় 
 অন্ধকারও নিভে গেলে সুনিদ্রায় শূন্যায়িত হই।

আমাকে ও মনে রেখো

পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদ এরা জ্যোতিস্ক এবং
আকাশের তারাদের কাছে চলে যাবো।
আমাকে ও মনে রেখো পৃথিবীর লোক
আমি খুব বেশী দেশে থাকি নি কখনো।
আসলে তিনটি মাত্র দেশে আমি থেকেছি, এখন
আমি থাকি বঙ্গদেশে, আমাকেও মনে রেখো বঙ্গদেশ তুমি।

করুণ চিলের মতো

করুণ চিলের মতো সারাদিন, সারাদিন ঘুরি।
ব্যথিত সময় যায়, শরীরের আর্তনাদে, যায়
জ্যোৎস্নার অনুনয়; হায়, এই আহার্যসন্ধান।
অপরের প্রেমিকার মতন সুদূর নীহারিকা,
গাঢ় নির্নিমেষ চাঁদ, আমাদের আবশ্যক সুখ।
এতকাল চ’লে গেল, এতকাল শুধু আয়োজনে।
সকলেই সচেতন হতে চায় পরিসরে, ক্ষুধার মতন
নিরন্তর উত্তেজনা নাড়িতে-নাড়িতে পেতে চায়।
হস্তগত আহার্যের গূঢ় ঘ্রাণ, স্বাদ ভালোবেসে
বিহ্বল মুহূর্তগুলি যেন কোনো অর্ঘ্যে দিতে চায়।
অথচ চিলের মতো আয়োজনে আয়ু শেষ হয়।
ব্যর্থ অনাশ্রয় কেউ চাই না; তোমাকে পেতে চাই
তবু আশ্রয়েও আগে, পরিহিত অবস্থায় কোনো
অঙ্গুরীয় হারানোর ক্ষিপ্ত ভয় লোপ পায় ব’লে।

আমরা দুজনে মিলে

আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই , খৃষ্টান হয়েছো।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।

ভালোবাসা দিতে পারি

ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবত গুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান – শুধু অঙ্কুরের
উদগমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচুড়া থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।

লেখক:
Binoy Majumder
বিনয় মজুমদার, কবি

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট