অঙ্কের ফরমুলা কিংবা উদ্দেশ্যহীন গণিত বিশ্লেষণ ও বিক্ষিপ্ত কয়েক লাইন কবিতার খসড়ার সহজ সহাবস্থান তাঁর ডায়েরির পাতায় অবলীলায় ঠাই করে নিতে পারলেও জীবনের আঙিনায় খুব একটা পেরে ওঠেনি।
স্কুল জীবনে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন যখন,ভাবনায় তখন কিছুমাত্র ঠিক করেননি জীবনের গন্তব্য। জানতেন না কবি হবেন, নাকি প্রকৌশলী, নাকি অন্য কিছু। তবে বাবা, পরিবার ও নিকট গুরুজনেরা সবাই যে তাঁর হয়ে ওঠা নিয়ে এন্তার চিন্তায় ছিলেন সে তথ্য-প্রমাণ প্রতুল। দারুণ ছবি আঁকা বা অভিনয় করা-এসবে সবাইকে মাতিয়ে রাখা ছেলেটার সঙ্গে বইপত্রের সম্পর্ক খুব একটা ছিল না। তবুও সবার সংশয় কাটিয়ে পরীক্ষার ফলটা তার কি করে কি করে ভালো হতো বরাবরই।
বাবা ছেলেটাকে আদর করে ডাকতেন ‘টু’ নামে। আরো অল্প ক’জন এই নামে ডাকলেও ছ’ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট ছেলেটাকে সবাই ডাকতো ‘মংটু’। বর্মার (বর্তমান মায়ানমার) মিকাটিলা জেলার টাডো নামের জায়গাটায় (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪) জন্মালেও তার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে (১৯৪২ সালে)। ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেও (১৯৪৪ সালে) পরিবারের দুশ্চিন্তা তিনি কমাতে পারেননি শৈশবে। অমন ধারা ইতি টানেনি তার জীবনের শেষ দিন অব্দি।
বৌলতলি হাই-ইংলিশ স্কুলের ম্যাগাজিনে যখন প্রথম কবিতা ছাপা হয় (১৯৪৬-৪৮) তখনও কেউই জানতো না ছেলেটা কবি হবে নাকি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দুর্গাপুর স্টিল প্রজেক্টে প্রথম চাকরি নিয়ে যখন থাকছেন ট্রেইনিদের হোস্টেলে তখনও এই নয়া প্রকৌশলীকে নিয়ে বাবা-দাদাদের দুশ্চিন্তা তুঙ্গে। ছেলেটার মন সেখানে টিকছে না কিছুতেই। বাবা চিঠি লিখে বোঝান, দাদা বোঝান। সরকারি চাকরির মধু ফেলে তবু মরিয়া হয়ে সে চলে আসতে চায় কলকাতায়। কাজ-বাজ ছাড়া বেকার হয়ে কারো সঙ্গে মেসে একটা সিট জুটলেই চলে আসবে, এমনতরো বেপরোয়া অবস্থা। কীসের সে’ টান! কবিতা! কফি হাউস! প্রেম! কবিবন্ধু! অথচ কারো সঙ্গে যে তার খুব একটা মরিয়া সখ্যতা ছিল তা নয়। আবার বিরূপ কোনো সম্পর্ক তা-ও নয়। এসবের ভিতর দিয়েই তৈরি হচ্ছিলেন কবিদের কবি বিনয় মজুমদার।
বৌলতলি স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে হেডমাস্টার ক্লাস এইটে ভর্তি করাতে বলে দেন। ফিরে আসার পথে বিনয় বেঁকে বসেন। তিনি ক্লাস নাইনেই ভর্তি হবেন। হলেনও তাই। ছাত্রজীবনের শেষদিক অব্দি সম্ভাবনাময় একজন মেধাবী বিজ্ঞান ছাত্রের উত্থান ছাড়িয়ে অন্য কিছুই প্রাবল্যে স্ফুরিত হয়নি তাঁকে ঘিরে। প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স (উচ্চ-মাধ্যমিক) পাশ করার পর (১৯৫১) মেধাবী বিনয়ের উত্তরোত্তর শানিত ফলাফল অব্যহত থাকে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে পাশ করার সময় (১৯৫৭) তাঁর প্রাপ্ত রেকর্ড নম্বর নাকি অদ্যাবধি কেউ টপকাতে পারেনি। তাঁর প্রকাশিত প্রথম বইটিও কিন্তু কবিতার নয়। ‘এনবিএ’ থেকে প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ ‘অতীতের পৃথিবী’ বিনয় মজুমদারের প্রথম প্রকাশিত বই।
জীবনের শুরুতেই বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বান, লন্ডন থেকে গণিতের অধ্যাপনার প্রস্তাব কিংবা জাপান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর কাজ করার প্রস্তাব হেলায় পাশে সরিয়ে দ্বিধায় ছিলেন বিনয় নিজেই, আসলে তিনি কি করবেন। ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে যেমন তাঁর আগ্রহের দেখা মিলেনি, তেমনি একবার পাসপোর্টবিহীন বাংলাদেশে (সেসময়কার পূর্ব-পাকিস্তানে) এসে শিক্ষকতা শুরু করেও অকস্মাৎ নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে ছ’মাস জেলও খাটেন। গণিত আর কবিতা তাঁকে যুগপৎ টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যেই রেখেছিল।
ইন্টারপোলেশনের যে সূত্র বিনয় আবিষ্কার করে গেছেন তা নিয়ে অনেকবার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন তাঁর খুব কাছের বন্ধু জ্যোতির্ময় দত্ত। ইনি না থাকলে বিনয়কে অনেক বিপদের ভিতর থেকে কেউ বারে বারে উদ্ধার করত কিনা কে জানে ! মানুষ যেখানে সেকেণ্ড ও থার্ড ডাইমেনশন অব্দি ভাবতে পারে দুর্দান্ত ব্রিজ খেলোয়াড় বিনয় মজুমদার সেখানে যুক্তি সহকারে ফোর্থ ডাইমেনশন অব্দি ভেবে গেছেন। তাঁর জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি আর গাণিতের নানান জটিল প্রস্তাবনা ভারতে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এমন কি বৃটিশ মিউজিয়ামেও সংরক্ষিত আছে। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিনয় মজুমদারের এক গবেষণাপত্র দেখে এমন বিস্মিত হন যে তিনি সেটাকে মহাফেজখানায় রাখার পরামর্শ দেন।
বিনয় মজুমদারের কবিতা
এই মেধাবী মানুষটিই সব সম্ভাবনা দুহাতে ঠেলে কেবল কবিতা লেখায় নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। শেষদিকে ক্রমাগতভাবে মানসিক ভারসাম্য হারাতেন বিনয়। একবার সগারেট খেতে খেতে দেশলাই দিয়ে নিজের মশারিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বলতেন হাঙ্গর তাড়াতে চাইছেন, মারতে চাইছে। সেই হাঙ্গর হয়তো সমাজের ওইসব অপঃ যা তিনি রুখে দিতে চাইতেন। আটবার মানসিক হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছিলো তাঁকে। মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার অংশ হিসেবে প্রায় ৩০/৩১ বার ইলেকট্রিক শকও দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়টা নিয়েও রসিকতা করতেন বিনয়। বলতেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের পাগলাগারদ সমূহের পরিদর্শক আমি’। বাস্তবে ব্যাপারটা আসলে একটুও পছন্দের ছিল না তাঁর। বলতেন, নিজেকে পাগল বলে মনে করেন না। তাই কেউ পাগল বললে তাঁর খারাপ লাগে। এমনই এক মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সময়ে তাঁর দেখা হয়ে যার আরেক মেধাবী কীর্তিমান ঋত্বিক ঘটকের সাথে। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমে ওঠে। সেইসূত্রে ঋত্বিকের ‘জ্বালা’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন বিনয়। অন্যদিকে ঋত্বিক বারবার বলেছেন বিনয়ের কাব্য প্রতিভার কথা।
চব্বিশ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হবার আগে পর্যন্ত বিনয়ের কবিতা সেভাবে ছাপা হয়নি পত্র-পত্রিকায়। প্রকাশক দেবকুমার বসু তাঁর পাণ্ডুলিপি পড়ে নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেন বিনয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’ (১৯৫৮)। তারপর এক বছর বিনয় শুয়ে বসেই কাটিয়েছেন জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবতে ভাবতে। এক বছর ভেবে পরে ঠিক করেন যে, অন্য কিছু নয়, তিনি শুধু কবিতাই লিখবেন। ইতিমধ্যে প্রকাশিত ‘নক্ষত্রের আলো’ তেমন সাড়া না জাগালেও লিখতে শুরু করলেন পরের বই ‘ফিরে এসো চাকা’। এই বইয়ের নামকরণ নিয়ে মজার এক গল্প আছে। বিনয়ের এক বিলেতফেরত বন্ধু কেতা করে তাঁর চক্রবর্তী নাম ছেঁটে লিখতে লাগলেন ‘চাক’। উর্বর রসিক মনের বিনয় ভাবলেন, পুং-লিঙ্গ চাক হলে তার স্ত্রী-লিঙ্গ হবে চাকা। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর চৌদ্দ কবিতায় এক ফর্মার চটি বই ‘গায়ত্রীকে’। বইটা বেরুবার পর চারিদিকে আলাপটা জোর হচ্ছিল যে, গায়ত্রীটা কে? চটি ওই বইটার কবিতার চেয়ে আলাপ-আলোচনা জোর ছিল গায়ত্রীকে নিয়েই। কে এই গায়ত্রী! কি লিখলেন ‘গায়ত্রীকে’ বইখানায়? কাকে নিয়ে লিখলেন? প্রেসিডেন্সি কলেজের চৌকস ছাত্রী গায়ত্রী চক্রবর্তী থেকে শুরু করে হিন্দু হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তীর কিশোরী-তরুণী কন্যা গায়ত্রী; সকল নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিলো সবাই। বাস্তবিকই প্রেসিডেন্সির মেধাবী ছাত্রী গায়ত্রী চক্রবর্তীর পিছু নিয়ে তার ক্লাসে ঢুকে পড়েন তখন বিনয়। আর বিনয়কে টের পেয়ে সেই ক্লাস ছেড়ে অন্য দরোজা দিয়ে পালিয়ে যান গায়ত্রী। অনেক পরে দেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন গায়ত্রী চক্রবর্তী। আপন মেধায় সুপরিচিত গায়ত্রীও পরে বিনয়কে নিয়ে মন্তব্যে বলেছেন, বাংলার দান্তে। ‘গায়ত্রীকে’ বইটিই পরের সংস্করণে বের হয় ‘ফিরে এসো, চাকা’ নামে। এবারও গ্রন্থের নামকরনটিই খোলাসা করে দেয় গায়ত্রীর পরিচয়। চাকা শব্দের সংকেত দিয়ে চক্রবর্তী অর্থাৎ এই গায়ত্রীকেই বুঝিয়েছিলেন বিনয়। আর একে ঘিরেই রচিত হয়েছে বিনয়ের অসংখ্য কবিতা। যদিও সিরিয়াসলি এ নিয়ে প্রশ্ন করলে বিনয় কখনোই কোনো সদুত্তর কাউকে দেননি। বলেছেন, কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়। আমগাছ, কাঁটাগাছ, রজনীগন্ধা এসব নিয়ে কি চিরকাল লেখা যায় নাকি! ফের তৃতীয় সংস্করণে এই বইটারই নাম পালটে দিয়েছেন ‘আমার ঈশ্বরীকে’।
হয়ত চাকরি ফেলে কলকাতায় ফিরে আসা নিয়ে বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে গায়ত্রীও একটা কারণ ছিল! গায়ত্রী তখনও দেশে। বিনয় যে অনেককে গায়ত্রীর খোঁজ জানাবার জন্য বা ঠিকানা চেয়ে জ্বালাতন করতেন তাঁর আভাস পাওয়া যায় সেসময়ের প্রিয় সখ্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাথে বিনয়ের পত্রালাপ থেকে। সবাই তা ইতিবাচকভাবে না নিলেও শক্তি তাঁকে ঠিকানা সংগ্রহ করে দেবার কথা দিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন। গায়ত্রীর এক আত্মীয় যদিও তার সম্পর্কে আগ্রহ না রাখার ব্যাপারে স্পষ্ট পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুনীল বা অমন অনেকে এতে বিরক্ত হলেও নিশ্চুপ বা প্রতিক্রিয়াহীন থেকেছেন।
‘গায়ত্রী’ বইটির রিভিউ লেখা ঘিরে আলোচনায় ক্ষুধা ব্যাপারটা মাথায় এলে, তা নিয়ে ‘ক্ষুধার্ত আন্দোলন’ সম্পর্কিত নানা ভাবনার উদ্রেক হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে। এ থেকে ‘হাংরি জেনারেশ’ন বা ‘ক্ষুৎকাতর সম্প্রদায়’ সংক্রান্ত উদিত ভাবনাগুলো নিয়ে হাংরি আন্দোলনের নীতিমালা সংক্রান্ত একটা খসড়া তৈরি করেন শক্তি। বিনয় সেই সময় (১৯৬২) হাংরি আন্দোলনে যোগ দিলেও পরের বছরের শেষদিকে কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াময় হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করে তাঁদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল কফি হাউসে বিলি করেন এবং হাংরি আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পৃক্তির ইতি টানেন।
‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হবার পর তা বিপুল সাড়া জাগায় এবং সব কাব্যপ্রেমীদের নজর কাড়ে। কলকাতার সাহিত্য সমাজ যেমন এই বই দিয়ে বিনয়কে আবিষ্কার করেছে নক্ষত্র হিসেবে, তেমনি তিনি নিজেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই একখানাই তাঁর কবিতার বই। পরের সবই নাকি পয়মাল! সচরাচর কাউকে নিজ লেখালেখি নিয়ে এরকম মন্তব্য করতে দেখা না গেলেও বিনয় তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে চাঁছাছোলা মন্তব্য করেছেন অকপটে। নিজেকে নিয়ে অমন কঠিন মন্তব্যের নজির নেই, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ফিরে এসো চাকার পর লিখতে শুরু করেছিলেন ‘আঘ্রানের অনুভূতিমালা’ ও ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ’। ঈশ্বরীটি কে এই নিয়ে ভাবিত হয় কবিতামোদীরা। তাঁদের প্রশ্নের জবাবে বিনয় বলেছিলেন, ঈশ্বরীটি তিনি নিজেই। এই সময় থেকে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিতে থাকে বিনয়ের। এর ভিতর থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেননি তিনি। সুস্থতা আর অসুস্থতার পালা বদলে বাড়ি আর হাসপাতাল এই চক্রেই কেটেছে তাঁর বাকি জীবন। কাউকে কষ্ট দিতে না চাইলেও কিংবা জ্বালাতে না চাইলেও মানসিক অসুস্থতার এই পালাবদলের ভাঁজে ভাঁজে তাঁর ভাই বন্ধুদের কমবেশি জ্বালিয়েছেন তিনি। মৃত্যুর আগে শেষ সময়টায় তাঁর প্রতিবেশিরাই দেখাশোনা করতেন তাঁর।
প্রথম কয়েকটা বইয়ের পর ‘অধিকন্তু’, ‘ঈশ্বরীর’, বাল্মিকীর কবিতা’, ‘আমাদের বাগানে’, ‘আমি এই সভায়’, ‘এক পঙক্তির কবিতা’, ‘আমাকেও মনে রেখো’, ‘হাসপাতালে লেখা কবিতা’ এই কয়টা পাঠকদের কিছুটা পরিচিত নাম। এর মধ্যে ‘বাল্মিকীর কবিতা’ বইটা অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট হলে তাঁকে অনেকটা একঘরে হয়ে পড়তে হয়। এক পর্যায়ে বইটা থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ফেলে প্রতিবাদীরা। পরবর্তী মুদ্রণে এই অংশটুকু বাদ দিয়েই প্রকাশ করেছিলেন বিনয়। বিনয়ের গোটা কুড়ি বইয়ের তালিকাটা সবার কাছে সুপরিচিত নয়। যদিও সাহিত্যানুরাগীরা কবিদের কবি হিসেবে পরিচিতি দিয়ে তাঁকে একজন উচ্চমার্গের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে তাঁর মধ্যবয়স থেকেই। কিন্তু প্রথা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিনয় মজুমদার মৃত্যুর একেবারে আগে আগে দুটা উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থেকে আর কোনো স্বীকৃতি পানিনি। অবশ্য তাতে তাঁর যে খুব একটা কিছু যায় আসে তা নয়। তিনি নিজেই বলেছেন, এই যে হাজার হাজার কবিতা তিনি লিখেছেন তাতে বাংলা সাহিত্যের আদৌ কিছু আসে-যায়নি। অতসব কবিতা তাঁর না লিখলেও হতো। তাঁর সব কথাকে অনেক গুরুত্ব দিলেও এইটুকু কথাকে তাঁর নিজস্ব পাগলামি বলেই মানবে হয়তো বাংলা সাহিত্য ও সাত্যানুরাগীরা।
বিনয় মজুমদারের কবিতা
হাংরি আন্দোলনের নেতা মলয় রায়চৌধুরীর কথায়, বিনয় মজুমদার হলো কবিতার বোধিবৃক্ষ। গাণিতিক শৌন্দর্য তত্বের উপর বিনয় গড়ে তুলেছেন তাঁর চারটি সাব জনার ঘিরে কবিতার বনেদ। ‘ফিরে এসো, চাকা’ ছিল বাংলা সাহিত্যে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মিকীর কবিতা’, এবং হাসপাতালে ও শিমুলপুরের খতিয়ান ‘শিমুলপুরে লেখা কবিতা’, ‘কবিতা বুঝিনি আমি’, ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’, ‘ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য’ এবং ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ এই বইগুলোয় পরবর্তী সাব-জনারগুলো প্রতিবার নতুন স্বচ্ছ্বতা নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। গণিত ও বিজ্ঞানকে তাঁর মতো করে কবিতায় বোধকরি আর কেউই কখনও আনতে সক্ষম হননি। উল্লেখ্য সকল ধর্মের সকল মহাগ্রন্থগুলোও গাণিতিক সৌন্দর্যে বিন্যস্ত। ওমর খৈয়ম এবং এমিলি ডিকিনসন অনেক বেশি হলেও তাঁদের মতো আরো অনেকে অল্পবিস্তর গাণিতিক বিন্যাসে কবিতা লিখেছেন। কিন্তু বিনয় হয়তো আরো অধিক মাত্রায় ও আরো উচ্চমার্গে লিখেছেন। এমনকি কবিতার ভিতর সরাসরি গাণিতিক ফরমুলাও বসিয়েছেন।
গণিতজ্ঞের নিজ জীবনটাই ছিল বেহিসাবের নজিরে ভরা। গড়মিলে ঠাঁসা। প্রথম জীবনে বিনয়ের এক সহপাঠীর বোন শ্যামলী ঘোষের সঙ্গে প্রেমের সূত্র ধরে বিয়ে ঠিক হলেও জাতভেদের সমস্যা ঘিরে পারিবারিক সিদ্ধান্তের জের ধরে সে বিয়ে তাঁর হয়নি। হয়তো এই অভিমানে দেশ ত্যাগে বা ধর্ম ত্যাগের মতো বিষয়ের প্রতিও তাঁর বিপদজনক রকম একটা পাগলাটে টান ছিল। যাকে ঘিরে মাঝে তাঁর বাংলাদেশে চলে আসার ঘটনাটা ঘটেছিল। পরবর্তীতে প্রেমও পরিণতি পায়নি জীবনে কখনোই। গায়ত্রী মার্কিন মুলুকে চলে গিয়ে বুদ্ধিজীবী হিসেবে খুব নাম করলে বা ভালো থাকলেও সেই বিষয়টা ঘিরে আধুনিকা নারীদের প্রতি তাঁর একটা জটিল রকম বিরাগ তৈরি হয়। তিনি অমন কোনো নারীকে সহ্যই করতে পারতেন না।
একসময় বাচ্চারাও তাঁকে ভয় পেতো। শেষদিকে নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখতেন তিনি প্রায় সারাটা সময়। তখন পেশাগত কোনো সম্পৃক্ততা নেই, পেতেন শুধু সরকার প্রদত্ত পাঁচশো টাকা পেনশন মাসোহারা। পোস্ট অফিস থেকে সেই টাকা তুলেই চলতেন। বইয়ের কাটতি যা-ই থাকুক, য়া থেকে কোনো টাকা তার সেভাবে পাওয়া হয়নি।
মিডিয়ার প্রতিও তাঁর ক্ষোভ ছিল। এড়িয়ে চলতেন, পারলে তাড়া করতেন। নানা কসরত করে তাঁকে পাকড়াও করতো মিডিয়া। এক প্রকার ধরে বেঁধে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভেতরে নিয়ে কথা বলা বা কবিতা পড়া শুরু হলে অবশ্য পালটে যেতো পট। তখন বেশ ভালোভাবেই সব করে যেতেন। কথা বলা, কবিতা পড়া। মাঝে থেমে ভাত খাওয়ার আবদার করতেন। খাওয়াদাওয়া হলেই খুশি।
বিপুল সম্ভাবনাময় একজন বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, যাকে নিয়ে টানাটানি করলো এতো বিদেশ বিভূঁই। বিপুল অর্জন ও প্রাপ্তিতে যিনি চাইলেই পারতেন একটা অতি স্বচ্ছল জীবন যাপন করতে; সেই মানুষটা অনেক ভেবে চিন্তে বেছে নিলেন কবিতা লেখার জীবন। আর ভাতের বিনিময়ে কবিতা পড়ে বা কবিতা বিষয়ে কথা বলে যাপন করলেন শেষ জীবনের অনেকটা দীর্ঘ সময়। সব সিদ্ধান্তকে উপড়ে ফেলে, সব সিদ্ধান্তকে নাকচ করে, সব সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে বিনয় মজুমদার আসলে কবিতাকেই জীবন করেছেন; কবিতাই যাপন করেছেন।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
লেখক:
লুৎফুল হোসেন, কথাসাহিত্যিক