মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী সমাগত। আজ সেই মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানি দস্যু সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে লড়াই করেছেন প্রাণপণে, যারা দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
যারা আজও বেঁচে আছেন নিভৃতে তাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তবে বিভিন্ন সরকারের আমলে যারা মুক্তিযুদ্ধে যাননি বা যাবার বয়স হয়নি, তাদেরও মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় যোগ করা হয়েছে। ফলে অনেক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানি দোসর যারা রাজাকার হিসাবে মাতৃভূমির বিরুদ্ধাচারণ করেছে, তারাও শোনা যায় এ তালিকায় ঢুকে পড়েছে। আবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার জন্য লাল বই, নীল বই ইত্যাদির অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধার মূল তালিকায় কেউ কেউ স্থান করে নিয়েছে, কেউ আবার বঞ্চিতও হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ তো মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনি দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিফৌজ যুদ্ধ করে স্বদেশভূমিকে শত্রুমুক্ত করেছে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জীবিত মুক্তিসেনার অনেকেই আজ পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অথবা বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন। এদের বিষয়ে বর্তমান সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে এবং কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সহযোগিতা হলো সরকার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থকড়ি সাহায্য অর্থাৎ ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৈশাচিক বর্বরদের হাতে স্বদেশের মা-বোনদের যেভাবে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে, সে ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব না হলেও তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে বর্তমান সরকার পাপস্খালন করেছেন। নির্যাতিত মা বোনেরা এখন সরকারি সহায়তা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন।
শুনে আশ্চর্য হলাম, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র এবং পরে সরকার পরিচালনাধীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যারা যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-প্রকৌশলী নানা পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন এবং যার যার মতো নিজ সাধ্যানুযায়ী এ চূড়ান্ত যুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিত করার জন্য কাজ করেছেন। অথচ তাদের নাকি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া এতদিন হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে পর দ্বিতীয় মেয়াদে এদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিস্মিত হলাম এ জন্য যে ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর চট্টগ্রামের সংস্কৃতমনা প্রগতিশীল ও বেতারকর্মী একত্রিত হন ডাক্তার শফির নেতৃত্বে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন ২৬ মার্চ থেকে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চালু করার জন্য। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নামে মুক্তিযুদ্ধের বেতার পরিচালনা শুরু হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ সংস্কৃতিকর্মী বেলাল মোহাম্মদ। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহী বেতার পরিচালনা নিরাপদ হচ্ছে না বলে এবং পাকিস্তানিদের কাছে যে কোন সময় ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় বেতারের সহকারী পরিচালক আবদুল কাহ্হার চৌধুরী কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে গিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার পরামর্শ দেন। সেইমতো বিপ্লবী কর্মীরা বিদ্রোহী বেতারের স্থান চট্টগ্রাম শহর থেকে কালুরঘাটে স্থানান্তরিত করেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের এই বেতারে ক্ষুদ্রাকারে হলেও চালু করেছিলেন কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ কেন্দ্রের ওপর বোমাবর্ষণ করে এবং কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া ২৫ মার্চের গণহত্যাকে পাকিস্তানিদের এক সামরিক অভ্যুত্থান ভেবে পূর্ববঙ্গে তিনি নিজেকে ‘অস্থায়ী সরকারের প্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল ২৭ মার্চ। এ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাতে করে তাকে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল এটা কোন সামরিক অভ্যুত্থান নয়, রাজনৈতিক যুদ্ধ। আর কোন সেনা অফিসার হঠাৎ করে এসে হুইসেল বাজিয়ে দিয়ে দেশোদ্ধার করতে পারে না। দেশের মুক্তির জন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। অবশেষে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বেতারে পাঠ করেছিলেন। যাই হোক, বিধ্বস্ত কালুরঘাট থেকে এক কিলোওয়াট একটি ট্রান্সমিটার আস্ত এবং অক্ষত থাকায়, তাকে উঠিয়ে নিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন বিপ্লবী কর্মীরা। প্রকৌশল বিভাগের টেকনিক্যাল এসিসট্যান্ট রাশেদুল হাসান বন্ধুদের সহযোগিতায় এক বিষ্ময়কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। এই তরুণ প্রকৌশলকর্মী এক কিলোওয়াট টান্সমিটারটি খুলে সীমান্তপারে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। তবে এটি বহন করার জন্য যে ট্রাকের প্রয়োজন ছিল মেজর জিয়া তার ব্যবস্থা করে দিলেন। বহু চড়াই-উতরাই এবং বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে বিপ্লবী কর্মীদের একটি অংশ পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কাছে সীমান্ত বরাবর বগাফার জঙ্গলে ট্রান্সমিটারটি পুনঃস্থাপন করে স্বাধীন বাংলা বেতার চালাতে শুরু করলেন। কয়েকদিন পর বিষ্ময়কর ঘটনার স্থান পরিদর্শনে আসেন ভারতের তথ্য প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী সৎপতী। তরুণ দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের এই অকল্পনীয় কাজটিতে অবাক হয়ে যুদ্ধজয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে মন্তব্য করেন। তারা ভাবলেন কপিবুক ছাড়া এই তরুণ কর্মীরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ট্রান্সমিটারটি পুনঃস্থাপন করলেন কি করে! আমার তো মনে হয় সেদিন দেশপ্রেমের জয় হয়েছিল আর সেই সাহসে সামান্য প্রকৌশলকর্মী হয়ে কাজটি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা রাশেদুল হাসান ও তার সহযোগী আমিনুর রহমান ও শরফুজ্জামান।
এতক্ষণের গৌরচন্দ্রিকার পর এবারে আদত কথায় আসি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রামে চালু না হলে গণহত্যার শুরুর পর মানুষের মনোবলকে ধরে রাখার কি অন্য কোন ব্যবস্থা ছিল? না ছিল না। তাই এই অবিস্মরণীয় ঘটনার নায়কেরা পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব মুক্তিসংগ্রাম হয়েছে তারই অভিজ্ঞতা পাঠে লব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করেই এই বিপ্লবী বেতার চালু করেছিলেন। পরে যদিও মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে গিয়ে বিপ্লবী শব্দটা বাদ দিতে বাধ্য করেছিলেন। তাই পরে এর নাম হয়েছিল- ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ভারত সরকারের কাছে যে সাহায্য চেয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল শক্তিসম্পন্ন মিডিয়াম ওয়েভ টান্সমিটার। সেটা পাওয়া গেলে আমরা ঢাকার বেতারকর্মী এবং কয়েকজন সাংবাদিক মিলে সরকারের পরিচালনাধীন ওই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটিই চালু করেছিলাম। সেদিন ছিল ২৫ মে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন।
আমি বলছিলাম ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মনোবল বজায় রাখার জন্য কালুরঘাট ও বগাফার জঙ্গলে বেতার চালু করে যে অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তার কি কোন মূল্যায়ন রাষ্ট্র বা সরকার এ ৪৯ বছরে করেছে? কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামের ১০ জন বিপ্লবী বেতারকর্মীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তিনি তাদের ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’ দেবেন, তারও কোন হদিস নেই। না হয় বুঝলাম বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নারকীয়ভাবে হত্যার পর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকালে এ সম্পর্কে টুঁ শব্দটিও করবে না, এটা জানতাম। দেশে গত ১১ বছর ধরে ১৪ দলীয় তথা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় বসে আছেন অথচ আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের এই প্রধান শক্তিও বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারলেন না। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ১০ জনের ৬ জন – বেলাল মোহাম্মদ, সৈয়দ আবদুস শাকের, মোস্তফা আনোয়ার, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, রাশেদুল হাসান ও হাবিবুর রহমান মনি প্রয়াত হয়েছেন। অন্য চারজন – আবদুল্লা আল ফারুক, আমিনুর রহমান, শরফুজ্জামান ও রেজাউল করিম চৌধুরী জীবিত থাকলেও নানা রোগে জর্জরিত।
যারা ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত রেখেছেন এবং রণক্ষেত্রে মুক্তিফৌজকে উৎসাহ জুগিয়েছেন এমনকি দেশে-বিদেশে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে সংবাদ ও প্রোগ্রাম প্রচার করে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সবাইকে অবগত করেছেন এবং সব শেষে বিজয়ের ঘোষণা শুনিয়েছেন, আজ তারা নিগৃহীত কেন? যুথবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ কি সম্ভব হতো বিদ্রোহী বেতার ছাড়া? এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রই তো তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈন্যদের এবং দেশবাসী জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিল, সেই ২৬ মার্চ ১৯৭১; তারা কেন এতদিন পরে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পেল? এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আদৌ আছে কিনা সন্দেহ। এতে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, শুধু রণাঙ্গনের যুদ্ধ দিয়েই দেশকে শত্রুমুক্ত করা যায় না, তার জন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের হাতিয়ার ‘বিদ্রোহী বেতার’-এরও প্রয়োজন। এ বেতারই মানুষের মনোবল চাঙ্গা ও দেশ বিদেশের সমর্থন আদায় এবং মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মধ্যে মানসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসকেরা তো নিজেদেরই প্রাধান্য দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তোয়াক্কা করেনি। তবে নিজেদের খেতাব ও পদোন্নতি তারা হাসিল করেছেন।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বিএনপি সরকারও নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রস্তুত করেছিল। বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণাদি উপস্থাপন করা সত্ত্বেও তালিকায় স্থান পাননি। এরপর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আগের তালিকা কেটে-ছেঁটে নতুন যে তালিকা তৈরি করেছেন, তাতেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারেননি। আর সে কারণেই মুক্তিযোদ্ধা অর্থাৎ জনযুদ্ধের সৈনিকেরা নীরবে নিভৃতে যন্ত্রণাদগ্ধ হয়ে আজও দিনাতিপাত করছেন।
(৩০.০৭.২০১৯)
লেখক পরিচিতি:
কামাল লোহানী:
শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব