যে ব্যক্তিকে ১৯৮৮-র ২ ফেব্রুয়ারী পটুয়া কামরুল হাসান চিত্রিত করেছিলেন “বিশ্ব বেহায়া” নামে আর ঠিক তার আড়াই মাস আগে ১৯৮৭-র ১০ নভেম্বরে নূর হোসেন চিত্রিত করেছিলেন “স্বৈরাচার” নামে তিনি সে সময়ের বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
সেনা প্রধানের দায়িত্বে থাকাকালে তিনি ১৯৮২-র ২৪ মার্চ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকার হটিয়ে দেশের শাসনভার দখল করেছিলেন। প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেন। শুরু থেকেই অবৈধ এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে গণরোষ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ১৯৮৭-র ১০ নভেম্বরে সামরিক লেবাসে ক্ষমতা দখলকারী লেফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে সমাবেশে ঢাকার জিপিওর সামনে কর্মসূচি পালনে জীবন্ত পোস্টার হয়ে রাজপথে নেমে আসেন যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন। তাঁর বুকে-পিঠে উৎকীর্ণ ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগান। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অকুতোভয় সেই যুবকের অগ্নিঝরা স্লোগান সহ্য হয়নি তৎকালীন স্বৈরশাসকের। স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর নির্বিচার গুলি তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। সেদিনের সে গুলিতে আরো শহীদ হয়েছিলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটো।
১৯৮৭ সালে না হলেও নূর হোসেনদের দেখানো পথ ধরে ১৯৯০-র ৬ ডিসেম্বর নিপাত যায় সে সময়ের সেই স্বৈরাচারী শাসন। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সূচিত সে পথের যে পথে মুক্তি পাবে “গণতন্ত্র”।
বহু চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গত ৩১ বছর ধরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের একমাত্র হাতিয়ার “ভোট” প্রদানের আয়োজন হয়েছে প্রায় প্রতি ৫ বছরেই। অংশগ্রহণ করেছে জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। সেই একদার “স্বৈরাচার” হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টিও ভোট পেয়েছে, ক্ষমতায় থাকবার রি-এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। আর এর মধ্য দিয়ে নিজের আসনকে করেছে শক্তিশালী, থেকেছে ক্ষমতার দর কষাকষিতে এগিয়ে। উৎখাতের পর বিভিন্ন মামলায় ৫ বছর কারাগারে আটক থেকে এরশাদ একেএকে একটি ছাড়া আর সব ক’টি মামলা থেকে বের হয়ে এসেছেন। বিগত ১০ বছর ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করছেন। এমন কি তার দল জাতীয় পার্টি বর্তমান সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে।
কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই নির্বাচন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সত্যিই কি ৩১ বছরে মুক্তি পেয়েছে “গণতন্ত্র”? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক অংগগুলো কি পেয়েছে তার স্বকীয় অবয়ব? প্রশাসনের নানা প্রকোষ্ঠে কি সুশাসনের ন্যুনতম বিকাশ ঘটেছে? বিচার বিভাগ, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুদক, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ইত্যাদি কি স্বাধীনভাবে কাজ করবার পরিবেশ পেয়েছে? এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল দুর্নীতির সেই দুর্নীতি ৩১ বছরে পত্রপল্লবে ফুলেভেঁপে আজ মহীরুহের আকার নেয়নি কি? সে মহীরুহের শেকড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েনি কি দেশের আপামর জনগণ? জনগণের আশা আকাংখার কতটুকু সুরাহা হয়েছে এই ৩১ বছরে?
এ প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসবেই। কেননা আজও ভোটের দিন ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে “নিরপেক্ষ নির্বাচন”, “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড”, “নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা”, “সংসদ ভেঙ্গে দেয়া”, “সংলাপ”, “নির্বাচনকালীন সরকার”, “সেনাবাহিনীর ভূমিকা”, এমন হাজারও বিষয়ে আলোচনা শুরু হয় যা ৩১ বছর পরে কখনই কাম্য হতে পারে না। ৩০ লক্ষ আর গণতন্ত্রের জন্যে হাজারো শহীদের রক্তে পা দিয়ে যারা ক্ষমতার মসনদে বসেন তাদের জবাব দিতেই হবে এসমস্ত প্রশ্নের।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে নাকি কিছু নেই! তাই যুদ্ধাপরাধী বা স্বৈরাচারীর সাথে রাজনীতি করা যায়! আন্দোলন করা যায়! ক্ষমতা ভাগাভাগি করা যায়! তাহলে কি রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের কোন স্থান নেই? এই রাজনীতি কি জনগণের প্রত্যাশিত? জনগণের কল্যাণের কর্মপ্রক্রিয়ায় এই রাজনীতির ভূমিকা তবে কোন আঙ্গিকে?
এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুরূহ আজকের রাজনীতিতে। তবু সৌভাগ্য, নূর হোসেনদের রক্তের বিনিময়ে গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে “ভোটদান” প্রক্রিয়ার নিয়মিত আয়োজন সম্ভব হচ্ছে, হোক না তা একধরণের “আচার”। তবে “গণতন্ত্র” তার আচরণগত দিকগুলো অর্থাৎ গণতন্ত্রের আদপ বৈশিষ্ট যেমন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীন কর্মশক্তি, বিচার, প্রশাসন ও আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা, দুর্নীতিমুক্ত সরকারী-বেসরকারী কর্মপরিবেশ, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা লাভ না করা পর্যন্ত এটি কেবলই এক রাজনৈতিক ডগমা হিসেবেই কাজীর পুস্তকে রয়ে যাবে,
৩০ লক্ষ শহীদ আর নূর হোসেনদের রক্ত বৃথা যাতে না যায় তার লক্ষ্য অর্জনই হতে পারে একাদশ সংসদ নির্বাচনের মেনিফেষ্টো। প্রতি দলের ভাবনার মূলে আসুক জনগণের মুক্তির আকুতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত সংবিধানের ৪ মূলনীতি পূর্ণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই হোক না আগামী নির্বাচন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আরেকবার জয়ী হোক জনগণ, মুক্তি পাক গণতন্ত্র।
লেখক পরিচিতি:
সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা