মাষ্টারদা সূর্যসেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক। ১৯২৯ সালের মে মাস। চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের উদ্যোগে সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা রাজনৈতিক সম্মেলন, যুব সম্মেলন, ছাত্র- ছাত্রী সম্মেলন ও নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। এই সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। ছাত্র-ছাত্রী সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ছাত্র সংগঠন ‘অল বেঙ্গল ষ্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’ (বিপ্লবী অনুশীলন দল দ্বারা প্রভাবিত) ও ‘বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল ষ্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’ (বিপ্লবী যুগান্তর দল দ্বারা প্রভাবিত) ঐক্যবদ্ধ হল এবং তাঁরা প্রয়োজনে জীবনবাজী রেখে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিল। এই সম্মেলনগুলোতে চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। কল্পনা দত্তও অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবিকার দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে নারী সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবিকার দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে কল্পনা দত্তের রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। স্কুলজীবনের প্রারম্ভ থেকে তিনি ‘ক্ষুদিরাম’, ‘কানাইলালের জীবনী’, ‘পথের দাবি’ প্রভৃতি স্বদেশী বই পড়তে শুরু করেন। এই বইগুলি তাঁর অন্তরে স্বদেশপ্রেমের প্রেরণা যুগিয়েছিল।
ভারত উপমহাদেশের অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই অনেক নারী পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ‘অনুশীলন’, ‘যুগান্তর’ প্রভৃতি সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সঙ্গে ঘরে ঘরে নারীরা যুক্ত ছিলেন। তাঁরা গোপনে গোপনে বিপ্লবী দলের কাজ করতেন। অনেক পরিবারের মা-বোনরা বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন। আবার অনেকে টাকা-কড়ি, সোনা-গহনা দিয়ে বিপ্লবী দলকে সহযোগিতা করতেন। অগ্নিযুগের প্রথম পর্বে স্বর্ণ কুমারী দেবী, সরলা দেবী, আশালতা সেন, সরোজিনী নাইডু, ননী বালা, দুকড়ি বালা, পরবর্তীকালে ইন্দুমতি দেবী, (অনন্ত সিংহের দিদি) লীলা রায়, পটিয়া ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী প্রমুখ দেশপ্রেমিক নারী বিপ্লবী দলে যুক্ত ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় কল্পনা দত্তের আবির্ভাব। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত একটি অবিস্মরণীয় নাম।
বীরকন্যা কল্পনা দত্ত ১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার খরণদ্বীপ ইউনিয়নের শান্ত, সবুজ, পাহাড়ঘেরা শ্রীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালী হলেও বাবা বিনোদ বিহারী দত্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের সাব রেজিষ্টার হওয়ায় তাঁর শৈশব কাটে চট্টগ্রাম শহরে। মা সুভনা দত্ত ছিলেন গৃহিণী। শহরের প্রাণ কেন্দ্র আন্দরকিল্লায় তাঁদের বিশাল বাড়ি ছিল। শহরের নামকরা ডাক্তার রায় বাহাদুর দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন তাঁর দাদু ।
কল্পনা দত্তের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক লেখাপড়া শেষে তাঁকে ডা. খাস্তগীর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন তাঁর বাবা। বীরকন্যা প্রীতিলতাও এই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। কল্পনা দত্ত প্রীতিলতার এক ক্লাস নীচে পড়তেন। এই স্কুলে প্রতিটি শ্রেণীতে কল্পনা দত্ত প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ছিলেন।
ডা. খাস্তগীর স্কুলের শিক্ষিকা উষাদি ছাত্রীদের দেশ-বিদেশের গল্প শুনাতেন। কল্পনা দত্ত এই উষাদির সংস্পর্শে এসেই বিভিন্ন স্বদেশী বই পড়তে শুরু করেন। উষাদি ছিলেন স্বদেশীদের গোপন বিপ্লবী সহযোগী। তিনি মূলত কল্পনা দত্তের চেতনায় দেশপ্রেম ও বিপ্লবী রাজনীতির বীজমন্ত্র বুনে দেন।
১৯২৯ সালে কল্পনা দত্ত চট্টগ্রমের ডা. খাস্তগীর স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন। পরীক্ষা শেষ হলে তিনি উত্তাল চট্টগ্রামের নানা ঘটনার দিকে মন দেন। এসময় বিপ্লবী ধারার কয়েকটি বই পড়েন। পাড়া- প্রতিবেশীর কাছ থেকে বিপ্লবী রাজনীতি, স্বদেশী ডাকাতীর কিংবদন্তী ঘটনা শোনেন। কল্পনা দত্ত অঙ্কে ও সংস্কৃতে লেটারসহ চতুর্থ স্থান পেয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মেট্রিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার জন্য সরকার তাঁকে মাসে ১৫ টাকা বৃত্তি প্রদান করে। তাঁর পরিবার তাঁকে কলকাতায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বছরই তিনি আই.এস.সি.-তে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন।
বেথুন কলেজে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পর প্রীতিলতার সাথে পরিচয় ঘটে। যাঁকে কল্পনা দত্ত ডা. খাস্তগীর স্কুলের শিক্ষিকা উষাদির আলোচনার আড্ডায় প্রায়ই দেখতেন। বেথুন কলেজে পড়ার সময় সেই স্কুল জীবনের সুপ্ত দেশপ্রেমের বীজ কল্পনা দত্তের চেতনায় অঙ্কুরিত হয়। প্রীতিলতা আন্তরিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও ব্যবহারের মাধ্যমে মেয়েদেরকে খুব আপন করে নিতে পারতেন। প্রীতিলতা ওই একই কলেজে ইংরেজী সাহিত্যে বি.এ. পড়েন। থাকেন ছাত্রীনিবাসে। এখানে মাষ্টারদার নির্দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। গড়ে তোলেন এক বিপ্লবী চক্র। এই বিপ্লবীচক্রে অনেক মেয়ে সদস্য যোগ দেন। এই বিপ্লবীচক্রে কল্পনা দত্ত যুক্ত হলেন। এই চক্রের মূল কাজই ছিল বিপ্লবীকর্মী তৈরীর পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ করা। অর্থ সংগ্রহ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে পাঠাতেন।
একই সময় কল্পনা দত্ত কল্যাণী দাসের ‘ছাত্রীসংঘ’-এ যুক্ত ছিলেন। এসময় বেথুন কলেজে হরতাল পালন এবং অন্যান্য আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। দেশের মুক্তি সংগ্রাম, মাতৃভূমির স্বাধীনতা, নারীদের মর্যাদা রক্ষার জন্য বীর সন্তানদের আত্মত্যাগ ভাবিয়ে তোলে কল্পনা দত্তকে। তিনি প্রীতিলতার সাথে যুক্ত থেকে বিপ্লবী ধারার কাজ করতে করতে নিজেই বিপ্লবী কর্মী হয়ে যান। আর বিপ্লবী মনে মাস্টারদা সূর্যসেনের প্রতিষ্ঠিত তরুণ ও ছাত্রদের বিপ্লবী যুগান্তর দলে যোগ দেওয়ার আকাঙ্খায় উদ্বেল হয়ে ওঠেন। মেয়েদের বিপ্লবে অংশগ্রহণের অনুমতি চাওয়ার জন্য দেখা করতে চান সর্বাধিনায়ক সূর্যসেনের সাথে।
ওই একই সময় তিনি বিপ্লবী নেতা পুর্ণেন্দু দস্তিদারের সংস্পর্শে আসেন, যিনি ছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের একান্ত অনুগামী। পুর্ণেন্দু দস্তিদার ও প্রীতিলতার প্রভাবেই কল্পনা দত্ত বিপ্লবী দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম সম্মেলনের পর প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত কলকাতায় চলে যান। ওই সময় কলকাতায় বিপ্লবীদের এক গোপন কারখানায় তৈরি হত বোমার খোল। মাষ্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী সে বোমার খোল সংগ্রহ করেন প্রীতিলতা। ওই বছরের শেষের দিকে পূজার ছুটিতে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, সরোজিনি পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রবিত চট্টগ্রাম আসেন। মাষ্টারদার নির্দেশে তাঁরা বোমার খোলগুলো পৌঁছে দেন বিপ্লবীদের হাতে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮ এপ্রিল যুববিদ্রোহ বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাকে ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। যা ছিল দেড়শত বছরের ইতিহাসে ইংরেজদের জন্য খুবই অপমানজনক ঘটনা। এটা ছিল ইংরেজ বাহিনীর প্রথম পরাজয়। ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন কার্যত অচল ছিল। পরাধীন জাতির ইতিহাসে বিপ্লবীদের এ বিজয় ছিল গৌরবগাঁথা।
জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের পর মাষ্টারদা সূর্যসেন চলে যান আত্মগোপনে। মে মাসের প্রথম দিকে বিপ্লবে অংশ নিতে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে চলে আসেন। অনেক কষ্টে তাঁরা মাস্টারদার সাথে দেখা করতে সক্ষম হন। তাঁরা উভয়েই মাস্টারদার কাছে সশস্ত্র বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। মাস্টারদা তাঁদেরকে বিপ্লবী দলের শপথ বাক্য পাঠ করান। তখন থেকে তাঁরা বিপ্লবী দলের অধিনায়ক সূর্যসেনের নির্দেশ মতো কাজ করে যান। এসময় প্রীতিলতা চট্টগ্রাম নন্দনকানন বালিকা মধ্য ইংরেজি স্কুলে (বর্তমানে অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) শিক্ষয়িত্রীর হিসেবে চাকুরী নেন। আর কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম কলেজে বি.এস.সি.তে ভর্তি হন। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে গোপনে গোপনে চলতে থাকে বিপ্লবী দলের কার্যক্রম।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল, জালালাবাদ সম্মুখ সমর, কালারপোল, ফেনী, ঢাকা, কুমিল্লা, চন্দননগর ও ধলঘাটের বীরোচিত সংগ্রামের অধ্যায়গুলো মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের নতুন প্রেরণা যুগিয়েছিল।
ধলঘাটের সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন নিহত হওয়ার পর সারা চট্টগ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে মিলিটারী ও পুলিশের নির্যাতন শুরু হয় । তখন কল্পনা দত্ত পুরুষের পোশাক পরিধান করে তাঁদের আন্দরকিল্লার বাসা থেকে গোপন বিপ্লবী কেন্দ্র কাট্টলী যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু পথে আটকা পড়েন। পাহাড়তলী স্টেশনের পাশে ভেলুয়ার দীঘির কোনায় কিছু গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলের সহায়তায় পুলিশের হাতে বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক কারাজীবন শুরু হয়। ১৯৩১ সালের মে মাসে ছাড়া পাওয়ার পর কলকাতা থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক দ্রব্য কৌশলে নিয়ে আসার দায়িত্ব পান । ডিনামাইট ফিউজ দিয়ে চট্টগ্রাম আদালত ভবন ও কারাগার উড়িয়ে দিয়ে বিচারাধীন বিপ্লবীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর ।
১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে এক বিশেষ আদালতে (ট্রাইব্যুনালে) আরম্ভ হয় রাজদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জন বন্দির বিচার (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল)। মাস্টারদা বন্দিদের মুক্ত করার জন্য এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করা এবং একই সাথে আদালত ভবন ধ্বংস করার উদ্যোগ নেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কল্পনা দত্ত। হামলার দিন ধার্য করা হয় ৩ জুন, ১৯৩১ সাল। সব প্রস্তুতিও গোপনে সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে সর্বশেষ মাইনটি বসানোর সময় পুলিশের নজরে পড়ে যাওয়ায় গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।
এ ঘটনায় পুলিশ কল্পনা দত্তকে সন্দেহভাজন রূপে তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁকে শুধু চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে বি.এস.সি. পড়বার অনুমতি দেওয়া হয়। পুলিশের এই কড়া নজরদারির মধ্যেও কল্পনা দত্ত প্রায়ই গভীর রাতে সূর্যসেন, নির্মল সেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের গোপন আস্তানায় যেতেন এবং সেখানে বিপ্লবী কাজের প্রশিক্ষণ নিতেন। এখানে তিনি এবং তাঁর সতীর্থ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নিয়মিত রিভলভার চালানোও শিখতেন। একদিন দুজনকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেবার সিদ্ধান্ত নেন মাস্টারদা। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে যৌথ নেতৃত্ব দেবার কথা ছিল তাঁদের দুজনের। কিন্তু তার পূর্বেই পুরুষের ছদ্মবেশে সহকর্মী নির্মল সেনের সঙ্গে মাস্টারদার কাছে দেখা করতে যাবার সময় পুলিশ কল্পনা দত্তকে গ্রেফতার করে। দুই মাস জেলে থাকার পর প্রমাণাভাবে তিনি জামিনে মুক্ত হন। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ১০৯ ধারায় অর্থাৎ ‘ভবঘুরে’ বলে মামলা দায়ের করেছিল। পুলিশের সন্দেহ দৃষ্টি এড়াতে তাঁকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন মাস্টারদা। এরপর কল্পনা দত্ত মাস্টারদার নির্দেশে আত্মগোপন করেন এবং তাঁরই সঙ্গে গৈরালাতে ক্ষীরোদপ্রভাব বিশ্বাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন। গোপন অবস্থাতেই তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

দেশ ভাগের আগে ও পরে বাংলাদেশের গ্রামে কৃষিকাজ উন্নয়নে কাজ করেন কল্পনা দত্ত
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য দুইবার ব্যর্থ বিপ্লবী শৈলশ্বর চক্রবর্তীর আত্মহত্যার পর মাস্টারদা ১৯৩২ সালে বিপ্লবী প্রীতিলতাকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের ভার অর্পণ করেন। এই কারণে সূর্যসেন কাট্টলীর গোপন ক্যাম্পে আসেন। প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত দেখা করতে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে আলাপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। প্রীতিলতা নিরাপদে গোপন কেন্দ্রে পৌঁছে গেলেও পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ১৯৩২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ধরা পড়েন। মাস্টারদা সূর্যসেন খবর পেয়ে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতাকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করার অনুমতি দেন । জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিমে দেব পাহাড়ে আবার আত্মগোপন করেন কল্পনা দত্ত। তিনি তখন বি.এস.সি.-র ছাত্রী। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী সমুদ্রতীরবর্তী গৈরালা গ্রামে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গী ছিলেন তিনি। পরে মাস্টারদা ও ব্রজেন সেন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু তিন মাস পর ১৯ মে গৈরালা গ্রামে এক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা দত্ত এবং তাঁর সতীর্থ কয়েকজন বিপ্লবী ধরা পড়েন।
ওই বছর ১৪ আগস্ট একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দেয় এবং অন্যদেরকে আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার (‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেস’) দ্বিতীয় বিচার পর্বে কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। জেলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি পড়াশোনা করতেন।
১৯৩৮-এর প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে এলেন জেলে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে, জানালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ওঁর বাবাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা ছোট্ট চিঠি দেখালেন, ‘‘তোমার কন্যার জন্যে যা আমার সাধ্য তা করেছি, তার শেষ ফল জানাবার সময় এখনো হয়নি, আশাকরি, চেষ্টা ব্যর্থ হবে না’’। রবীন্দ্র বন্ধু সি এফ এন্ডরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য অপরিসীম পরিশ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গভর্নরের কাছে গিয়েছিলেন এবং কল্পনার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন ‘‘কল্পনা যেদিন মুক্তি পাবে সেদিন যেন তাঁকে টেলিগ্রাম করা হয়”।
মহাত্মা গান্ধী কল্পনার বাবাকে সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে চেষ্টা করেন। তৎকালীন বাংলার স্বরাষ্ট্রসচিব খাজা নাজিমুদ্দিন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার বন্দীদের ছেড়ে দিতে একেবারেই নারাজ ছিলেন। তথাপি ১৯৩৯ সালের ১লা মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
প্রায় ৬ বছর কারাভোগের সময় তাঁর মামলা চালাতে গিয়ে বাবা সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের উত্তরে যে বড় দোতলা বাড়ি (রায় বাহাদুর ডা. দুর্গাদাস দত্তের বাড়ি) ছিল তাও হারাতে হয় তাঁকে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামে গিয়ে দেখেন প্রাক্তন বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টি যে পথে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে, সেই পথই ঠিক মনে হওয়ায় কল্পনা দত্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় চট্টগ্রামে থেকে তিনি কাজ করেছেন। সেই সময় পিপলস ওয়ার পত্রিকায় তাঁর বহু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে । ১৯৪০ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশ তাঁকে স্বগৃহে অন্তরীণ রাখে। এরপর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেন।
১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ওই বছর মুম্বাইতে এক সম্মেলনে কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানেই পি.সি. যোশীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৪ সালে যোশীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পিসি যোশী তদানীন্তন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তাঁর লেখাগুলি গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। এরপর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে যান এবং দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে গড়ে তোলেন। সেই পশ্চাৎপদ যুগেও কল্পনা দত্ত অনুভব করেছিলেন, নারীরা সমাজেরই অর্ধ-অঙ্গ। নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসেই কাটবে অমানিশা, আসবে মুক্তি। ১৯৪৬ সালে আইনসভার নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে প্রার্থী হিসেবে ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে পরাজিত হন কংগ্রেস প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার কাছে।

দুইপুত্র সুরুজ ও চাঁদের সাথে কল্পনা দত্ত
দেশ ভাগ হওয়ার পরও অনেকদিন তিনি চট্টগ্রামেই থেকে যান। ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে চাকরি নেন এবং পরবর্তী সময়ে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি নানাবিধ কাজের সাথে যুক্ত হন। তিনি এসময় বেশ কয়েকটি ভাষা শিখেছিলেন। এর মধ্যে রুশ ভাষাও শেখেন। ভাষাবিদ হিসেবেও তিনি পরিচিতি লাভ করেন। রুশ ভাষায় শিক্ষকতা করেন এবং নতুন দিল্লির রুশ ভাষা কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন। কল্পনা দত্তের লেখা বইয়ের নাম ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’।
ভারতের নারী আন্দোলনে তিনি ভূমিকা রাখেন। কল্পনা দত্ত নারী সমিতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের মৈত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ’-এর সাধারণ সম্পাদিকাও ছিলেন।
১৯৪৫-এ ‘চিটাগাং আর্মারি রেইডার্স রেমিনিসেন্স’ প্রকাশিত হয় বোম্বাই থেকে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৯০ সালে ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কল্পনা দত্ত নানাভাবে সহযোগিতা করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ ও খাবার সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে অন্যান্য বিপ্লবী কমরেডদের সাথে কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামে আসেন। সেখানে ‘মিউনিসিপ্যাল স্কুল’ প্রাঙ্গণে বিপ্লবী দলকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন শেষ করতে পারেননি। তাঁর জীবনের স্মৃতিকথার প্রায় তিন হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিটিও হারিয়ে ফেলেছিলেন যা ইতিহাসের এক বিরাট ক্ষত হয়েই রয়ে গেল।
আমৃত্যু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পি সি জোশী ও কল্পনা দত্ত (বিবাহোত্তর কল্পনা জোশী) দম্পত্তির দুই ছেলে- সুরুজ জোশী এবং চাঁদ জোশী। এরা দুজনেই পরবর্তী জীবনে সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন।
কল্পনা দত্ত শেষ জীবন পর্যন্ত অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। জীবনসায়াহ্নে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার স্মৃতিভ্রংশ হয়। পাঁচ মাস চিকিৎসাধীন থেকে ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানী মেমোরিয়াল (SSKM) হাসপাতালে কল্পনা দত্ত যোশীর ৮২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় এই বীরকন্যার।
তথ্যসূত্র:
১. স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম: পূর্ণেন্দু দস্তিদার, প্রকাশকাল ১৩৭৪ বাংলা, প্রকাশক: চট্টগ্রাম বই ঘর।
২. গুণীজন – http://www.gunijan.org
৩. স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত। প্রকাশকাল ১৯৯০ সাল, কলকাতা
৪. গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন, মাহাফুজা খানম ও তপন কুমার দে। প্রকাশক: ডা. মাহফুজ শফিক, প্রকাশকাল: ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০৯।
৫. বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়, রাখী চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশকাল ২০০৫, কলকাতা
লেখক পরিচিতি:
সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা