মোতাহার হোসেন ছিলেন সেই আদর্শে অনুসারী যা তাঁকে চোখ বন্ধ করে অন্যের কথা শুনতে বা শুনলেও তা বিশ্বাস করতে দেয়নি । চোখ মেলে সত্যিকারের জীবনকে অনুভব করতে চাইতেন তিনি। ধর্মান্ধতা বা কুসংস্কারের কোনো স্থান ছিল না তাঁর কাছে। কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন।
১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারী কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন, কাজী মোতাহার হোসেন উদ্যোগে ঢাকায় গড়ে ওঠে প্রগতিশীল সাহিত্য-সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের বার্ষিক মুখপত্র ছিল ‘শিখা’। শিখার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে সম্পাদক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। শিখাগোষ্ঠীর শিখারা স্বপ্ন দেখতেন বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীন চর্চা করার সুযোগ দেয় এমন প্রগতিশীল সমাজ কাঠামো তৈরি করার ।
প্রগতিশীলতার চর্চা করতে গেলে, প্রচলিত নষ্ট সমাজব্যবস্থার সংস্কার চাইলে ধর্মান্ধ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা খড়গ হাতে নেমে পড়েছে সব যুগেই। শিখাগোষ্ঠীও এর বাইরে ছিল না। কাজী আবদুল ওদুদ বা আবুল হোসেনদের মতো ধর্মান্ধদের রক্তচক্ষুর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে কাজী মোতাহার হোসেনকেও। তবু মোতাহার হোসেন বলে গেছেন,
আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে চাই না – আমরা চাই বর্তমান মুসলমান সমাজের বদ্ধ কুসংস্কার এবং বহুকাল সঞ্চিত আবর্জনা দূর করিতে।
কাজী মোতাহার হোসেন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, ধর্মান্ধ ছিলেন না। ১৯৬৬ সালে সস্ত্রীক হজ্জব্রতও পালন করেন তিনি। মোতাহার হোসেন যা বিশ্বাস করতেন, মোতাহার হোসেন যে স্বপ্ন দেখতেন- কোনো ভণ্ডামি না করেই তিনি তা বলতে পারতেন। ব্যক্তিজীবনে এভাবে সততা এবং সরলতার চর্চা করার মানুষ এ সমাজে বিরল।
সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে যখন রাষ্ট্রভাষা চাপিয়ে দেয়ার, ভাষা-সংস্কার, হরফ-পরিবর্তনের (বাংলা ভাষাকে উর্দু হরফে লেখার) চক্রান্ত চলছিল, ধর্মকে পুঁজি করে অযৌক্তিক রবীন্দ্রবিরোধিতা তুঙ্গে উঠেছিল, তখন সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। রাষ্ট্রভাষা, ভাষা-সংস্কার, হরফ পরিবর্তন, রবীন্দ্র বিরোধিতা প্রভৃতি প্রসঙ্গে তিনি তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ করেছেন বরাবর।
রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেনের বক্তব্য ছিল সর্বপেক্ষা বৈপ্লবিক, স্পষ্ট ও নির্ভীক। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত তাঁর স্পষ্টভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যায় তিনি বলেছিলেন, ‘…পূর্ব পাকিস্তানের রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা বাংলাই হওয়া স্বাভাবিক এবং সমীচীন। কোনও কোনও পরমুখাপেক্ষী বাঙালীর মুখেই ইতোমধ্যে উর্দুর ঝংকার শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এদের বিচারবুদ্ধিকে প্রশংসা করা যায় না।’
তিনি এটাও বলেছিলেন যে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে তা থেকে সৃষ্ট অসন্তোষে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরবর্তীতে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়।
সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুবের সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলা নববর্ষকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার দাবি জানান। ঢাকায় প্রথমবারের মতো তাঁর সভাপতিত্বে বিখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানচর্চার উপর যখনই আঘাত এসেছে তখনই প্রতিবাদ করেছেন কাজী মোতাহার হোসেন।
তিনি সকলকে সাবধান করেছিলেন সাহিত্য হিন্দুকরণ বা ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন,
‘জলকে পানি বলে উল্লেখ করলে সাহিত্যের জাত যাবে না – জাত যাবে যদি জল চৌকিকে পানি চৌকি, পানি পথকে জলপথ; জলযোগকে পানি যোগ, জল পানিকে পানি পানি বা পানি প্রার্থীকে যদি জলপ্রার্থী করা হয়।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, জাতীয় অধ্যাপক, দাবাগুরু, জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেন ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই (১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১৪ শ্রাবণ) শুক্রবার তৎকালীন নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার ভালুকা (বর্তমান কুমারখালী) থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। তাঁর পিতা কাজী গওহরউদ্দীন ও মাতা তসিরুন্নেসা। চার পুত্র ও চার কন্যার মধ্যে তিনি পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। পিতা গওহরউদ্দীন প্রথম সেটেলমেন্টের আমীন ছিলেন। পরে হেড আমীন, আরও পরে আমীনদের ইন্সপেক্টর ছিলেন।
কাজী মোতাহার হোসেনের পূর্ব পুরুষ মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দিল্লী দরবারের ধর্মীয় উপদেষ্টা ও বিচারক (কাজী) পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর জৌনপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। প্রখ্যাত আলেম, ধর্ম ও সমাজ সংস্কারকদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। এরপর মির্জাপুর, বাগেরহাট (খুলনা) হয়ে প্রায় দুই শতাব্দী পূর্বে তাঁর এক পূর্বপুরুষ কাজী আতাউল্লাহ নিকটবর্তী বাগমারা গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন।
কাজী মোতাহার হোসেন লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় বাগমারা গ্রামে তাদেরই পারিবারিক খানকার মক্তবে। এরপর তিনি মামাবাড়ি লক্ষ্মীপুরের নিকটবর্তী যদুবয়রা নিম্ন প্রাইমারি স্কুলে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করে আবার বাগমারার নিম্ন প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন এবং ১৯০৭ সালে মাসিক দুই টাকা বৃত্তিসহ নিম্ন প্রাইমারি পাস করেন।
গণিতের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। একদম ছোটবেলায় তাঁর ছোট চাচা কাজী আবুল হোসেন তাঁকে যোগ-বিয়োগ ও গুণের পদ্ধতি শেখান, আর ছোট্ট মোতাহার নিজে নিজেই ভাগ শিখে চাচাকে অবাক করে দেন।
১৯০৯ সালে তিনি কুষ্টিয়ার উকিল রাইচরণ দাস প্রতিষ্ঠিত সেনগ্রাম মাইনর স্কুল থেকে বৃত্তিসহ উচ্চ প্রাইমারি পাস করেন। ১৯১১ সালে তিনি কুষ্টিয়া এইচ, ই, স্কুলে (১৮৬১ সালে স্থাপিত) ফোর্থ ক্লাসে (বর্তমান সপ্তম শ্রেণী) ভর্তি হন। তিনি ১৯১৫ সালে এই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মাসিক পনেরো টাকা হারে প্রাদেশিক বৃত্তি লাভ করেন। তিনি এই পরীক্ষায় রাজশাহী ডিভিশনে সর্বমোট নম্বরে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কুষ্টিয়া হাইস্কুলে পাঠ গ্রহণ তার ভবিষ্যত জীবন, মানস-গঠন ও কর্মের একটি বিরাট প্রেরণা। ১৯১৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএসসি, ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু তাকে দ্বিতীয় বর্ষে রাজশাহী কলেজে চলে আসতে হয়। ১৯১৭ সালে তিনি চতুর্দশ স্থান অধিকার করে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন এবং মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তিলাভ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। বিএ পরীক্ষাতে তিনি পূর্ববঙ্গ ও আসাম জোনে প্রথম স্থান দখল করে মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তিলাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান দখল করে এমএ পাস করেন। উল্লেখ্য, এই বছর কেউ প্রথম স্থান পায়নি।
একজন আপাদমস্তক সঙ্গীতানুরাগী মানুষ ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। কুষ্টিয়ায় স্কুলে পড়ার সময় থেকে তাঁর সঙ্গীতচর্চা শুরু হয়। পরে ১৯১৭-১৮ সালে তিনি বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ হাকিম মোহাম্মদ হোসেনের কাছে দু’বছর টপ্পা, ঠুমরি ও খেয়াল শেখেন। পরে এঁর কাছেই বছর তিনেক সেতারের তালিমও নিয়েছিলেন।
কাজী মোতাহার হোসেন ১৯২০ সালের ১০ অক্টোবর কলকাতার মোহাম্মদ ফয়েজুর রহমান ও মুসলিমা খাতুনের কন্যা সাজেদা খাতুনের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। কাজী দম্পতির ৪ পুত্র ও ৭ কন্যার মধ্যে বর্তমানে তিন কন্যা ও এক পুত্র জীবিত। পুত্র-কন্যাদের সকলেই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও ছায়ানটের সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ফাহমিদা খাতুন, রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুই খ্যাতনাম শিল্পী। সবচেয়ে ছোট মেয়ে মাহমুদা খাতুনও একজন জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এবং পেশায় চিত্রশিল্পী ছিলেন। কাজী আনোয়ার হোসেন জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’ রচয়িতা।
ছেলেবেলার শিক্ষকদের মধ্যে জ্যোতিন্দ্রমোহন রায়ের কথা আজীবন বলেছেন কাজী মোতাহার হোসেন। জ্যোতিন্দ্রমোহন রায়ে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, উদারমনা একজন শিক্ষক। এই মানুষটির আদর্শ-শিক্ষা তাঁকে সারাজীবন অনুপ্রাণিত করেছে। এমনকি তাঁর সাহিত্যের হাতেখড়িও হয় জ্যোতিন্দ্রমোহন রায়ের হাত ধরেই। কুষ্টিয়ার রথযাত্রা উপলক্ষে রচনা লেখা প্রতিযোগিতা হয়। সেবার জ্যোতিন্দ্রমোহন রায়ের উৎসাহে রচনা লিখে প্রথম হলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সেই থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু।
ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয় ‘সওগাত’ পত্রিকায়। সেটা ছিল এক বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ- ‘গ্যালিলিও’। এরপর আর থেমে থাকেননি মোতাহার হোসেন। লেখালেখির প্রথমদিকে তিনি বিদ্যাসাগরীয় ও বঙ্কিমী স্টাইলে লিখতেন; রবীন্দ্র প্রভাবও ছিল তাঁর উপর। কিন্তু পরবর্তীতে লেখালেখির জগতে তিনি তাঁর নিজস্ব স্টাইল নিয়ে আসেন, যা ছিল প্রাঞ্জল এবং সহজবোধ্য। নিজের লেখা নিয়ে তিনি বলেছেন, “আমার রচনায় যা কিছু জটিলতা তা ভাবের, ভাষার নয়।” তাঁর ভাষার এই স্পষ্টতাই তাঁর স্বকীয়তা। কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ে অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তার একমাত্র প্রবন্ধ-গ্রন্থ ‘সঞ্চরণ’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী. উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকগণ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ১৩৪৪ সালের ২ ভাদ্র কাজী মোতাহার হোসেনকে লিখিত এক পত্রে সঞ্চরণ গ্রন্থে লেখকের স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বিচিত্র ভাব ও নানা আলোচনার বিষয় উপস্থাপনের স্বকীয়তা, সাহস ও অধ্যবসায়ের উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
তাঁর লেখা নিবন্ধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
অসীমের সন্ধানে
কবি ও বৈজ্ঞানিক
আনন্দ ও মুসলমান গৃহ
সঙ্গীতচর্চা ও মুসলমান
নাস্তিকের ধর্ম
মানুষ মোহাম্মদ
ভুলের মূল্য
লেখক হওয়ার পথে
তার লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
সঞ্চয়ন (১৯৩৭) (প্রবন্ধ সংকলন)
নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫)
সেই পথ লক্ষ্য করে (১৯৫৮)
সিম্পোজিয়াম(১৯৬৫)
গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০)
আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪)
নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৭৬)
প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ-১৯৬৫)
কাজী মোতাহার হোসেনের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। ১৯২১ সালে কলকাতায় তাঁদের প্রথম পরিচয়। ১৯২৫ সালে নিখিল ভারত দাবা প্রতিযোগিতার ব্যাপারে দু’জনের সম্পর্ক নিবিড় হয়। সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব পুরোপুরি পাকা হলো ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য ঢাকায় এলে নজরুল দীর্ঘদিন কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) নিচের তলার বাসাতেই অবস্থান করতেন। মোতাহার হোসেনকে লেখা নজরুলের চিঠিপত্র তাদের দু’জনের গভীর সৌহার্দ্যরে পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর দাড়িকাটা উপলক্ষে নজরুল ‘দাঁড়ি-বিলাপ’ নামে একটি দীর্ঘ কৌতুক কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর ‘নজরুল-কাব্য পরিচিতি’ গ্রন্থটি (১৯৫৫) তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে নজরুল চর্চার প্রারম্ভিক প্রচেষ্টা হিসেবে বিশেষ মূল্যবহ।বিভিন্ন চিঠিতে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ‘মোতিহার’ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁদের সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল যে, মোতাহার হোসেনের দাড়ি-কাটা নিয়ে নজরুল ‘দাড়ি-বিলাপ’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতাও লিখেছিলেন। কবি নজরুলের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার আরেকটা বড় কারণ ছিল দুজনেরই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথেও মোতাহার হোসেনের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমনকি শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটিও মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতারই ফসল।
পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যান- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগেই অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ছাত্র। তিনি তাঁর ‘নজরুল কাব্য পরিচিতি’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন প্রিয় শিক্ষক প্রশান্তচন্দ্রকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বোস-আইনস্টাইন থিওরির জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর লেখা ‘তথ্য-গণিত’ বইটি সত্যেন বোসকে দেখানোর জন্য কলকাতায়ও গেছিলেন। আরো অনেকের সামনে সে বইয়ের ভূমিকা পড়ে বোস বলেছিলেন, “দেখ! তোমরা কেউ লিখতে পারতে? পারতে না। এ আমার ছেলে!” শুধু তা-ই নয়, সত্যেন বোস তাঁর জীবনের শেষ চিঠিটিও লিখেছিলেন মোতাহার হোসেনকে।
১৯৫০ সালে ‘Design of Experiments’ বিষয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাজী মোতাহার হোসেন ডক্টরেট (পিএইচ.ডি.) ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর থিসিসের পরীক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ স্যার রোনাল্ড ফিশার। তিনিও তাঁর এই গবেষণাপত্রের উচ্চ প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে মোতাহার হোসেনের উদ্ভাবিত একটি পদ্ধতি সংখ্যাতত্ত্বশাস্ত্রে (Statistics) ‘Hussain’s Chain Rule’ নামে পরিচিতি পায়।
মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার তাগিদ সবসময়ই অনুভব করেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সে চিন্তা থেকেই রচনা করেন ‘তথ্য-গণিত’, ‘গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস’, ‘আলোক-বিজ্ঞান’ নামের বইগুলো। বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের বিখ্যাত ‘কোয়ান্টাম-থিওরি’ সম্পর্কিত প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন এবং তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়।
কাজী মোতাহার হোসেন আরো যে কারণে বিখ্যাত ছিলেন সেটি হলো দাবা। ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি কাজী মোতাহার হোসেনের বিশেষ অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। ছাত্রজীবনেই তিনি ফুটবল, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবা ও সাঁতার এ বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তাঁর দাবা খেলা সম্পর্কে অনকে গল্প প্রচলিত আছে। তাঁর দাবা খেলার সঙ্গীদের মধ্যে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র, কবি নজরুল, সতীশচন্দ্র, কিষাণলাল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কাজী মোতাহার হোসেন। ১৯২৫ সালে স্টেটসম্যান পত্রিকার মাধ্যমে ‘অল ইন্ডিয়া ড্রেস ব্রিলিয়েন্স প্রতিযোগিতায় মোট ১০৩ নম্বরের মধ্যে ১০১ নম্বর পেয়ে প্রথম হন। সেই সময় তিনি ভারতীয় দশজন প্রথম শ্রেণীর দাবা খেলোয়াড়ের মধ্যে অন্যতম বিবেচিত হন। তিনি ১৯২১ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৪০ বছর অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের একক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। ১৯৫১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত লন টেনিস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। গ্র্যাণ্ডমাস্টার কাজী মোতাহার হোসেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন। ফুটবল, টেনিস, হাই জাম্প, সাঁতার এবং ব্যাডমিন্টনেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল। ১৯৫১ সালে ঢাকায় লন টেনিস প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন হন।
১৯৩৮ সালে কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশনে মনশাখার সভাপতি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার মোতাহার হোসেনকে ‘সিতারায়ে ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা অনুষ্ঠিত ‘পাকিস্তান সায়েন্স কনফারেন্সর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট (ডি, এসসি) ডিগ্রী প্রদান করা হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে। ১৯৭৫ সালে কুমিল্লার একটি সংস্থা তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীনচিন্তা নিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রের অগ্রগামী ও অন্যতম প্রতিভা কাজী মোতাহার হোসেনকে ১৯৭৭ সালে ‘নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক’ প্রদান করা হয়। তিনি নজরুল একাডেমির আজীবন সদস্য ও কলেজ অব মিউজিকের সভাপতি ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাহিত্য পত্রিকা ও বাংলা একাডেমি পত্রিকা উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১৫ জুলাই তাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের সম্মানীয় আজীবন সদস্যপদ প্রদান করা হয়। তাঁকে ১৯৭৯ সালে ‘স্বাধীনতা পুরষ্কার’ প্রদান করা হয়।
এই অসাম্প্রদায়িক মহৎ মানুষটি ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর, ঈদের দিন মারা যান।
বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীন চর্চা ও বুদ্ধির মুক্তিই ছিল তাঁর কাম্য ও লক্ষ্য তাই কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছিলেন,
‘আমরা চক্ষু বুজিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাই না, আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ-আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান-শিক্ষাবস্থায় অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সত্যকে কুহেলিকা মুক্ত করে, ভাস্বর ও দীপ্তমান করিতে। আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে চাই না – আমরা চাই কর্মস্রোতে ঝাঁপ দিয়া ইসলামের ভবিষ্যতকে মহিমান্বিত করিতে।’
তথ্যসৌজন্য:
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেন – দৈনিক জনকন্ঠ
কাজী মোতাহার হোসেন জীবন ও সৃষ্টি – আবুল হাসান চৌধুরী সম্পাদিত, নবযুগ প্রকাশনী
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা