“জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন আমাদের দেশে আছে, জোরেশোরেই আছে, তবে প্রাণিজগতের দিকে পক্ষপাত অধিক, উদ্ভিদজগৎ অপেক্ষাকৃত অবহেলিত। বনরক্ষা বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, তবে একক প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকানো আর বনরক্ষা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন প্রতিটি বিপন্ন প্রজাতি বাঁচানোর দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতিপ্রেম। এখানে ভালোবাসা মুখ্য, বৈষয়িকতা গৌণ, যা আমাদের মনে আজও তেমন নিবিড় ও গভীর নয় ”
কথাগুলো বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মার। যিনি আমাদের কাছে প্রকৃতিবিদ ও বিজ্ঞান লেখক হিসেবে পরিচিত। তিনি যেখানেই গেছেন, নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন প্রাণ ও প্রকৃতির রূপের সন্ধানে। পৃথিবী থেকে ঘাস-পাতা-ফুলের বিলুপ্তি নিয়ে তিনি ভাবতেন, কষ্ট পেতেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন, তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ে তোলায় সবাইকে সম্পৃক্ত করতে আজীবন প্রচার চালিয়ে গেছেন। তিনি বলতেন,
“মানুষ বাড়ছে, তাদের চলার পথে তাদের পদভারে মরে যাচ্ছে অনেক তরুপল্লব।
জনসংখ্যা কমানো না গেলে তরুপল্লবকে বাঁচানো যাবে না।”
নিসর্গপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মার জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মে, ব্রিটিশ ভারতের সিলেট জেলার মৌলভীবাজারের বড়লেখার শিমুলিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিলেন ওই অঞ্চলের বিখ্যাত কবিরাজ, তাঁর বাড়িটি আজো কবিরাজ বাড়ি বলে পরিচিত। মায়ের নাম মগ্নময়ী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিজেন্দ্র শর্মা(দ্বিজেন শর্মা) ছিলেন পঞ্চম। অন্যরা হলেন, প্রভাতকুমার শর্মা, মৃণালিনী দেবী, বলরাম শর্মা, প্রভাবতী দেবী (মিঠু) ও সন্ধ্যারানী দেবী (খুকি)।

বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা
দ্বিজেন্দ্র শর্মার ডাকনাম ছিল খোকা। খোকার পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন সেখানকার পিসি হাইস্কুলে। নবম শ্রেণিতে উঠে ভর্তি হন করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে, সে-সময় করিমগঞ্জ ছিল আসামের একটি মহকুমা। ভারতবিভাগের বছর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে সেই স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর করিমগঞ্জ কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। কলেজটি তাঁর ভালো লেগে যায়; কিন্তু গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় উচ্চতর গণিত নিয়ে। এই বিষয়টার মাথামুণ্ডু কিছুই তাঁর মাথায় ঢোকে না। কিন্তু গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত করিমগঞ্জ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখলেন, ত্রিপুরার আগরতলায় মহারাজা বীরবিক্রম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক নয়। ওই কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। তিনি করিমগঞ্জ কলেজ থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে আগরতলায় গিয়ে মহারাজা বীরবিক্রম কলেজে ভর্তি হলেন। সেখান থেকেই ১৯৪৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর মায়ের আদেশে কলকাতা গিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়বেন বলে। যেদিন কলকাতা পৌঁছেন তার আগের দিনই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার শেষ সময়সীমা পেরিয়ে যায় বলে চিকিৎসাবিজ্ঞান আর পড়া হলো না তাঁর। ভর্তি হলেন বিএসসিতে, তা-ও নামী কোনো কলেজে নয়, কলকাতা সিটি কলেজে, এবং অনার্স ছাড়াই। তাঁর ভাষ্যে,
‘অনার্স যে নেওয়া যায়, আমার সে বুদ্ধিও ছিল না। গ্রাম থেকে কলকাতা গেছি, প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম জানতাম না, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের নাম পর্যন্ত জানতাম না, এমনই গেঁয়ো ছিলাম। তবে ভালো যে ডাক্তারিতে ভর্তি হইনি। ভর্তি হলে সর্বনাশ হতো। কারণ, কলকাতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ার আর্থিক সামর্থ্য আমার পরিবারের ছিল না, ভর্তি হতে পারলেও মাঝখানে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হতো।’
সিটি কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে বিএসসি পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলকাতা ত্যাগ করেন। বাড়ি ফিরে যান, তখন করিমগঞ্জ কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানের একজন ডেমোন্স্ট্রেটর প্রয়োজন ছিল। তিনি সেই চাকরিটা পান। কিন্তু দেড় বছর চাকরি করার পর একঘেয়ে বোধ হয় তাঁর, চাকরি ছেড়ে দিয়ে মার্কসবাদী বইপত্র পড়া শুরু করেন। অবশ্য তাঁর মার্কসবাদের দীক্ষা ঘটে কলকাতা সিটি কলেজে পড়ার সময়ই। তখন বামপন্থি বইপত্র পড়েছিলেন প্রচুর। বাম রাজনীতির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় ও মেলামেশাও হয় অনেক। গড়ের মাঠে দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তৃতা শুনতেন। একদিন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতাও শুনেছিলেন।

বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা
তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়া হতো। তাঁর বাবা ও বড় ভাই ছিলেন একাধিক সাময়িকপত্রের গ্রাহক। একদিন আজাদ পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়ে, ‘বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ উদ্ভিদবিজ্ঞানের একজন ডেমোন্স্ট্রেটর চায়।’ তখন তিনি জানতেন না বরিশাল কোথায়। কোনো দিন বাংলার মানচিত্র খুলে দেখেননি। তাঁরা দেখতেন আসামের মানচিত্র। পত্রিকায় সেই বিজ্ঞাপন পড়ার পর খুলে বসলেন বেঙ্গলের ম্যাপ। দেখলেন, বরিশাল বঙ্গোপসাগরের কাছে। পাহাড়ের সন্তান কোনো দিন সমুদ্র দেখেননি। তাই ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। টেলিগ্রামও চলে এলো, ‘আপনি অবিলম্বে এসে কাজে যোগদান করুন।’ তিনি বরিশাল গিয়ে সমুদ্র খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথায় সমুদ্র? বঙ্গোপসাগর বরিশাল থেকে অনেক দূরে। তবু তিনি আর বরিশাল থেকে ফিরে এলেন না। বরং জীবনানন্দ দাশের ওই শহরের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য গড়ে উঠল।

বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা
১৯৫৪ সালে ব্রজমোহন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ডেমোন্স্ট্রেটর হিসেবে যোগ দিলেন। ডেমোন্স্ট্রেটরের কাজে তাঁর মন ভরেনি। যদিও হাতেকলমে উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়াতে তাঁর ভালো লাগত, তবু শুধু ব্যবহারিক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করা একধরনের অসম্পূর্ণ কাজ বলে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তাঁর ইচ্ছে ক্লাসে লেকচার দেওয়ার। কিন্তু ডেমোন্স্ট্রেটরদের দায়িত্বের মধ্যে সেটা নেই। কলেজের প্রভাষক হতে হলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারী হতে হবে। তাই করিমগঞ্জ কলেজ ও বরিশালের বিএম কলেজে মোট চার বছর ডেমোন্স্ট্রেটরের চাকরি করার পর তিনি ঢাকা এসে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন, ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু বিএম কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে চিরতরে হারাতে চায় না। তারা তাঁকে বলল, তিনি যেন মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার পরে আবার ওই কলেজে ফিরে যান। তাঁকে ফিরে পাওয়ার জন্য তারা একটা কৌশলও অবলম্বন করল : দ্বিজেন শর্মা যতদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন, ততদিন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ৫০ টাকা মাসোহারা দেবে। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়াশোনা শুরু করার পর তাঁর মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। সে-সময় ঢাকায় অনেক বিদেশি বইপত্র পাওয়া যেত। একদিন তাঁর হাতে আসে এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাক্সোনমি বিষয়ে আইরিশ এক ভদ্রলোকের লেখা ছোট্ট একটা বই। হ্যাসলফ হ্যারিসন নামের সেই ভদ্রলোক তখন ডাবলিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। বইটি পড়ে দ্বিজেন শর্মা বেশ আলোড়িত হন। এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাক্সোনমি বিবর্তনবাদকে বর্তমান ধারায় প্রতিষ্ঠা করার একটা পদ্ধতি। তিনি বলেন,
‘এটা আমাকে হন্ট করতে লাগল। আমি আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটিতে হ্যারিসনের কাছে চিঠি লিখলাম। তিনি পাল্টা চিঠিতে আমাকে লিখলেন, তুমি এখানে চলে এসো। তখন আমি ঠিক করি, এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাক্সোনমি পড়ব, আমি বিজ্ঞানী হব।’
মাস্টার্স শেষ করার পর আয়ারল্যান্ডে পিএইচ.ডি করতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকের সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দ্বন্দ্বের ফলে তিনি এমএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণি পেলেন। ফলে পিএইচ.ডি করার জন্য আর বিদেশ যাওয়া হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর অনেক বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। ওই সময় তিনি সিকান্দার আবু জাফর-সম্পাদিত সাময়িকপত্র সমকালে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন ওই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, তাঁর সঙ্গে দ্বিজেন শর্মার গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। হাসান হাফিজুর রহমানের পীড়াপীড়ির ফলেই তিনি সমকালের জন্য প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘শেষ গোলাপগুচ্ছ’ নামের স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন ,
‘তখন সমকাল পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে। হাসান সহকারী সম্পাদক। ইতিপূর্বে আমি উল্লেখযোগ্য কিছুই লিখিনি। হাসানের ঈর্ষণীয় বন্ধুপ্রীতি, অনমনীয় জবরদস্তি আর অহেতুক প্রশংসার কল্যাণেই সাহিত্যের অঙ্গনে আমি প্রবেশাধিকার পাই। বলতে দ্বিধা নেই, হাসানের হাত ধরেই এ পথে আমার যাত্রা শুরু।’
তাঁর লেখা ‘সংস্কৃতি বিচার’, ‘বঙ্কিম সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’, ‘লিসেন্কোর বংশগতিতত্ত্ব’, ‘তমসার শেষ অঙ্কে’ ইত্যাদি রচনা সমকাল পত্রিকায় তখন প্রকাশ পেয়েছিল। স্বাধীনতার পরে হাসান হাফিজুর রহমান মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭৪ সালে দ্বিজেন শর্মা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে মস্কো যান। সেখানে তাঁদের সখ্যতা আরো নিবিড় হয়। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বরিশাল বিএম কলেজে ফিরে গিয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। দ্বিতীয় শ্রেণি পাওয়ায় পিএইচ.ডি করতে বিদেশ যাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার ফলে তাঁর মন সে-সময় ভীষণ খারাপ ছিল। তবে তখনো সব আশা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। বরিশালে ফেরার পরেও তাঁর মনে আশা ছিল যে পিএইচ.ডি করার জন্য আয়ারল্যান্ডে অধ্যাপক হ্যারিসনের কাছে যাবেন। কিন্তু গোল বাধাল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কারণ, জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে বসে গেছেন। তারপর স্বৈরাচারী সরকার একটা শিক্ষানীতি ঘোষণা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সারা পূর্ববাংলাজুড়ে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রবল ছাত্র-আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। তিনি তখন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট, আন্দোলনরত ছাত্রদের সহযোগিতা করার অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে ধরতে যায়। তিনি পালিয়ে বরিশাল থেকে চলে যান মৌলভীবাজারের বড়লেখায় নিজের গ্রামে। সেখানে ও ময়মনসিংহের আত্মীয়বাড়িতে মাসতিনেক লুকিয়ে থাকার পর পরিস্থিতি থিতু হয়েছে ভেবে কলেজে ফিরে কাজে যোগদান করেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার ও কারাগারে নিক্ষেপ্ত হন। ফলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তাঁর বিদেশ যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর ভাষ্যে,
‘বাষট্টি সালে বরিশালে আমাকে সিকিউরিটি প্রিজনার হিসেবে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর আইয়ুব খানের পাকিস্তানে আমার পক্ষে আর পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে ঠিক করলাম, বরিশালেই পিএইচডি করব বরিশাল ফ্লোরা (বরিশালের উদ্ভিদকুল) নিয়ে। কিন্তু সেখানে কোনো গাইড নাই। নিজে নিজেই কিছু কাজ করলাম। জেল থেকে বেরিয়ে আমি আর বরিশালেই থাকিনি, ঢাকায় এসে নটর ডেম কলেজে যোগ দিলাম। ঢাকায় এসেই আমার ইচ্ছা হলো, ঢাকা শহরের গাছপালা নিয়ে লেখালেখি করব। মোটরসাইকেলে করে সারা ঢাকা চষে বেড়াতাম, গাছপালা দেখতাম।’
বরিশালে গ্রেপ্তার ও কারাবরণের আগে ১৯৬০ সালের ২৭ নভেম্বর তাঁর বিয়ে হয় বরিশালবাসী আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্তীর কন্যা দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে। দেবী চক্রবর্তী তখন বরিশাল বিএম কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। সেখানে ১৯৬১ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান সুমিত্র শর্মার (টুটুল) জন্ম হয়। দ্বিতীয় সন্তান শ্রেয়সী শর্মা (মুন্নী) জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭১ সালে। ১৯৬২ সালে বরিশাল ছেড়ে ঢাকা চলে আসার পর দ্বিজেন শর্মা কিছু সময় কায়েদে আজম কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ ও বাংলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। তারপর যোগ দেন নটর ডেম কলেজে। ওই কলেজের প্রাঙ্গণে অনেক গাছ লাগান, বাগান গড়ে তোলেন। তাঁর লাগানো কিছু গাছ এখনো ওই কলেজের প্রাঙ্গণে রয়ে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘শ্যামলী নিসর্গ’ লেখেন। বাংলা ভাষায় এরকম বই এটাই প্রথম। কিন্তু পাণ্ডুলিপি ১৯৬৫ সালে জমা দিলেও বাংলা একাডেমি বইটি প্রকাশ করে অনেক পরে, ১৯৮০ সালে। শ্যামলী নিসর্গ লেখার সময়েই তিনি পপুলার সায়েন্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পের আঙ্গিকে আরো দশ-বারোটা নিবন্ধ-প্রবন্ধ লেখেন। সে-লেখাগুলো নিয়ে আরো পরে প্রকাশিত হয় ‘জীবনের শেষ নেই’ নামে আরেকটা বই। ছাত্র পড়াতে তাঁর ভালো লাগত, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল আরো বেশি। তিনি বলেন, ‘আমার মূল লক্ষ্য ছিল গাছপালা নিয়ে গবেষণা করব, বিজ্ঞানী হব, এবং এই ধারার লেখালেখি করব। তাই নটর ডেম কলেজে যোগ দেওয়ার কিছুকাল পরে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের অধীনে ক্যারোফাইটা নিয়ে পিএইচ.ডি গবেষণা শুরু করি। মস্কো যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সেটা চালিয়ে গেছি। আমি একজন বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার মনের গড়ন।’
রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। অবশ্য তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রবেশ করেননি, কিন্তু তাঁর বন্ধুবান্ধবদের অধিকাংশই ছিলেন বামপন্থি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল।কলেজে পড়ার সময় বামপন্থি বইপত্র পড়েছিলেন প্রচুর। বাম রাজনীতির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশাও হয়েছে কম নয়। ‘কলকাতা পড়ার সময় আমি থাকতাম ব্যারাকপুরে। সেখানে বামপন্থিরা গল্প লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। আমি ‘সীমান্ত’ নামে একটা গল্প লিখি, সেটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যায়। সো আই বিকেম পপুলার অ্যামং দেম। প্রচুর বন্ধুবান্ধব জুটে গেল।’
১৯৭৪ সালে দ্বিজেন শর্মা সোভিয়েত ইউনিয়নের সুবৃহৎ পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে সপরিবারে মস্কো চলে যান। ফলে অ্যাকাডেমিক জগতের সঙ্গে তাঁর চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। অনুবাদের কাজ তাঁর ভালো লাগেনি, কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এ-কাজটি তাঁকে করতে হয়েছে। প্রগতি প্রকাশনের জন্য তিনি প্রায় ৪০টি বই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করতে ভালো না লাগলেও সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁর বসবাস আনন্দময় ছিল। তিনি মনে করতেন, তাঁর জীবনে এটা ছিল এক বিরাট সৌভাগ্যজনক ঘটনা। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে আমি এমন সমাজ দেখার সুযোগ পেয়েছি, যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আরো কত কিছু দেখার সুযোগ হয়েছে, কত দেশে গেছি, কত মানুষ দেখেছি, কত বই কিনতে পেরেছি, পড়তে পেরেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নে না গেলে হয়তো মূর্খই থেকে যেতে হতো। পিএইচ.ডি হয়তো করে ফেলতাম। লিখতামও হয়তো, কিন্তু সেসব লেখা এ-রকম হতো না। আর জীবনটা সেখানে কী সুখেরই না ছিল। টাকা-পয়সার চিন্তা নাই, প্রাচুর্য নাই, প্রাচুর্যের চিন্তাই নাই, অভাবও তেমন নাই। কাজের অমানুষিক চাপ নাই। অদ্ভুত সমাজ ছিল সেটা। সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকার সুবাদে ইউরোপ ভ্রমণে যেতে পেরেছি, কতকিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি তো বলি শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া উচিত। সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো উচিত।’
রাজনীতি সচেতন এই গুণী প্রকৃতির ওপর পুঁজিবাদের প্রভাব নিয়ে বলেছেন,
‘পুঁজিবাদ শুধু মানুষের শোষণ-বঞ্চনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে মানবসভ্যতাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে সে। সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে উৎপাদন ও পরিভোগের এই ব্যবস্থা বদলাতে হবে। বদলাতে হবে সব বিষয়ে এথনোপোসেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সবার ওপরে মানুষ সত্য নয়, পৃথিবীর ইকোসিস্টেমে একটি কীটস্ব কীটেরও ন্যায্য জায়গা রাখতে হবে। নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী অ্যান্ডিকো ফারমিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমাদের গ্যালাক্সির অন্যান্য গ্রহে কি সভ্যতা আছে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আছে, নিশ্চয়ই অনেক আছে। পরের প্রশ্ন, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না কেন? এবার ফারমির উত্তর : সে-রকম প্রযুক্তি তৈরি করার আগে তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে।’
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সময় তিনি মস্কোতেই ছিলেন। তারপর প্রগতি প্রকাশনেরও বিলোপ ঘটে এবং তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেননি, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত মস্কোই ছিল তাঁর আবাসস্থল। ওই বছর স্বদেশে ফেরেন বটে, তবে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই একবার করে মস্কো যেতেন এবং টানা কয়েক মাস সেখানে বাস করতেন। ২০০৫ সালের পর মস্কোর পাট পুরোপুরি গুটিয়ে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন। এই যাওয়া-আসার সময়েই তিনি ঢাকায় এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া প্রকল্পের অন্যতম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং বাংলাপিডিয়ার অনেক ভুক্তি নিজে অনুবাদও করেন। ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ প্রকল্পের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
স্বদেশে ফিরে আসার পরে পত্রপত্রিকায় প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হওয়া এবং এসব বিষয়ের প্রতি তরুণ সমাজের আগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে সাংগঠনিক সক্রিয়তার ফলে তাঁর প্রকৃতিবিদ পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে। তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা, বিশেষত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অনেকটাই চাপা পড়ে যায়।
দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতি, বৃক্ষাদি ছাড়াও লিখেছেন সমাজতন্ত্র আর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। ভাবতেন ঢাকা শহর নিয়ে। তার এক লেখায় তিনি লিখেছিলেন, “ঢাকা মহানগরের আশপাশের নদীগুলির দূষণ-বিষয়ক একটি আলোচনাসভায় বসে মনে পড়েছিল পঞ্চাশ দশকের বুড়িগঙ্গার কথা। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই বুড়িগঙ্গার পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতাম। কোন জাহাজ বা লঞ্চ ভিড়তো না সেখানে। কতবার নৌকায় নদী পারাপার হয়েছি। স্বচ্ছ জলের স্বাভাবিক স্রোতস্বিনী। শুনেছি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর নবগঠিত পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশের রাজধানী এই বুড়িগঙ্গার পাড়ে নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কেন জানি না, পরিবর্তে সেটা শুরু হয়েছিল প্রায় জনহীন নির্জন রমনা এলাকায়। বুড়িগঙ্গার পাড়ে হলে নদীটি আজও হয়ত এতটা দূষিত হত না। সেই নদীতীরে বসে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন ছাত্র স্বপ্ন দেখতাম-ঢাকা একদিন উদ্যান-নগরী হবে, বুড়িগঙ্গার দুপারে থাকবে পামগাছ ও নিয়ন-আলো শোভিত বুলভার্দ, জিঞ্জিরার মাঠটিই হবে খোলা ময়দান। এখন ভাবি স্বপ্ন নয়, আমরা দিবাস্বপ্ন দেখতাম।”
দ্বিজেন শর্মা শুধু একজন নিসর্গবিদ বা জীববিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন একজন সুসাহিত্যিকও, যার ছাপ আমরা তাঁর লেখায় খুঁজে পাই। উদ্ভিদ জগৎ, প্রকৃতি বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে লিখেছেন প্রায় দেড় ডজন বই। উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে লেখা দ্বিজেন শর্মার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষকদের কাছে অন্যতম আকরগ্রন্থ। তার বইয়ে গাছ, ফুল ও ফলের বর্ণনার সঙ্গে উঠে এসেছে ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সিলেটের লোকগীতি ছাড়াও মধ্যযুগের কাব্যগাথা।
অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’, ‘ফুলগুলি যেন কথা’, ‘গাছের কথা ফুলের কথা’, ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’, ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষা: দায়বদ্ধতার নিরিখ’, ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা’, ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার’, ‘বাংলার বৃক্ষ’।
তাঁর বইয়ে পাঠক এক ভিন্ন রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পায়, তা অনেকটাই চেনা রবীন্দ্রনাথের বাইরে আরও আপন কোনো রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি লিখেছেন,
“রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রকৃতিসাহিত্যের রাজাধিরাজ। আমি সর্বদাই কবির কাছে নতশীর, কৃপাপ্রার্থী, তাঁর অফুরান ভাণ্ডার থেকে দু’হাত ভরে কুড়োই সম্মোহক আনন্দের খোরাক, লিখতে বসে তুলে নিই তাঁর শব্দ ও শব্দগুচ্ছ, কাছে রাখি বনবাণী, সঞ্চয়িতা, গীতবিতান।”
লেখালেখির জন্য তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা আমাদের ছেড়ে গেলেও প্রকৃতিপুত্র হয়ে বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে।
‘মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ’ -দ্বিজেন শর্মা
লেখক: অজুফা আখতার