ঠাহর
ধরা যাক-
কোনো এক দুপুরে খাঁখাঁ রোদের তপ্তবেলায়
মহিষের বাথান, এলোকেশী মেঘ, বাঁশির সুর ছাপিয়ে
আশ্চর্য এক অমোঘ সঞ্জীবনী শক্তির ছোঁয়ায়
আকাশ নুয়ে এলো মৃত্তিকায়;
দূর চলে এলো কাছে,
সকল কয়েদী মুক্তি পেয়ে গেলো!
অতঃপর কঙ্কাবতীকে উদ্ধারের শপথে
প্রত্যেকেই হয়ে উঠলো একেকজন রূপকথার রাজার কুমার!
ধরা যাক-
এক বিকেলে বেদনারা দলবেঁধে এসে বললো
না- না- আর নয়; চেয়ে দেখো
মুদ্রার উল্টোপিঠের মতো আমাদেরও আছে সরল-মুখশ্রী;
বুকের সানুদেশজুড়ে আছে ঘন প্রেইরীর মানবিক প্রেম!
নব পরিণীতার মতো আনকোরা-অসার-জুবুথুবু নয়;
চাইলেই কলরোলে খুলে দিতে পারি বন্ধ-অন্ধ মস্তিষ্ক;
বিশ্ববাউলগীত কিংবা অষ্টপ্রহর শোনাতে পারি-
ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া-জারি-সারি- সুমধুর রবি-নজরুল।
ধরা যাক-
কোনো এক রাতে বাবুই মুখের কারুকার্য
আর হার্দ্য রঙে পৃথিবী রাঙাতে-
মাদার তেরেসা, মহাত্মা গান্ধী, কার্ল মার্কস,
আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা,
ফিদেল কাস্ত্রো, কমরেড লেনিন
ও শেখ মুজিবের মতো-
প্রাঞ্জল মুখগুলোয় সেজে উঠলো ধরিত্রীর দুয়ার!
ধরা যাক-
হলুদ খঞ্জনাপাখির ঠোঁটে চেপে একদিন ভোর এলো;
রুপোলিইলিশ আর কিশোরীর গালে পড়া টোলের মতো
হৃদয় উথলে ওঠা ভোর!
সাথে নিয়ে এলো ভালোবাসার মহামন্ত্র!
জগতের সমুদয় সম্প্রচারের নবে আঙ্গুল ছোঁয়াতেই
প্রবাহিত হলো স্বাস্থ্যকর সংবাদের সু-বাতাস।
অষ্টমীর পুণ্যস্নানে মেতে-
ইথারে ইথারে ধ্বনিত হলো বিজয়োল্লাস!
দৌড়ে পালালো-
আহাজারির দিন; বিবর্ণ মুখচ্ছবির ক্ষুধা-জরা-মৃত্যু!
নদীর কল্লোল-পাখিদের বিলাপ-আত্মার ক্রন্দনধ্বনি-
থেমে গেলো অন্যমনস্ক পাথর-সময়।
বিগত কটাক্ষ বন্ধ রেখে অহংকারী ছুঁলো অসহায়ের মন;
বকুল ছড়ালো সুবাস, কোকিল গান ধরলো!
দোয়েলের শীষে সয়লাভ স্বর্গ-মর্ত্য!
দেশদ্রোহী মেতে উঠলো দেশপ্রেমের উৎস ধারায়।
একটা দু’টো নয়-
পৃথিবীর প্রতিটি মানচিত্র হতে
ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংস করে দিলো শোষণের বীভৎস মুখ!
ক্যামন হবে তবে! পৃথিবীর রূপ?

পিতা
হে আমার প্রিয়তম সকাল!
হে আলোকিত সূর্যের সারল্য
এসো গল্প শুনি; এক মহাজাগতিক সত্তার!
কণ্ঠে তাহার ঝরতো বারুদ; ইতিহাস হতো কথা!
সে আমার পূর্বপুরুষ! অভিনব এক পিতা।
কীভাবে বিশ্বাসী পৃথিবীতে হয় অবিশ্বাসের ধারাপাত
কীভাবে ঋতুবতী বসন্ত এসে ছুঁয়ে যায় পলাশের হাত
জীবন ও যাপনের চাতুর্যকলায় সবুজের বুকে
কীভাবে ঘুমিয়ে থাকে অনাদিকালের উত্তপ্তসূর্য!
এ এক দেশ জনপদ জাতি ও জনকের ইতিকল্প।
দেশ বলতে বঙ্গভূমি! জাতি বলতে বাঙালি!
আর জনক বলতে; শেখ মুজিব!
সাতচল্লিশের দেশভাগ
পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য-লীলা ছাপিয়ে-
ভাষা আন্দোলনের বাহান্ন।
রক্তে রক্তে রাজপথ হলো ভারী!
সালাম-বরকত, রফিক-জব্বার; ঝরে গেল অগনিত প্রাণ!
এলো- চুয়ান্ন! উনসত্তর! আসাদের রক্তমাখা শার্ট!
এগারো দফা, ছয়দফা
সত্তরে নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালির।
একটি তর্জনীর প্রেমে উন্মাদ গোটা জাতি
অবিসংবাদিত নেতার আহ্বানে উৎসর্গ ত্রিশ লক্ষ প্রাণ!
টুঙ্গিপাড়া থেকে ধানমন্ডি;
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত!
প্রদীপ্ত আলোর বিচ্ছুরণে চিরকালীন
সে মহানায়কের ছায়া ভেসে বেড়ায়; গোটা বাংলার জমিন!
পাখির গানে উচ্চারিত- শেখ মুজিব!
ফুলের বনে আন্দোলিত- শেখ মুজিব!
রাজপথ ভেঙে উচ্চারিত- শেখ মুজিব!
স্লোগানে স্লোগানে উন্মীলিত- শেখ মুজিব!
মশালে মশালে প্রজ্বলিত- শেখ মুজিব!
তৃণপ্রেমী পাখির ঠোঁটে- শেখ মুজিব
ছায়াজলে গান হয়- শেখ মুজিব!
বহুবর্ষী নদীর ঢেউয়ে- শেখ মুজিব
অন্তহীন মায়ার স্নানে- শেখ মুজিব!
দ্রোহ-প্রেমের উচ্চারণে- শেখ মুজিব!
প্রেরণায় প্রকাশ্যে- শেখ মুজিব!
চেতনের মায়াঘোর- শেখ মুজিব!
যেন দুর্বার তারুণ্যে কল্লোলিত ঝড়!
আকাশে বাতাসে কান পেতে দিলে একই কণ্ঠস্বর।
অকস্মাৎ কালের কলঙ্কে এক নিনাদ ভোর
সহসা থমকে যায় দেশ!
বত্রিশ নম্বর থেকে রক্ত গড়িয়ে নামলো শোকের নহর।
আমার ইতিহাস সাক্ষী-
বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রথম পাঠ
‘আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি’
বার্লিনে একজন ভায়োলিন বাদককে দেখানো
দশ টাকার নোটের সেই ছবি
অথবা ‘যতোকাল রবে পদ্মা-মেঘনা গৌরী-যমুনা বহমান
ততোকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
শব্দের ধ্বনিকালে গর্জে কল্পনার হাতুড়ি, শাবল
কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক,
শহীদ কাদরী, রফিক আজাদসহ অসংখ্যজন
অনুভবের পবিত্র ব্যঞ্জনায় আঁকলেন—
শেখ মুজিব! শেখ মুজিব! শেখ মুজিব!
বাহুলগ্ন প্রেমিক!
নিদ্রাভঙ্গ পিতা!
অগ্রজ থেকে লক্ষ্যভেদী অনুজ!
নির্বিচারে সম্মোহনী সেই নাম। শেখ মুজিব!
শেখ মুজিব এক স্বপ্নদ্রষ্টা!
এক চিরন্তন-পতাকাসম উড্ডীন মহাকাব্য।
শেখ মুজিব আমার প্রেম! আমার পিতা! এক অনল পুরুষ!
ভাসিয়ে আঁখি সে নামে গান গায় পাখি
অন্তরাত্মায় বাজে অনিবার্য চারটি শব্দ
জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!

মায়াগ্রাম
শান্ত-পুকুর জলের ধারে মায়ের মুখটি ভাসে।
মন যে চায় আজ, বসি গিয়ে মধুরিমা ঘাসে!
যেখানেতে মাটির কাছে মিশে গেছে বায়ু;
মাছে-মাছে গাছে-গাছে মেশা পরম-আয়ু।
মায়ামুখী শিশিরেরা, নতজানু পায়ে
নানা পাখি কলরবে তান ধরে সেই গাঁয়ে;
সকাল আসে ঠোঁটে নিয়ে বকুলফুলের ঘ্রাণ
দুপুরবেলা পাঠশালাতে কচিকাঁচা প্রাণ।
সারসেরা খেলা করে ধানের পাতার ফাঁকে।
গামছাজুড়ে ঘামে-ঘ্রাণে কৃষক স্বপ্ন আঁকে।
বাউ-বাতাসে লুটোপুটি মাছরাঙা রোজ দোলে।
রোদেলা সে দুপুর ঘুমায় পর-বিকেলের কোলে।
দূরে কোথাও বৃক্ষশাখে হুতোম-প্যাঁচা ডাকে;
সারাপাড়া মাথায় ওঠে ‘লেস-ফিতা-লেস’ হাঁকে।
আমের বোলে বাতাস দোলে, মৌমাছিরা নাচে
শীত সকালে খেজুরে-রস, বাড়ি বাড়ি গাছে।
বিলের জলে ইতিউতি শাপলারা দেয় দেখা;
লাজ-বুনোফুল ফুটে থাকে পথের পাশেই একা।
হিজল-শাখে ডাকে পাখি, জলে কলমি ভাসে।
বৌ-ঝিয়েরা কলসি কাঁখে কল্প-গল্পে হাসে।
তৃণভোজী পশুরা সব ঘুরছে মাঠের পরে;
নদীর কাছে জলের গল্প বলছে মরা চরে।
বটের ছায়ায় বসে রাখাল, বাজায় মোহনবাঁশি।
উথালপাথাল পল্লীবালার মন করে উদাসী।
রাতদুপুরে জোনাক জ্বলে নিভুনিভু তারা;
আকাশেতে চাঁদের খেলা, জোছনা দিশেহারা।
হাসনাহেনার ঘ্রাণে মাতাল অন্ধরাতের মৌ;
হাত-পাখাতে বাতাস ঢালে কচি কলাবউ।
সর্দি-কাশি বিমারীতে বেণিবাবু আসে;
অসুখ-বিসুখ দৌড়ে পালায় বসলে রোগীর পাশে।
সন্ধ্যাবেলায় উলুধ্বনি; আজান-সুরে মোহ;
মিলেমিশে থাকতো সবাই প্রাণের সমারোহ।
ঝোপের ধারে তিমির-তিতির ডাহুক দূরে ডাকে;
অজানা এক ভয় খেলে যায়- খেঁকশেয়ালের হাঁকে।
সুয়োরানী দুয়োরানির গল্পমুখর দেশে-
দাদুর কোলে ঘুমায় খোকন, রাজকুমারের বেশে।
কখনও বা ঢের-সময়ের বিদেশ-বাসের পর;
ফিরে আসে গাঁয়ের ছেলে আবার নিজের ঘর।
ঘোমটা-আড়াল মায়াবধূ অজানপ্রেমে হাসে;
অশ্রু-সুখের ভালোবাসায় মায়াস্নানে ভাসে।
কোথায় আমার আবাল্য-গ্রাম অতীতদিনের সুখ?
স্মৃতিজলে ভাসছে আজও ফেলে আসা মুখ!
হয়তো এখন ভুলে গেছে- সবাই আমার নাম;
সেখানেতেই আমার বাড়ি আমার মায়াগ্রাম।
কত মায়া মোহছায়া, হরেকরকম স্মৃতি;
মনের মধ্যে সুর ধরেছে, হারানো সেই প্রীতি।
বাবার আদর, মায়ের স্নেহ, বাল্যবেলার গ্রামে;
এখনও তো ভোরের সূর্য, রাতের আঁধার নামে।
এখনও তো ফুলের দোলা, বাতাস খেলে গাছে।
আমিই কেবল দূরে থাকি- সকল নিয়ে কাছে।

স্বাধীনতা
উদাস দুপুর ঢেউ খেলে যায়, কৃষ্ণচূড়া সাজে;
রেবু তখন শ্যাম-বালিকা, জোছনা-মোহন লাজে।
ফুল তোলা তার চুলের বেণী, দুলছে সাপের মতো;
অজান হাওয়ায় সময় গড়ায়, নেই বেদনা-ক্ষত।
বুকের মাঝে ভয়ভীতি নেই, প্রথায় তবু নত;
হৃদয়জুড়ে সেই কিশোরীর মুক্ত পরমব্রত।
বইয়ের ভাঁজে লুকানো সুখ, পেখম মেলে নাচে!
রেবু তখন পাখির মতো, উড়াল পেলেই বাঁচে।
রেবু যেন গল্পগাথা, খাতার পাতায় আঁকা;
সরলপথে সরলমনে, সরল হয়ে থাকা।
কোন গাছেতে পাখির ছানা, কোন বাগানে ফল;
এসব দেখে এসব নিয়েই ভাবনা অবিরল।
নানারকম স্বপ্নপাখি রোজ উড়ে যায় চোখে;
রেবু তখন ফুলকিশোরী, বিশ্ব মহালোকে।
রেবু তখন খুব সাধারণ, গ্রামের সরল মেয়ে।
ঘাস-ফুলেরা মুগ্ধ-মাতাল, রেবুর ছোঁয়া পেয়ে।
ভাবনা তখন আকাশমুখী, পাতালছোঁয়া আশা;
কাছেই থাকে পোষা-বেড়াল, খুব সাধারণ ভাষা।
হঠাৎ এলো যুদ্ধজাহাজ ভাঙলো ঘরের দোর;
নিভে গেল স্বপ্নপ্রদীপ— রাত হলো না ভোর।
রেবু কি আর জানে তখন, অস্থায়ী এই সুখ;
ক’দিন পরেই আঁধার হবে, শিশিরগন্ধা মুখ!
ক’দিন পরেই মুছবে কাজল, হাসতে হবে মানা;
ভেঙে যাবে ঘৃণ্যঝড়ে প্রজাপতির ডানা।
একাত্তরের পাকসেনারা খুবলে খেলো তারে;
আঁটকে গেল দেশ-ভাবনা ছিন্ন কাঁটাতারে।
রক্তস্রোতে ভাসলো রেবু- অলীক অধীনতা;
যুদ্ধ-ভয়ে সম্ভ্রম-ক্ষয়ে এলো স্বাধীনতা।
এখনও রোজ সূর্য ওঠে, আকাশ-ভরা মেঘে;
বাংলাদেশের লাল পতাকায় রেবু আছে জেগে।

বিবসন ঔৎসুক্য
একদা এইখানে সমুদ্দুর ছিল!
বিকেলটা প্রায়ই সেজেগুজে এসে কাছ ঘেঁষে বসতো!
সূর্য পাঠাতো চুমু
পৃথিবী পান করে অস্তরাগের ঠোঁট! সঙ্গমসুখের উজ্জ্বলতায়
এক আচাভুয়া বাতাসের গাল বেয়ে নামতো
শামুক কুড়ানো ক্ষণ!
ছিল বারোমাসে তেরো পার্বণীয় আয়োজন!
কবোষ্ণ প্রেমের অনুগ্রগন্ধে শ্যামলিমা চাষির মতো
শতবর্ষীয় আর্তির থালায় ঘাটে ঘাটে জমতো মেলা।
সোনার কলসের মতো আনচান প্রাণ;
পারিজাত সুবাসে ছুঁয়ে দিতো দূরগামী কাপালিক চাঁদ!
আজ ফণীমনসার মতো এ বাড়ন্ত বেলায়
খালাসির তাড়া নেই, নেই পায়চারি সুকানির।
ভূতগ্রস্ততায় মাঝেমাঝে চুপচাপ উড়ে যায়
প্রিয়হারা কিছু ম্লানমুখী মধ্যবয়সী মেঘ।
চারিদিকে ক্রোধানল, দাউদাউ ক্ষিপ্রতার লাস্যময়ী ভিড়।
পুরোনো দেয়ালের মতো লেগে থাকা সেইসব দাগ
নিসর্গ নয়; খরস্রোতা নদী হয়ে ঢেউ ভাঙে
বিহঙ্গ চোখে বিবসন ঔৎসুক্য; চেয়ে চেয়ে অন্ধকার।
এখন সুমুদ্দুর নয়; এখানে কেবলই হৃদয় পোড়ার গন্ধ।

বাংলাদেশের মুখ
ডিসেম্বরের সকালগুলো বিজয়স্বরে ডাকে;
কড়কড়ে ভাত পুঁটির ঝোলে স্মৃতির ছবি আঁকে!
মাষকলাইয়ের ডালের সাথে, যত্ন করে মেখে;
উঠোনরোদে বসে খেতাম, পাখপাখালি দেখে!
শিশিরস্নাত ঘাসের বুকে, চিকচিকে সে জলে;
ফিঙে যেন লাজুকমেয়ে, দুলতো পুঁইয়ের তলে!
নীলাম্বরীর কোল ঘেঁষে সেই চড়ুইপাখির চোখে;
চেতনলোকে শস্যদানা, কাঁপন সূর্যালোকে!
দারুণ শীতে পুথি-গীতে মুখর হতো পাড়া;
জমতো না আর কোনোকিছুই রসের পিঠা ছাড়া!
সর্ষেফুলের হলুদ মেখে, চোখে-মুখে-হাতে;
মায়ের কাছে বকা খেতাম, সন্ধ্যাপারের রাতে!
দূরদেশে আজ চোখে ভাসে অতীত দিনের সুখ;
হৃদয় খোলা স্মৃতির দোলা, বাংলাদেশের মুখ!

লেখক:
বেনজির শিকদার, কবি