ভাবছি । কামাল লোহানী

Comments

কামাল লোহানীর ৮৫তম জন্মদিনে আয়োজিত সম্বর্ধনার জবাবে নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করে তাঁর এই রচনাটি এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। আজ তার ৮৮তম জন্মদিনে বাঙালীয়ানা রচনাটি প্রকাশ করছে। -সম্পাদক 

প্রিয় বন্ধু সহযোদ্ধা,
আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন নেবেন। যাঁরা এসেছেন, তাঁরাতো সহযোগী অনুরাগী তাইতো আপনাদের অপার স্নেহ, ভালবাসা বিপুল আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করলাম। কী যে আবেগে আজ আমি আপ্লুত, তা বলে বোঝাতে পারব না। প্রচন্ড ভাল লাগছে। আপনাদের সরব উপস্থিতি যেন আমার অবিরাম চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকে, সেই কামনাই করি।
এক রহস্যের কথা বলি, ১৯৫৬ সাল। এক হস্তরেখাবিদ, বেশ জনপ্রিয় খ্যাতিমান, আমার চব্বিশ বছর বয়সে বলেছিলেন, “আপনি ৬৭ বছর বয়সে উপর থেকে পড়ে মারা যাবেন”। আমি তাঁকে বলেছিলাম, “আমিতো ৭৬ বছর বাঁচতে চাই। তারও কারণ ছিল, আমার বাবা তাঁর ৭১ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধকালে মারা গেছেন, আমি তাঁর চেয়ে অন্ততঃ পাঁচ বছর বেশী বাঁচতে চাই”। উনি হেসেছিলেন। উনি নীরবে বোঝাতে চেয়েছিলেন বিধির বিধান খন্ডাবে কে? আজ ৮৫ বছর বয়সে আমি আপনাদের সামনে হাসছি। আমি জয়ী হয়েছি, ১৮ বছর পরেও বেঁচে থেকে। আপনারাই বলুন, বিধির বিধান রইলো কোথায়?
আরেকজন জ্যোতিষী-হস্তরেখা বিশ্লেষণ করে আমাদের দুজনকে (স্ত্রী) বলেছিলেন, “কর্মজীবনের পরেও আপনি বেঁচে থাকবেন অনেকদিন”। তিনি বলেছিলেন, দেখবেন চলে যাবে, তবে সঞ্চয় হবে না। যা আসবে, তাই দিয়ে চলে যাবে”। …..এখনও চলছি। কথাটাও ফলে গেল। তবে কি ওঁদের কথার উপরে বেঁচে আছি নাকি বিধির বিধান অমান্য করছি। ভাগ্যে বিশ্বাস না করে ‘উনি’ চলে গেছেন ১০ বছর আগে, কিন্তু আমি চলেছি অবিরাম। সেতো আপনাদেরই স্নেহ, ভালবাসায়। জীবনটাকে জয় করেছি কাজে, সহযোগিতা সবার।
বয়সের জেষ্ঠ্যতা বিড়ম্বনার কারণ। বেশীদিন বেঁচে থাকলে স্মৃতিভারাক্রান্ত হতে হয়। আমিও বুঝি তাই হয়ে গেছি। ৮৫ তে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে চাই না। তবু প্রত্যাশিত জীবন যখন খুঁজে পাই না, তখনই বিহ্বলতা কিংবা ধিক্কার নিজেকে ন্যুব্জ করে দেয়। প্রশ্ন জাগে, যা চেয়েছিলাম তা পেলাম না কেন? আমার জীবনে একাত্তর এমন বিবর্ণ হয়ে গেল কেন? যা হবার কথা ছিল, সবাই মিলে চিৎকার করে শত্রুর দিকে রাইফেলটা তাক করেছিলাম। সেই দিনগুলোতে ঝরা লাল টকটকে রক্তধারা শুকিয়ে গেছে। একটা ঐতিহ্যের কালো পথরেখা মনে করিয়ে দিচ্ছে কত সহস্র শহীদের অবদানের কথা। সেই রক্তস্নাত মাটির পরে আজও যখন দাঁড়িয়ে, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো কি এই বাংলা একাত্তরে চেয়েছিলাম? যে অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা চেয়েছিলাম, আজ কর্পূরের মতন উবে যাচ্ছে কি সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বাষ্পে? তখন অশীতিপর বয়সে ব্যর্থতার গ্লানিই কি বয়ে বেড়াচ্ছি না? প্রচারণার কারণে আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজেরাই নস্যাৎ করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বটে কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কোথায় গেল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান শ্লোগান-সমাজতন্ত্র, আজ ‘সামাজিক ন্যায় বিচার’-এ রূপান্তরিত হলেও তার কোন হদিস মিলছে না। গণতান্ত্রিক যে অধিকারের লড়াই এদেশের বীরজনতা একদন্ডে দাঁড়িয়ে লড়েছিলেন, তার নির্মম পরিণতি দংশন করে সাধারণ মানুষকেও।
আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস বলতে গেলেই ভাষাআন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের কথাই হরহামেশা উল্লেখ করি অথচ এই দেশটাকে প্রথমে বৃটিশদের হাত থেকে রক্ষা করতে যে রক্তাক্ত এবং সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল লোভী রাজনৈতিক পূর্বপুরুষেরা, তারই উত্তরাধিকার উপনিবেশিক শাসন ও সামন্তবাদী শোষণ-পীড়ন সইতে হলো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি পাকিস্তানী মুসলিম লীগ ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। অবশেষে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও যখন ক্ষমতা পেল না বাঙালি হওয়ার কারণে, তখনই ক্ষোভে-বিক্ষুব্ধ বাংলায় অভূতপূর্ব বিস্ফোরণ ঘটলো। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, পাহাড়ী, সমতলের সকল মানুষ একত্রিত হয়ে মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ ও সামরিক শাসক গোষ্ঠীর ঘাতক- দোসর ঐ বিশ্বাসঘাতকেরা ছাড়া অকুতোভয় সব মানুষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের মাতৃভূমিকে পুনরুদ্ধার করলাম বটে, ২৩ বছরের পাকিস্তানী দুঃশাসনকে পরাজিত করে বিজয়ের ৪৭ বছর পরেও কি আকাঙ্খার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, নাকি ক্ষমতা আমাদের ঐতিহ্য, গর্ব, গৌরব আর ইতিহাসের বীর নায়ক-মহানায়কদের  ভুলিয়ে দিয়ে চলেছে? আমার এ বয়সে তাই উপলব্ধি মানুষ কেন আপন অর্জন ও প্রাপ্তিকে বুঝে না পেয়েও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হিংস্র আক্রমণে নিপতিত হলো? আমরা কি বিসর্জন দিচ্ছি আপন মর্যাদা? আমরা যে ক্রমশ ধর্মান্ধতার পথে হাঁটছি গোটা দেশটাকে নিয়ে, তা কেন বুঝেও বিষ পান করছি? দেশের মানুষতো এমনটি চায় না, তবু কেন ক্রমশ অবনত হচ্ছি পরাজিত শক্তির কাছে।
ঘরে বসে কিংবা বাইরে মঞ্চে-ময়দানে কথার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে আমরা কি মুক্তিযুদ্ধে নয় কেবল পাকিস্তানী দুঃশাসনকে প্রতিরোধ করতে এদেশের অগণিত সাহসী রাজনৈতিক আন্দোলন ও মহান শহীদেরকেই অপমানিত করছি না? অনুশোচনার এই সময়ের নানা উত্থান-পতন একটি রাষ্ট্রের নিত্যকার উন্নতির সোপান তৈরী করবে কিন্তু মানুষকে ব্যথিত, মর্মাহত করে কেন? মনে হয়, হায়রে মুক্তিযুদ্ধ! আজ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে বিজয়ী জনগোষ্ঠীর যে পরিবর্তন আসার কথা ছিল, তার কি কোন রূপান্তর ঘটাতে পেরেছি? না পারিনি রাষ্ট্র কাঠামো, সরকার পদ্ধতি, রাজনীতি, আইনকানুন, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সকল প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের তাগিদ কেন আমাদের তাড়িত করল না? আমরা বৃটিশ থেকে পাকিস্তান হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ও একই বিধান অনুসরণ করলাম, কিন্তু কেন? কেন মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও লড়াইকে অস্বীকার করে যারা যুদ্ধাপরাধী হয়েছিল তাদেরকেই লালন পালন করে ধ্বংসাত্মক আর হিংসাত্মক পথেই সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিলাম। যুদ্ধাপরাধী কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে, তার জন্য বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ-কৃতজ্ঞতা সেই সাথে এটাও বলতে চাই রাষ্ট্র কেন আজ আত্মবিসর্জন দিচ্ছে ঐ হিংস্র অপরাজনীতির মুক্তিযুদ্ধই নয় গণবিরোধী অপশক্তির কাছে?
পড়ুন
সময়ের সাহস কামাল লোহানী – প্রথম পর্ব 
আর
সময়ের সাহস কামাল লোহানী – শেষ পর্ব
জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ কেবলই ভাবি, তাহলে কি পেলাম, কেবল একটি ভূখন্ড, যা আমাদেরই ছিল, পশ্চিমা শাসকচক্র  দখল করে শোষণ করছিল; তাকেই আমরা পুনরুদ্ধার করেছি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং তেইশ বছর ধরে বাংলাবিরোধী রাজনৈতিক চক্রের কাছ থেকে। অথচ মাতৃভাষা বাংলাদেশের ভেতর সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনেও পাল্টাতে পারিনি মানুষের জীবন, রাষ্ট্রকাঠামো বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশের মতন। এর জবাব মিলবে না। অতীতকে অস্বীকার করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির বশংবদ হয়ে যে কোন দেশ স্বস্তিতে শান্তিতে দিনাতিপাত করতে পারে না, বাংলাদেশ কি তারই প্রমাণ নয়? যে বীর বাঙালি অমিততেজে অস্ত্রধারণ করেছিল ধর্মান্ধ, নিপীড়ক শক্তির বিরুদ্ধে একাত্তরে, আজ কেন তাঁদেরকেই ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির জঙ্গী তৎপরতা ও হিংস্রতায়? যে জামাত যুদ্ধাপরাধী সুস্পষ্ট আমরা জানি সবাই, তাকে কেন আজও খতম করতে পারিনি, তার প্রধান কারণ বিজয়ের অব্যবহিত পরেই যে প্রয়োজনীয় ‘হত্যায়’ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করতে হয়, তা আমরা করিনি তাই জিয়া-এরশাদ ধর্মকে ব্যবহার ও আশ্রয় করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়ে যে রাষ্ট্রস্বরূপ পাল্টাবার অপ্রপ্রয়াসে মত্ত হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতা আজও লক্ষণীয় বলে দেশময় মানুষের অধিকার নির্মমভাবে সুবচনের আড়ালে বেপরোয়াভাবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। ধর্মাশ্রয়ী ক্ষমতার রাজনীতি জিয়াকে হত্যা করে এরশাদ এককাঠি বেড়ে ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্মই ঘোষণা করল। দেশবাসী তার শাসন দশকে ঘৃনা আর প্রতিবাদেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে সরকার পরিবর্তন করলো বটে কিন্তু চরিত্র আরো কুৎসিত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। জনগণে আস্থা নেই, ক্ষমতার উৎস কেবল সেনাবাহিনীর শক্তিই হয়ে উঠল প্রবল প্রতাপান্বিত। এই যে স্বার্থের সংঘাত, এখানে তো মধ্যবিত্ত চরিত্রের উচ্চকাঙ্খা স্বার্থকেই প্রধান করেছিল বলেই অন্তর্দ্বন্দ ক্রমশঃ প্রবল হয়ে ওঠে।
এরপর ক্ষমতালোভীদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থবাদিতা ও ক্ষমতার দ্বন্দের ফলাফল হিসেবে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম কেবলই ক্ষমতার সাথে ক্ষমতার লড়াই। আর এর মধ্যেই দেশের মানুষ বঞ্চিত ও শোষিত হতে থাকল। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক হলো জনগণের বন্ধু অথবা তাদের কল্যাণের কথা ভাবেন যাঁরা, সেই বামপ্রগতিশীল শক্তির বিকাশ নয় বিনাশ ঘটতে থাকলো। আর আজ যখন দেশময় ধর্মীয় অন্ধত্ব প্রচারে ব্যস্ত মৌ-লোভীরা, তখন মুক্তিযুদ্ধেবিশ্বাসী সরকার ক্রমশ ধর্মীয় অনুশাসনে দেশকে ডুবিয়ে দিতে দ্বিধা করছে না। মুক্তিযুদ্ধ, তার শ্লোগান ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেয়া বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর দেয়া ৭২-এর সংবিধান কী নির্মমভাবেই না লঙ্ঘন করে জিয়া আর এরশাদের স্বপ্নসাধকেও ধারণ করে নেয়া হলো।  অন্যদিকে নির্বোধ আচরণের সিদ্ধান্ত প্রকটভাবে দন্তবিস্তার করতে চাইলো বিএনপি-জামাত জোট। ওদের স্বপ্ন দেখলাম ‘কাজীর গরু’ হয়ে উপহাস করছে জনগণকে, কেবল কেতাবের মত মুখেই আছে, ময়দানে তাদের কোন প্রমাণ নেই। ওদের কী যে প্রবল ইচ্ছা, এই দেশটাকে ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’ পরিণত করার। যদি ক্ষমতায় যেতে পারে, তবে মুক্তিযুদ্ধকে ওরা ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে, যা দেশবাসী কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা চায় না। এই গোপনে খাল কেটে যে কুমীরকে ঢোকাতে চাইছে এই ধর্মান্ধ মতলববাজেরা, তাদের যেভাবেই হোক রুখতে হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের একচেটিয়া উত্তরাধিকার দাবী করে যারা, তারা কি একবার ভেবে দেখেছে, তারা কি করছে। জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক কোথায়? মুখে যতই বলেন না কেন, যাচাই করলে দেশের দূর্গতি বাড়বে বৈ কমবে না। তাদের আজ বুঝতে হবে জনগণ কি চান। তাদের শতভাগ প্রত্যাশা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ধর্মান্ধ হবে না, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকেই গড়ে তুলবে। কিন্তু দূর্ভাগা এদেশ আর জনগণ, ক্রমশ নিমজ্জিত হচ্ছে গহীন অতলে-জনসমর্থনহীনতায়।
এসবের প্রধান কারণ, আমার ধারণা, দেশে বামশক্তির কন্ঠস্বর প্রায় রুদ্ধই। যারা সাংগঠনিকভাবে আছেন, তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। কন্ঠের জোর এতই কমে গেছে যে, সাধারণ মানুষ যারা ছিলেন সংগঠনের শক্তি, তাঁরাই এখন তাদের প্রতি বৈরী। কোথায় সেই আদমজী, টঙ্গী, ডেমরা, কালুরঘাটের মতন শ্রমিক ইউনিয়ন? ইউনিয়নগুলোতে কেন মালিক কিংবা ক্ষমতাসীনদের প্রভাব। কেন এই সব কমিউনিস্ট দূর্গ আজও নিরব নিশ্চুপ? মেহনতী মানুষ নির্ভর রাজনীতি আজ ‘জলো পদার্থ’-এ পরিণত হয়েছে। তাও তো কত যে ভাগে বিভক্ত, তার কোন হিসেব নেই। পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চক্রান্ত ক্রমশঃ গ্রাস করছে দেশকে, বিভ্রান্ত করা হচ্ছে জনগণকে। তারপরেও কমিউনিস্ট নামে পরিচিত শক্তির কোন চিহ্ন লড়াই-সংগ্রামে মিলছে না। এক ‘ফুলবাড়ী আন্দোলন’ হয়তো এখনও টিকে আছে। আর এই সুযোগে এর বিরুদ্ধশক্তি বহিরাগতদের কর্মকান্ড ধীরে ধীরে কৌশলে এগিয়ে চলেছে। মাঝেমধ্যে হঠাৎ জ্বলে ওঠে ফুলবাড়ীর সংগ্রাম, তারপর মনে হয় সবাই ক্লান্ত। এই সুযোগে মতলব হাসিলে যারা ওৎ পেতে আছে, তারা প্রতাপের সাথেই এগিয়ে চলেছে। আর কোন লড়াই কি আছে কোথাও, কৃষক অঞ্চলে, শ্রমিকের কারখানায়? ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি কোথায় হারিয়ে গেল? বলবেন হয়তো, আমরাতো রাজপথে আছিই, প্রশ্ন তাহলে সংগ্রামের ইতিহাস পাল্টে যাচ্ছে কেন? শিক্ষা মানগতভাবে দ্রুত নিম্নগতি, সংস্কৃতি উপেক্ষার নিপীড়নে জর্জরিত। যে শিক্ষাক্ষেত্র ভবিষ্যতে রাষ্ট্রনায়কদের তৈরী করত সেই দিনগুলো আজ কেন তাতে অনুপস্থিত। কোথায় বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ নির্বাচন যেখানে নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি হতো, তার এ দূর্দ্দশা কেন? ছাত্র রাজনীতি যারা করে তারা কেন টেন্ডারবাজি, ঘুষ বাণিজ্য, বিভিন্ন ধরনের কন্ট্রাকটারি করবে? ধর্ষক হিসেবে কিংবা প্রশ্ন ফাঁসকারী হিসেবে চিহিত হবে? হ্যাঁ সবাই এসবে জড়িত নয়। গ্রহণ করলাম, কিন্তু যে ক’জন মাত্র এইসব ঘটনের নায়ক, তাদের কেবল বহিস্কার করলেই কি দলগত শুদ্ধতা প্রমাণ হয়? ছাত্ররা কেন অন্তর্দ্বন্দে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় নিজেদের মধ্যে? হয়ত জবাব আসবে অনুপ্রবেশ করেছে জামাতীরা। ধরেই নিলাম, তাই, কিন্তু যখন অনুপ্রবেশ করেছে তখন কেন তাকে চিনতে পারেনি কেউ? ছাত্র সংগ্রামেতো সবাই একে অপরকে চেনে। তাহলে অনুপ্রবেশকারীদেরতো খুব সহজেই চিনে ফেলা যায়, সে কে? কিন্তু যখন ঢোকে তখন শক্তিবৃদ্ধির মৌতাতে উৎভ্রান্ত হয় সবাই পরে পস্তায়।
৫৭ ধারা প্রতিবাদের মুখে বাদ দিতে গিয়ে ৩২ ধারা জারী করে স্বাধীনতাহরণের জালই বিস্তার করেছেন। পক্ষে কত যুক্তিই না দিচ্ছেন।….অর্থনীতি বুঝি না। অর্থই নেই, তাতে আবার নৈতিকতা! ভাবছি বেচারা যে তাজউদ্দীন বিশ্বব্যাংকের চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে মন্ত্রীত্বই হারালেন মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হয়েও, সেই বিশ্বব্যাংককে অস্বীকার করে শেখ হাসিনা নিজ টাকায় পদ্মা সেতু প্রাক্কলিত অর্থের চেয়ে অনেক বেশী টাকা খরচ করে নিজেই করছেন। আমরা সবাই সাবাসী দিয়েছি। কিন্তু তাজউদ্দীন কেন চাকরী হারালেন? আমরা কি আদৌ বিশ্বব্যাংকের খপ্পর থেকে বাঁচতে পেরেছি? তবু বলবো, আমরাই রাজা।…..হায়রে দূর্ভাগা দেশ, মুক্তিযুদ্ধতো অহংকার, গর্ব, গৌরব। কিন্তু চেতনাকে এভাবে বিসর্জন দিয়ে ‘অর্জন’ করা কি শোভা পায়?
যুদ্ধাপরাধী ঘাতক-জল্লাদের বিচার ও ফাঁসি হয়েছে কিন্তু সাঈদীকে আজও বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তাই বলে ভাবলে চলবে না জামাত খতম। …….না ওরা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে গেছে বেশীর ভাগ। আর অনেকে সহজেই আশ্রয় পেয়েছে বিএনপিতে, আওয়ামী লীগেও সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়েছে। একথা ভুলে গেলে চলবে না ওরা যেখানেই থাকুক ওৎ পেতে আছে। সুযোগ বুঝেই ছোবল মারবে। মাঝে মধ্যেই তার নমুনা দেখায় কোথাও কোথাও। চোখের দৃষ্টি সত্যি সত্যিই প্রখর করতে হবে, না হলে আমরা কিন্তু অজান্তে ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’-এর যুগে প্রবেশ করে যাবো।
বন্ধুরা বলেন, জিডিপি বেড়েছে। খুব ভালো কথা। বগল না হয় বাজাবো। কিন্তু গরীবের আয় বেড়েছে বলে ঢেকুড় তুলে তৃপ্তি লাভ করা ঠিক হবে না। কারন নিম্নমধ্যবিত্ত, কিংবা তারও নিচের মানুষগুলো মাথাখুটে মরছেন, তবুও ঘর সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। অভিজাত শ্রেণীর ধন্যাঢ্য কুশীলবরা ফুলে ফেপে ‘বটবৃক্ষে’ পরিণত হয়ে চলেছে। সেদিকে তো খেয়াল রাখতে হবে।
বয়স বাড়লে ভীমরতি নাকি ধরে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। কিন্তু আমি কামাল লোহানী পঞ্চাশের দশক থেকে গত শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে অশীতিপর বয়ষ্ক্রম পার করতে যাচ্ছি। দেশের তো বিবর্তন লক্ষ্য করেছিই, ঢাকা আমার সামনে যেভাবে পাল্টে গেছে তা অভাবনীয়। আমি বাস্তব পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলতে পারিনি বলেই আজও এই বয়সেও রাজপথে হাঁটছি মৌলবাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হচ্ছি তারুণ্যের সাথে। তবু সংস্কৃতি সংগঠনগুলোকে আত্মোপলব্ধির তীরে বিদ্ধ করতে পারছি না। রাজনীতি অরাজনৈতিক হননের নৈতিকতাগর্হিত পথ অনুসরণ করছে। আবার যদি কমিউনিস্ট তথা বামশক্তি ধরি, তাহলে তাদের মধ্যে বিবর্ণভাব বিরাজ করছে। বিরাট হৃদয় অগ্নিগর্ভচোখের কমরেডদের দেখতে পাচ্ছি না। ভাবছি, তবে কি নিশ্চিদ্র অন্ধকারেই বিরাজিত থাকতে হবে কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতাকে? এরূপ দর্শন আমাকে পীড়া দেয়। ‘একলা চলরে’ দিন এখন নেই। তবু আশা ছিল, অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ ভগ্নহৃদয় কমিউনিস্টদের বুকে কিছুটা আশা আর সাহস জোগাবে, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদে। হলো হয়ত, কিন্তু ফল হলো না।
মহামতি কার্ল মার্কসের দ্বিশতজন্মবার্ষিকীও গেল ৫ মে, ২০১৮। সেখানেও আমরা ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন করলাম। জাতীয় জাদুঘর পর্যন্ত একক বক্তৃতার আয়োজন করল কিন্তু সবাই মিলে বিশালাকার এই মহান মনীষীর জন্মবর্ষ পালন করতেও ব্যর্থ হলাম।
এতসব ব্যর্থতার কথা বললাম, তাই বলে কিন্তু হতাশ নই। জানি অন্ধকারের পরেই আলোর দিশা মিলবেই। তাই আশাবাদী মানুষের দলে আমি। দেশের উন্নয়নের প্রবল প্রচারে মানুষ যখন স্থিত হবে আপন সত্বার বিকাশে, তখনই মিলবে আদত পরিচয় মানুষ হিসেবে।
আমি তাই গণশক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আর সেই কারণেই মার্কসবাদী বলে নিজেকে দাবি করি, আমৃত্যু করবোও। তবে বাস্তবকে অস্বীকার করে নয়।
আমরা সচেতন সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক বিশ্বাসে অভিষিক্ত। তাই স্বাগত জানিয়ে যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই চলতে চাই। মার্কসবাদ যেন আদর্শে ধারণ করে শেষতক লড়ে যেতে পারি, সেই শুভাশীষ চাই আপনাদের সকলের কাছে থেকে।
আমি আছি থাকবো, আপনাদেরই সাথে। মনের গভীরে ধারণ করবো সেই লালঝান্ডা, যা আজও আন্তর্জাতিকতাবাদে ছায়া দিচ্ছে অবিরাম।
এবারে শ্রদ্ধা জানাই, আপনাদের, যাঁরা আমাকে স্নেহ-ভালবাসায় আপ্লুত করলেন। আরও কিছুদিন বাঁচবার শুভকামনা দিলেন, তাঁদের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। আয়োজক যারা পরিশ্রম করেছেন নিরন্তর, এই আয়োজনে তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম। শুভেচ্ছা।

লেখক পরিচিতি: কামাল লোহানী, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
কামাল লোহানী

 

 


ফিচার ফটো সৌজন্য: প্রথম আলো

পড়ুন
সময়ের সাহস কামাল লোহানী – প্রথম পর্ব 
আর
সময়ের সাহস কামাল লোহানী – শেষ পর্ব

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট