ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানের ‘ধর্ম’ তাস । সাগর লোহানী

Comments

“হাতো মে বিড়ি, মু’ মে পান / লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” শ্লোগান দেনেওয়ালাদের হাতের বিড়ি শেষ হবার আগেই তাঁরা টের পেলেন যে কি ভুলটাই না তাঁরা করে ফেলেছেন।

কেননা দেশ বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সরকারী বিভিন্ন ফর্ম ও নতুন ছাপা টাকা, ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজি ব্যবহারের প্রতিবাদে সরকারী কর্মচারী-চাকরিজীবীরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে। এদের সাথে এক পর্যায়ে যুক্ত হয় ছাত্র-শিক্ষকেরাও। তৎকালীন সচিবালয় থেকে এই বিক্ষোভ পলাশী ব্যারাক পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। সেদিনও স্বতস্ফুর্ত সমাবেশ এবং মিছিল হয়েছিল। তবে এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলে উত্থাপিত দাবি ছিল মুখ্যত সরকারী বিভিন্ন ফর্ম, সদ্য ছাপা টাকা, ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে বাংলা লেখা সংযোজনের। ১৯৪৭ এর ১৭ নভেম্বরে মিছিল করে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে ঘোষণা দেওয়ার জন্য শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়।

তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে রাজধানী করাচীতে শিক্ষা সম্মেলনে সর্বপ্রথম উর্দুকে রাষ্টভাষা করার জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আগত ছাত্রদের বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজিত হয়। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, একেএম আহসান প্রমুখ আর সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ও শিক্ষার বাহন হিসেবে গ্রহণের সুস্পস্ট দাবী উত্থাপিত হয়।

আরও পড়ুন:
বাংলা ভাষা আন্দোলনে ভদ্রলোকদের দ্বিচারিতা এবং কিছু মতামত । রাহমান চৌধুরী
বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রদান এবং রবীন্দ্রনাথ । রাহমান চৌধুরী
ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে বাংলা ভাষায় শিক্ষা । রহমান চৌধুরী

১৯৪৮ এর ২৩ ফেব্রুয়ারী রাজধানী করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারীর অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিনিধি কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে ও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। গণপরিষদে বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী, মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনসহ বাঙালী মুসলিম লীগ সদস্যদের বিরোধিতায় বাতিল হয়ে যায়। প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় সফলভাবে শান্তিপূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে না যেয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনী সহ বিলটি পুনরায় উত্থাপন করেন কিন্তু প্রতিবারই তা একই ভাগ্যবরণ করে।

২ মার্চ ফজলুল হক হলে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠু ও সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট আহুত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দ্বারা ১১ মার্চের ধর্মঘটে সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদে ১২ – ১৩ মার্চে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ ও ধর্মঘট, ১৪ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট পালিত হয়। ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রদের “বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষার মর্যাদা দান”-সহ ৭ দফা দাবি মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই ৮ দফার (পরবর্তিতে ১ দফা বাড়ানো হয়) চুক্তি ছিল এ অঞ্চলের মানুষদের অন্যতম বিজয়। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে মূখ্যমন্ত্রীর নতি স্বীকার ছিল ঐতিহাসিক ও ভাষা আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

কিন্তু মূখ্যমন্ত্রীর সে নতি স্বীকার যে ছিল কেবলই এক নাটক জিন্নাহ তা জানিয়ে দিল। ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সংবর্ধনায় সদম্ভে ভাষা আন্দোলনকারীদের কমিউনিস্ট ও বিদেশি এজেন্ট বলে চিহ্নিত করে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করলেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনে জিন্নাহ পুনরায় “The State language therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this sub-continent, a language understood throughout the length and breadth of Pakistan and above all a language which, more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries” ঘোষণা দিলে ছাত্ররা “না, না” বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়। একই দিন সন্ধ্যায় জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের বৈঠকে ছাত্রদের ৮ দফা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালে ছাত্ররা তাকে অপমান করে।

এরপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে, পায় ব্যাপকতা। পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার হীন প্রচেষ্টা। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। সে কমিটি ১১ এপ্রিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তান আইন পরিষদকে স্মারকলিপি পাঠায়। ছাত্রদের কোন প্রতিবাদকে পাত্তা না দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ও মুসলিম লীগ নেতা আকরম খাঁর হীন নেতৃত্বে ১৯৫০ সালের ১৮ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় ২০টি কেন্দ্রে আরবি হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই আরবি হরফে বাংলায় শিক্ষা ও পাঠক্রম চূড়ান্ত করে ফেলে।

ইতঃমধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন খাজা নাজিমউদ্দিন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সম্মেলন পরবর্তী পল্টন জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বক্তৃতায় উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার আশাবাদ পুনঃব্যক্ত করে। জ্বলে ওঠে পূর্ববাংলা, রচিত হয় ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ৩০ জানুয়ারীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারী নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষের সকল সংগঠনকে সাথে নিয়ে বার লাইব্রেরিতে এক সমাবেশ করে। ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’-কে সফল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করে। ১১ ফেব্রুয়ারী ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এর দাবিতে পতাকা দিবস পালিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারী সারাদেশে সর্বাত্মক ধর্মঘট ঘোষণা করে।

২১ ফেব্রুয়ারী সব বাধা উপেক্ষা করে উন্মাতাল ছাত্র-জনতা পথে নামলো, চলল পুলিশের গুলি। তবুও দমানো গেলো না অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিকে। চূড়ান্ত আন্দোলনে শহীদের তালিকা হতে থাকে দীর্ঘ।

শাসক শ্রেণী ধীরে ধীরে অনুধাবন করতে শুরু করে যে পূর্ব বাংলার অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার যৌক্তিক দাবীকে মুসলমানিত্বের তকমা দিয়ে কিম্বা “হিন্দুয়ানী”র ব্যানার লাগিয়ে নির্মূল করা অসম্ভব। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদে গৃহীত হয় “অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা”র প্রস্তাব। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। আর সেই পূর্ববংগের বাঙালী “মুসলমানেরা” যারা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের দাবীতে মুসলিম লীগ গঠন, বাংলা বিভাগ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ছিল তারাই হাত থেকে ঝেড়ে ফেললো দ্বিজাতিতত্বের ধূম্র শলাকা।

ধর্মীয় সুড়সুড়ির খোলসে দেশ ভাগ করে ভারতের সামন্ত প্রভু মুসলিম ধনিকশ্রেণীর এক অংশ সাধের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে একেবারেই ভুলে গেলেন সেই “স্বপ্নের পাকিস্তান”-এর মূল ভিত্তি অনগ্রসর পুর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীকে। পাকিস্তানের নব্য শাসক শ্রেণীর “সব পেয়েছি”র মচ্ছবে হারিয়ে গেল তথাকথিত পাকিস্তানের বৃহৎ অংশের ন্যায্য পাওনার আশা। অবশ্য এর “খেসারত” তারা দিয়েছে মাত্র ২৩ বছরে। ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অনাচার আর নিপীড়ন নির্যাতনের নাগপাশ ছিন্ন করে অস্ত্র হাতে সেই “ভেতো বাঙালী” নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, গড়েছে স্বদেশ ভূমি।

লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

আরও পড়ুন:
বাংলা ভাষা আন্দোলনে ভদ্রলোকদের দ্বিচারিতা এবং কিছু মতামত । রাহমান চৌধুরী
বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রদান এবং রবীন্দ্রনাথ । রাহমান চৌধুরী
ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে বাংলা ভাষায় শিক্ষা । রহমান চৌধুরী

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.