সম্প্রতি গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে (২০১৮) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উদ্ভাবনে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ১৭টি দেশের ভিতর ১৭ নাম্বারে আমাদের অবস্থান। ওই প্রতিবেদনে অন্যান্য সূচকে পিছিয়ে থাকা অশান্ত ফিলিপাইনও বাংলাদেশ থেকে ছয় ধাপ উপরে অবস্থান করছে। এ থেকেই একটি দেশের শিক্ষা এবং গবেষণা খাতের বেহাল চিত্র ফুটে উঠে। আর এজন্য শুধু সরকার, প্রশাসন, বাৎসরিক নিম্ন বাজেটকেই দায়ী করলে চলবে না, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা এক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই নিয়েই কথা হচ্ছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষক ড. খলিলুর রহমানের সাথে। ২০১১ সালে নাসার পরিচালিত রোভার প্রতিযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তৈরি চন্দ্রবট, ২০১৭ সালে ন্যানো স্যাটেলাইট অন্বেষা, চলতি বছরে ব্র্যাকইউ মঙ্গলতরী সহ সোলার কার, স্বয়ংক্রিয় ধান কাটার যন্ত্র, রিকশার বিকল্প গাড়ি ইত্যাদি বহু উদ্ভাবনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করতে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব থাকা স্বত্ত্বেও নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-শিক্ষকরা। অধ্যাপক খলিলুর রহমান এধরণের গবেষণামূলক উদ্যোগ সফল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিকতা, শিক্ষকদের প্রচেষ্টা এবং ছাত্রদের কাজ করার ইচ্ছাশক্তি এই তিনটি বিষয়ের গুরুত্বারোপ করেন। এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়েই এই ধরণের গবেষণামূলক কাজ সফলতার মুখ দেখে।
সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স ক্লাব চন্দ্রবটের মতোই আরেকটি এডভান্স রোবট নিয়ে কাজ করেছে। প্রজেক্টটির নাম মঙ্গলতরী। এই রোবটটি মঙ্গল গ্রহে অনুসন্ধানী কার্যক্রম পরিচালনার উপযুক্ত করে তৈরি করেছে ‘মঙ্গলতরী’ টীমের সদস্যরা। লক্ষ্য ছিলো, যুক্তরাষ্ট্রের মার্স সোসাইটি আয়োজিত বিশ্বের এডভান্স রোবোটিক্সের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা ‘ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ ২০১৮’। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাতে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রদর্শনীতে সারাবিশ্বের ৩৬ টি দলের মধ্যে ১৩ তম স্থান অধিকার করে নেয় ব্র্যাকইউ ‘মঙ্গলতরী’।
মার্স ডেজার্ট স্টেশনের চাহিদা অনুযায়ী ইকুয়েপমেন্ট সার্ভিসিং, অটোনোমাস ট্রাভার্সাল টাস্ক, সায়েন্স টাস্ক ও এক্সট্রিম রিট্রাইভাল ও ডেলিভারি টাস্ক এই চারটি কাজ করতে সক্ষম এই রোবটটি। দূর থেকে বা বেস স্টেশনে বসেই একজন নভোচারী ক্যামেরার মাধ্যমে রোবটটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে যা ইকুপমেন্ট সার্ভিসিং এর অন্তর্ভুক্ত এবং অটোনেমাস ট্রাভার্সাল টাস্ক সম্পাদনের মাধ্যমে সয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত লোকেশন অতিক্রম করতে পারে এই রোবটটি। এছাড়াও, সায়েন্স টাস্ক যেমন ভূমি ও পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, প্রাণের অনুসন্ধান এবং এক্সট্রিম রিট্রাইভালের মাধ্যমে ৫ কেজি ওজনের বস্তু বহনের কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম ‘মঙ্গলতরী’। এতে নানারকম তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থার পাশাপাশি রয়েছে ১ কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর হাত ধরে মঙ্গল-তরী বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে। এরপর অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে ধাপে ধাপে রোবটটির বিভিন্ন অংশ উন্নত করা হয়। এ বছর এটিতে সংযুক্ত করা হয় এক বিশেষ সুবিধা। প্রয়োজনের সময় এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রসারিত হতে সক্ষম, যাতে করে উঁচু-নিচু পথে সহজে কোনো বস্তুকে বহন করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. খলিলুর রহমান ও প্রভাষক সাইফুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে মঙ্গলতরী দলটি কাজ করছে, যার অপারেশনাল লিডার জহিরুল ইসলাম। ১৮ সদস্যের দলে বিভিন্ন গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন আলী আহসান, জাহিরুল ইসলাম, রাজিন বিন ইসা, শান্তয়ন রায়, সৈয়দ কামরুজ্জামান ও সোয়েব আহমদ। আরও রয়েছেন ইখওয়ান ইসলাম, মাহবুব শিফাত, ফাহিম মাহমুদ, রাগিব আনজুম, জারিফ জাফার, রওশিন তাসনিম, জাবার মাহাদ, ফারিহা সাজিদ, তারিন সুলতানা, নওশিন সায়রা, মাহজাবিন ইকবাল ও গাজী মুসা জাহান।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে এডভান্স রোবটিক্স গড়ে উঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক খলিলুর রহমান বলেন, ‘ আমাদের ফিউচর টেকনোলজি ট্রেন্ডটা বুঝতে হবে। আধুনিক বিশ্বের ভবিস্যত প্রযুক্তি ধীরে ধীরে রবোটিক্স, এমবেডেড সিস্টেম, স্মার্ট সিস্টেম, বিগডাটা এনালাইসিস, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিং এসবের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আরও ভবিস্যতের চিন্তা যদি করি তাহলে ব্রেইন কম্পিউটিং ইন্টারফেস অর্থাৎ মানুষ চিন্তা করবে আর স্মার্ট কোন মেশিন সেটা নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করে কাজ করবে। তাই আন্তর্জাতিক প্রযুক্তির বাজারে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য এগুলো নিয়ে কাজ করা জরুরি। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এই কাজগুলো না করলে একদিকে যেমন আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে না, অন্যদিকে বিশ্বের প্রযুক্তির বাজার দখল করে নিবে অন্যান্য দেশ। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করেই তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগের সাথে তাল মেলাতে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এডভান্স রোবোটিক্সের যাত্রা শুরু হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এটিই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিক্স গড়ে তোলার প্রধান উদ্দেশ্য।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রবোটিক্স আসলে সমাজে কি ভূমিকা রাখছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ঠিক এই মুহুর্তে এডভান্স রবোটিক্স বাংলাদেশের সমাজে তেমন কোন অবদান রাখতে না পারে নি। কিন্তু এই কাজগুলোর মাধ্যমে আমাদের সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। যেমন নাগরিক চলাচলকে সহজ নিরাপদ করতে রিকশার বিকল্প গাড়ি, স্বয়ংক্রিয় ধান কাটার মেশিন যা আমরা এখনও বিদেশ থেকে আমদানি করি কিংবা পরিবেশবান্ধব সোলার কারের মতো দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বিভিন্ন প্রোজেক্টের বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে তা অবশ্যই সমাজে অবদান রাখতে সক্ষম। এই সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ করা উচিৎ। তাহলেই এই গবেষণামূলক আধুনিক প্রযুক্তিগুলোই এক্সময় দেশ ও সমাজের কল্যাণে ভূমিকা রাখবে।’
‘রোবট তৈরির পিছনে প্রয়োজনীয় অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় বাধা।’ এমন মত প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেলে দেশের শিক্ষার্থীরা রোবটিক্স চর্চাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এধরনের কাজ এটিই প্রথম নয়। এর আগে নাসায় পাঠানো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চন্দ্রবটও প্রশংসা কুড়িয়েছে। গেলবছর মহাকাশে পাঠানো হয় স্যাটেলাইট ‘ব্র্যাক অন্বেষা’। ‘মঙ্গলতরী রেভ্যুলেশন’-এর আগে মঙ্গলতরী নামের রোভারও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির রোবটিক্স ক্লাবের তৈরি করে রেসকিউ এন্ড এক্সপ্লোরেশন রোভার ‘ব্র্যাকইউ ডুবুরি’। যা সিঙ্গাপুরে একটি প্রতিযোগিতায় সেরা-১৫-তে জায়গা করে নেয়।’
বাঙালীয়ানা/এএ/জেএইচ