মর্কট মামলা, হৃদয় মণ্ডল আর বিজ্ঞানচর্চা । রাহমান চৌধুরী

Comments
ঢাকার মঞ্চে ১৯৯২ সালের দিকে অবলোকন নাট্যদল নিয়মিতভাবে ‘মর্কট মামলা’ নামে একটি নাটক মঞ্চায়ন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি সত্য ঘটনা নিয়ে। ১৯২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসি রাজ্যের ডেটন শহরে এক তরুণ বিজ্ঞান-শিক্ষক বিদ্যালয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়াবার জন্য গ্রেফতার হন। শিক্ষকটির বিরুদ্ধে রাজ্যের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। শিক্ষকটির নাম ছিল জন থোমাস স্কোপস, ফলে মামলাটির নাম ছিল ‘রাজ্য বনাম স্কোপস মামলা’। মামলাটি পরবর্তীকালে ‘মাঙ্কি ট্রায়াল’ নামে বিখ্যাত ছিল। মাঙ্কি ট্রায়ালের সেই ঘটনা নিয়ে পরে নাটকটি লেখেন জেরোম লরেন্স ও রবার্ট এডুইন লি। নাটকটির নাম দিয়েছিলেন তাঁরা ‘ইন হেরিট দ্য উইন্ড’। নাটকটি পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলচ্চিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের প্রয়াত আবদার রশীদ সেই নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন ‘মর্কট মামলা’ নামে। ঢাকার মঞ্চে নাটকটি নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছিলাম আমি। যুক্তরাষ্ট্র্রের ‘মাঙ্কি ট্রায়াল’ যে বাংলাদেশে প্রায় একইভাবে সত্য হয়ে উঠবে তা তখন ধারণায় ছিল না।
বিবর্তনবাদ পড়াবার জন্য স্কোপসকে গ্রেফতার করলে ব্যাপারটি খুবই সাড়া জাগায়। টেনিসির রাজ্য-আইনে তখন বাইবেলের বিরুদ্ধে কিছু পড়ানো নিষিদ্ধ ছিল। মাঙ্কি ট্রায়াল খুব সাড়া ফেলে দিয়েছিল টেনিসি রাজ্যের ডেটনের জনগণের মধ্যে এবং জনগণ ছিলেন স্কোপসের বিরুদ্ধে। সেখানকার চার্চের পাদ্রীর আমন্ত্রণে স্কোপসের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে যান ডেমোক্রেট দলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তিন তিনবার রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান, যিনি সাবেক একজন মন্ত্রী পদমর্যাদার লোক। ফলে স্থানীয় জনগণ ব্রায়ানের পক্ষে জয়ধ্বনি দিয়ে শহরের আকাশ-বাতাশ কাঁপিয়ে তোলে। বিচারক রাউলস্টোনও ছিলেন ব্রায়ানের দ্বারা প্রভাবিত এবং ধার্মিক মানুষ। জুরিদের দ্বারা তখন বিচারকার্য পরিচালনা করা হতো। জুরিরা ছিলেন সাধারণ মানুষ আর ধার্মিক। কিছুই সেদিন স্কোপসের পক্ষে ছিল না। না রাজ্যের আইন, না স্থানীয় জনগণ, না শহরের ক্ষমতাবান মানুষরা।
জন থোমাস স্কোপসের বরাতের জোর এই যে ‘বাল্টিমোর সান’ পত্রিকার মালিক আর ‘আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন’ স্কোপসের পক্ষ নেন। বিবাদী পক্ষে লড়তে আসেন প্রখ্যাত আইনজীবী ক্লারেন্স ড্যারো। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসের ১০ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত স্থানীয় আদালতে এই মামলা চলে। মামলার রায় শোনার জন্য সারা শহরের লোক ভেঙে পড়ে আদালতে। বিচারক বাধ্য হয়ে মামলা আদালত কক্ষ থেকে আদালত প্রাঙ্গনে নিয়ে আসেন গ্রীস্মের খরতাপের মধ্যে। ক্লারেন্স ড্যারো আসামী স্কোপসের পক্ষে বিবর্তনবাদ যে সঠিক তা বলার জন্য বিভিন্ন বড় বড় বিজ্ঞানীদের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করেন। কিন্তু বাদী পক্ষের কৌশলী ব্রায়ানের আপত্তির কারণে বিচারক তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। বলতে গেলে আদালতের সবকিছুই ড্যারো বিরুদ্ধে, ড্যারো প্রথম খুব হতাশ হয়ে পড়লেন। পরের দিন তিনি ভিন্ন চাল চাললেন।
তিনি আদালতকে বললেন, ‘বাইবেল সম্পর্কেই আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই উইলিয়াম ব্রায়ানকে, এ ব্যাপারে ব্রায়ান সাক্ষ্য দিতে রাজি আছেন কি না’। বিচারক তা হতে দিতে চাইলেন না। কিন্তু বাইবেলনিষ্ঠ ব্রায়ান বাইবেলের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে উদ্ধত ভঙ্গিতে কাঠগড়ায় গিয়ে বসলেন। ড্যারো তাঁকে বাইবেল সম্পর্কেই অনেক প্রশ্ন করেই সংযুক্ত প্রশ্ন করতে থাকলেন। ব্রায়ান দিশা হারিয়ে ফেললেন। তিনি ড্যারোর বিভিন্ন প্রশ্নে নিজেই স্ববিরোধী কথা বলতে থাকলেন। সাধারণ জনগণের সামনে বিব্রত হয়ে পড়লেন ব্রায়ান। ড্যারোর কৌশলী জেরায় ব্রায়ান বিব্রত হয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দেয়ায়, জনসমর্থন অনেকটা তাঁর বিপরীত দিকে চলে গেল। ড্যারো বাইবেল থেকেই মানুষের অধিকারের প্রশ্ন তুললেন, যার বিরুদ্ধে ব্রায়ান যেতে পারলেন না। ব্রায়ানকে নাস্তানাবুদ করে তুললেন ড্যারো, জনগণ ব্রায়ানকে বোকা বনতে দেখে মজা পাচ্ছিলো। হাসির ফোয়ারা বইছিল জনগণের মধ্যে। বাইবেলের সাক্ষ্য ঘিরেই ড্যারো তার শেষ বক্তব্য দিলেন এইভাবে, ‘মানুষ হিসেবে স্কোপস শুধু কথা বলবার অধিকার চায়’।
ড্যারোর শেষ বক্তব্য আর পূর্বের ঘটনায় জনমত চলে গেল স্কোপসের পক্ষে, জনতা হাততালি দিয়ে সমর্থন জানালো ড্যারোর বক্তব্যকে। ফলে আদালত জনগণের বিরুদ্ধে আর যেতে পারলো না। বিচারে রায় হলো, রাজ্যের আইনের বিরুদ্ধে যাবার জন্য স্কোপসকে একশো ডলার জরিমানা দিতে হবে। স্কোপসের জরিমানার টাকাটা দিয়ে দিলো বাল্টিমোর সান পত্রিকার মালিক। মুক্তি পেল স্কোপস। ড্যারো জানালেন, তিনি থামবেন না, ন্যায়বিচারের উচ্চ আদালতে যাবেন। সত্যি বলতে গেলে, আদালতের বিচারে ব্রায়ানই জয়ী হয়েছেন। কিন্তু নিজের আসল পরাজয়টা তিনি ভিতরে ভিতরে টের পান। পরদিন ঘুমের ভিতরে ব্রায়ান মারা যান। কিন্তু আটষট্টি সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের টেনিসি রাজ্যে ডারউইনের তত্ত্ব পড়াবার অধিকার ছিল না। কিন্তু সেদিন আদালতের সামনে ড্যারো আর ব্রায়ানের যুক্তি উপস্থাপন বা বাকবিতণ্ডার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণ স্কোপসের পক্ষে চলে গিয়েছিলেন।
সাধারণ মানুষের সামনে যদি সত্যিকারের বিজ্ঞানের কথাগুলি তুলে ধরা যায়, নিজের সকল কুসংস্কার বাদ দিয়ে সে মুক্তচিন্তা করতেই শিখবে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কি তেমন কোনো উদ্যোগ কখনো নিয়েছে? তথাকথিত ভদ্রলোকরা কী করছে? সাধারণ মানুষের সামনে যুক্তি উপস্থাপন না করে, প্রতিদিন তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে। মার্কস-এঙ্গেলস, লেনিন বারবার বলেছেন যে, মানুষের কাছে বিজ্ঞানের বার্তা নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা চলবে না। খুব লক্ষ্য করলে সবাই দেখবেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল কখনো তাঁর ছাত্রের ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধে না গিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তিনি বহু ক্ষেত্রে ছাত্রের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছেন এবং বিজ্ঞানের মতটা কী তাও বলেছেন। তিনি খুবই ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টাকে গ্রহণ বর্জন করছেন। কখনো উত্তেজনা প্রকাশ করেননি। কিন্তু আমাদের কিছু সাংস্কৃতিক জগতের ভদ্রলোক এবং বুদ্ধিজীবীরা বলতে চাইছেন, মণ্ডলের গ্রেফতার হওয়াটা নাকি মৌলবাদীদের কাজ। মিথ্যাচারের সীমা থাকা দরকার! এখানে মৌলবাদীদের পাচ্ছি কোথায়?
হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ কার লোক? স্পষ্টতই রাষ্ট্রের। তাহলে এই ঘটনায় আসলে দায় যাদের তাদেরকে এড়িয়ে গিয়ে মৌলবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপাবার কারণ বা লক্ষ্যটা কী? বহুকাল ধরেই এই রাষ্ট্রের একদল লোক উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে গিয়ে, ক্রমাগত রাষ্ট্রের সর্বনাশ করেছেন। ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো যা কিছু ঘটে, সব কিছু তাঁরা চাপিয়ে দেন মৌলবাদীদের ঘাড়ে। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’, তেনারা এই নীতিতে বিশ্বাসী। সেই ভদ্রলোকরা যে কাদের মৌলবাদী বলতে চাইছেন সেটাও স্পষ্ট নয়। সেখানেও তাঁদের চিন্তার বিভ্রান্তি ধরা পড়ে। মৌলবাদ কথাটা এসেছে ‘মৌল’ শব্দ থেকে। পদার্থের মধ্যে অনেকগুলি মৌলিক পদার্থ আছে, বাকিগুলি যৌগিক। মৌলিক শব্দটি সেখানে ইতিবাচক। ইংরেজিতে ফান্ডামেন্টাল কথাটা এসেছে বিজ্ঞান থেকে। ‘ফোর ফান্ডামেন্টাল ফোর্সেস অব নেচার’, এই ধারণা থেকে। পরে বাইবেল লীগকে অনেকে ফান্ডামেন্টালিস্ট বলতন এই কারণে যে, তাঁরা খ্রিস্টধর্মের মৌলিক জায়গায় থাকতে চান। ধর্মের বিকৃতি চান না।
বাংলাদেশে যাঁদের মৌলবাদী বলা হচ্ছে, তাঁরা কি ধর্মের মৌলিক জায়গায় আছেন? ইসলাম ধর্ম ‘নর আর নারী’র জন্য শিক্ষা ফরয বা আবশ্যক করে দিয়েছে। যাঁরা নারীর শিক্ষার বিরোধিতা করেন, তাঁরা কি মূল ইসলামে সঙ্গে আছেন? নারীর জন্য শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে মনুসংহিতা। যখন কোনো কট্টর মুসলমান নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলেন, ধরে নিতে হবে তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলিক আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। বরং ইসলামের কথা না বলে তিনি বলছেন মনুসংহিতার কথা। মনুসংহিতার বক্তব্যই তিনি প্রচার করছেন। কী করে সেই মুসলমান ব্যক্তি তাহলে মৌলবাদী হন? কারণ তাঁর বিশ্বাস, মূল ইসলাম ধর্ম থেকে অনেক দূরে। ধর্মের মূল আদর্শ তিনি পাল্টে ফেলতে চাইছেন। তিনি আর যাই হোন মৌলবাদী হতে পারেন না, কারণ ধর্মের মৌলিক জায়গায় তিনি নেই। কী ধারণা থেকে তাঁদের আমরা মৌলবাদী বলছি? বিকৃতির চেয়ে মৌলবাদ কি ভালো নয়?
কিছু মানুষ আছেন গোঁড়া। কট্টরপন্থী। নিশ্চয় কট্টরপন্থীরা সমাজের বহু ক্ষতির কারণ। হোক সে ধর্মীয় কট্টরপন্থী বা অন্য ধরনের কট্টরপন্থী। কট্টরপন্থী কেবল ধর্মের বেলায় হয় না, নানাভাবে হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশারদদের মধ্যেও তো কট্টরপন্থী আছেন। দেবব্রত বিশ্বাসের গান গাওয়া, শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী নাটক সংক্ষিপ্ত করে মঞ্চায়ন করা নিয়ে রবীন্দ্র কট্টরপন্থীরা কী না করেছেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, রাজনৈতিক জগতে কট্টরপন্থী কি কম আছেন? যখন যে যেই রাজনৈতিক দলেরই দালালী করেন, কট্টরপন্থী বনে যান। ডান বাম সবক্ষেত্রে কথাটা সমান। বামরা কট্টরপন্থী বলেই এ দেশে বিপ্লব হয়নি, বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয়নি আর বিপ্লব আগাতেও পারেনি। বরং বিপ্লবী দলের সদস্য সংখ্যা কমছে। ডানপন্থীরা কট্টর বলেই বাংলাদেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়নি গত পঞ্চাশ বছরে। ডিজিটাল আইনে ধর্মকে আঘাত করা নিষেধ। যখন ডিজিটাল আইনের কারণে মানুষ গ্রেফতার হয়, তখনো আমাদের সেইসব পণ্ডিতরা বলেন মৌলবাদীরাই নাকি এর জন্য দায়ী। এর চেয়ে লজ্জা কী হতে পারে?
বহুকাল ধরে আমরা মাদ্রাসাকে আক্রমণ করে চলেছি। মাদ্রাসাকে আক্রমণ করার কারণ যে নেই, তা বলছি না? কিন্তু আমরা ভদ্রলোকরা কি নিজেদের দোষ দেখতে চেষ্টা করছি? আমরা ভদ্রলোকরা কি দেশের অনেক বেশি ক্ষতি করছি না মাদ্রাসার চেয়ে? খবরে যে প্রায় দেখতে পাই, তিন হাজার চার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে; এগুলি কি মাদ্রাসার লোকরা করছে? বাংলাদেশ কি চালাচ্ছে মাদ্রাসার লোকরা? বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে, সেগুলি কারা করছে? বাংলাদেশের সংসদে, আমলাতন্ত্রে, বিচারালয়ে কজন মাদ্রাসার লোক আছে? মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কি সেখানে ঢুকবার সুযোগ পায়? মৌলবাদের নামে তাহলে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায় মাদ্রাসার ঘাড়ে চাপাতে হবে কেন? কোন্ যুক্তিতে? সরকারের বাজেটের ১৮ শতাংশ কাদের পেছনে খরচ হয়? সেখানে কি মাদ্রাসার লোকরা আছে? মাদ্রাসার শিক্ষিতরা কি ‘ইউনিমার্ট’ আর বড় বড় শপিং মলে বাজার করতে যায়? ফলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেশের ক্ষতি করা হচ্ছে, রাষ্ট্রের আসল অপরাধীদের রক্ষা করা হচ্ছে। সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের সেটা করার কথা নয়। মাদ্রাসার শিক্ষিতরা যে দেশকে পশ্চাৎ দিকে টানছে না, তা বলছি না। কিন্তু অন্যের দোষগুলিকে বড় করে দেখার আগে নিজেদের দোষ নিয়ে কথা বলা দরকার।
যদি হৃদয় মণ্ডলের ব্যাপারে কট্টরপন্থীদেরকেই সব দোষ দিতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কি বিভিন্ন উপসনালয় বানাবার জন্য রাষ্ট্র টাকা দিচ্ছে না? সে দায়টা কার? রাষ্ট্র ভুল করলে রাষ্ট্রের কর্তাদের সচেতন করা সুবিধাভোগী ভদ্রলোকদের দায়িত্ব। পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীরা কমবেশি সেই কাজটা করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের লেখাতে সবসময় এই বিষয়গুলি পাওয়া যায়, তিনি রাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন যুক্তির উপরে দাঁড়িয়ে। তিনি কট্টরপন্থী আর ভদ্রলোকদের সমালোচনাও করছেন একই সঙ্গে। কিন্তু আমাদের দেশের ভদ্রলোকরা সেটা না করে সবসময় মৌলবাদীদের অপরাধী হিসেবে খুঁজে বেড়ান। এতে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা হয় না। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন সহ আরো সব মহাজ্ঞানীদের লেখা পাঠ করলে দেখা যাবে, সকলেই মনে করেন ধর্মের উপর সব অপরাধের দায় চাপালে ধর্ম আরো শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়। গত ত্রিশ বছরে ধরে কি তাই হচ্ছে না?
রাষ্ট্র কী চায় সেটা আমরা বুঝতে চেষ্টা করি। যদি হৃদয় মণ্ডলকে বিজ্ঞান পড়াবার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে কি ধরে নিতে হবে বাংলাদেশে বিজ্ঞান পড়ানো যাবে না? সারাবিশ্বে এটা প্রতিষ্ঠিত, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান অগ্রাধিকার পবে। বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্বে বিজ্ঞানের তত্ত্ব মেনে নিতে হবে। ধর্ম প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান আর ধর্মের দ্বন্দ্বে ধর্মীয় বক্তব্য অগ্রাধিকার পবে। চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে গিয়ে কেউ বলতে পারে না যে, আমি শরীরবিজ্ঞানের এই সত্য মানবো না। খুব স্বাভাবিক যে, পরীক্ষায় তাহলে সে কখনোই উত্তীর্ণ হবে না। কারণ তাকে বুঝতে হবে, সে চিকিৎসাশাস্ত্রই পড়তে এসেছে। শিক্ষার্থীর ধর্মীয় বিশ্বাস চিকিৎসাশাস্ত্রে চাপিয়ে দিতে তাকে ভর্তি করা হয়নি। হৃদয় মণ্ডল বিজ্ঞান পড়াবেন এটা তাঁর চাকরির শর্ত, কিন্তু শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের পাঠ বাদ দিয়ে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে চড়াও হবে তার জন্য তাকে ভর্তি করা হয়নি। কমবয়সী বালক শিক্ষার্থী সেটা বুঝতে না পারে, রাষ্ট্রকে সেটা বুঝতে হবে।
হৃদয় মণ্ডল যা পড়িয়েছে সেটা যদি অপরাধ হয়, তাহলে গ্যালিলিওর নাম আমাদের ভুলে যেতে হবে। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিজ্ঞানীদের নাম মুছে ফেলতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষা থেকে তাহলে চিকিৎসাশাস্ত্র আর প্রকৌশলী বিদ্যা বাতিল করতে হবে। সমস্ত বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তুলে দিতে হবে। যদি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী বিজ্ঞানশিক্ষা লাভ না করতে পারে, পরে সে কীভাবে সেই একই বিজ্ঞান শিখবে? বিজ্ঞানের আর ধর্মের এই লড়াই আজকের নয়। ইউরোপে খ্রিস্টান চার্চ সাতশো বছরের বেশি জ্ঞানবিজ্ঞানের শিক্ষা বন্ধ করে রেখেছিল। খুব বিস্ময়ের ব্যাপার, যখন খ্রিস্টানরা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়, গ্রীস আর রোমের বড় বড় দার্শনিকদের লেখা পুড়িয়ে ফেলে, ইসলাম ধর্মের তখনই উত্থান। পঞ্চম-ষষ্ট শতকে চার্চ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, নাটক মঞ্চায়ন সব নিষিদ্ধ করে দেয়, ষষ্ঠ শতকে জন্ম নেন ইসলাম ধর্মের নবী। তিনি নবুয়ত পেয়ে প্রথমেই বললেন নর এবং নারীর জন্য শিক্ষা ফরজ।
মুসলমানরাই তারপর গ্রীসের জ্ঞানবিজ্ঞানকে রক্ষা করে এবং তার চর্চা করে। প্লেটো, অ্যারিস্টোটলসহ ভারতীয় গণিত মুসলমানদের দ্বারাই বিকশিত হয়। বিশেষ করে ইবনে সিনা চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। ফলে মুসলমানদের অগ্রগতি তখন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু মুসলমানরা যখন পরে কট্টর হয়ে পড়লো, তাদের অগ্রগতি বাধা পেল। মুসলমানদের কাছ থেকেই পরে গ্রীসের জ্ঞানবিজ্ঞান পাশ্চাত্যের হাতে পৌঁছায় একাদশ-দ্বাদশ সালে। পাশ্চাত্যের পুনর্জাগৃতি বা রেনেসাঁর পর মুসলামানদের কাছ থেকে আরো বেশি গ্রীসের জ্ঞানভাণ্ডার পেল ইউরোপের বিজ্ঞানচিন্তায় আগ্রহীরা। কিন্তু মুসলমানরা তখন কূপমণ্ডুক হতে শুরু করেছে ওয়াহাবীদের পাল্লায় পড়ে। উমাইয়া আর আব্বাসীরা যে ভূমিকা রেখেছিল জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় তা নিস্তেজ হয়ে পড়লো। মুসলমানদের সেই যে পতন শুরু হলো, এখনো সর্বত্র মার খাচ্ছে। সকলকে বুঝতে হবে, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা বাদ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার আর কোনো রাস্তা নেই। যারা সত্যি এগিয়ে যেতে চায়, তাদের বিজ্ঞানচর্চাকে অগ্রাধিকার দেয়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় নেই। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত পশ্চাদপদ ছিল যে ইউরোপ, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই সেই ইউরোপ সারাবিশ্বে নিজের বিজয় ঘোষণা করেছে।

লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
Raahman Chowdhury

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট