মহাকাব্যকে অসম্মান করবার অধিকার কারো নেই

Comments

প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত/জাতীয় পতাকার মত আরও কিছু সম্পদ থাকে যা হয়ে থাকে জাতির পরিচিতি, অস্তিত্ব, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক। যার সাথে সরাসরি রাষ্ট্রের/জাতির সম্মান জড়িত। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের “স্ট্যাচু অফ লিবার্টি” কিম্বা “Declaration of Independence”। ফ্রান্সের “আইফেল টাওয়ার” বা জার্মানীর “বার্লিন প্রাচীর”। আমাদের রয়েছে “শহীদ মিনার”। ইহুদীদের কাছে “দশ আজ্ঞা” বা মুসলমানের কাছে “মদিনা সনদ” যেমন মূল্যবান দলিল জাতির জনকের কণ্ঠে ৭ মার্চের ভাষণ তেমনই একটি মূল্যবান দলিল বাঙালী জাতির। আমার মতে এটি জনগণের সামনে জাতির “স্বাধীনতার ঘোষণা” বা “Declaration of Independence”। এটি রাষ্ট্রের বা জাতির এক অসামান্য অমূল্য সম্পদ। এর রক্ষণাবেক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব, রাষ্ট্র পরিচালকদের কর্তব্য।

২০১৫ সালে টিভিতে “ইয়াং বাংলা” নামে একটি অনুষ্ঠানের প্রোমো চোখে পড়েছিল। যেখানে দেখানো হলো ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতার উচ্চারিত একেকটি বাক্যের অপভ্রংশ, বঙ্গবন্ধুর কন্ঠ ও ছবি দিয়ে তা প্রচার করা হয়েছিল এবং ঐ অপভ্রংশ বাক্য সম্পূর্ণ করা হয়েছিল অন্য কারো কন্ঠ ও ছবি দিয়ে এবং তা করা হয়েছিল অন্য কোন বক্তব্য প্রকাশার্থে। এর বিরুদ্ধে আমি লিখেছিলাম কারণ এটি ছিল সম্পূর্ণভাবে ঐ ঐতিহাসিক ভাষণের বিকৃতি।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের যাচ্ছেতাই ব্যবহার শুধু যে এভাবেই হয়েছে বা হচ্ছে তা নয় রেডিও টেলিভিশনে এই ভাষণের ব্যবহার হচ্ছে অনেকটা সরকার তোষণের হাতিয়ার হিসেবে, কে কতবার কতভাবে এটি ব্যবহার করতে পারে তার এক প্রতিযোগিতা চলছে যেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নাচে/গানে/নাটকে/সিনেমায় এমনকি আবৃত্তিতেও অপ্রাসঙ্গিকভাবেই হচ্ছে এর ব্যবহার।

এই তোষামোদির মাত্রা রেডিও-টেলিভিশন ছাড়িয়ে মোবাইল ফোনেও জায়গা করে নিয়েছে। মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি কোম্পানীগুলোকে সম্প্রতি (২০২২ সালে) নির্দেশ দিয়েছিল মার্চের ১ তারিখ থেকে সম্ভবত ৭ তারিখ পর্যন্ত প্রত্যেক গ্রাহকের ফোন কলে কলার টিউন হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” লাইনটি বাজাবার। কর্তা ইচ্ছায় কর্ম, তাই হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো যে কোন জাতীয় বা দলীয় দিবসে পথে, ঘাটে, ষ্টেশনে, হাটে, বাজারে, চা দোকানে, ট্রাকে-বাসে এই ভাষণ বাজানোকে তাদের নৈতিক ও আদর্শিক দায়িত্ব মনে করে বলেই প্রতীয়মান হয়। দেখলাম খামারবাড়ী মোড়ে এই মহান দায়িত্বটি পালিত হচ্ছে অনেকটা জাতীয় গুরুত্বের দায় হিসেবেই যেন।

রাস্তার মোড়ে সামনের চেয়ারে পা তুলে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ভাষণটি বাজিয়ে দিয়ে আড্ডা মারা, ভাষণটি বাজাতে বাজাতে মাঝপথে বন্ধ করে অন্য কোন কিছু বাজানো কিংবা লাউডস্পিকারে অথবা ফোনের কলার টোনে সারাদিন বারংবার ভাষণটি বা আংশিক বাজানোকে আমি কোন মতেই সম্মানজনক মনে করি না। এই ভাষণের সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। এই ভাষণের সাথে বাংলার মুক্তি সংগ্রাম, দেশের স্বাধীনতা, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত সম্পর্কিত। আওয়ামী লীগসহ সকলেরই মনে রাখা প্রয়োজন যে এই ভাষণ দলের নয় রাষ্ট্রের সম্পদ।

বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে এদেশে, অজস্র স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ভবন, স্থাপনায় নাম যুক্ত করা হচ্ছে তাঁর। এতে শেখ মুজিবের মর্যাদা কি বৃদ্ধি পাচ্ছে? কর্তারা কি বলবেন ইতিহাসের যে পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সেখানে কি তিনি নিজেই নিজের আসন মহিমান্বিত করতে পারছেন না বলে মনে করেন? আপনাদের বালখিল্য আচরণ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে আলোকিত করতে হবে ইতিহাসে?

এখন ৭ মার্চের ভাষণের যথেচ্ছ, অযথা, অপ্রাসঙ্গিক, অযাচিত ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারীভাবে। এ অবস্থা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এঁর মর্যাদা-সম্মান-ভাবগাম্ভির্য ক্ষুন্ন হোক তা কখনই কাম্য নয়। আর তা সমুন্নত রাখবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের যেমন রয়েছে তেমনই সাধারণ জনগণেরও রয়েছে একথা আমাদের সকলের মনে রাখা উচিৎ।

আমার কাছে ৭ মার্চ বাংলাদেশের “স্বাধীনতা ঘোষণা দিবস”।

রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চ ছিল প্রস্তুত। ময়দান পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজির হয়েছিল সে বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে। শেখ মুজিবর রহমান নিরব হয়ে বসেছিলেন মঞ্চে কিছু সময়। যেন মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন শব্দগুলো, গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ছন্দ যা তাঁর বাংলার নিপীড়িত মানুষের হৃদয় নিঃসৃত।

সেদিনই প্রথম বাঙালীর মনের বাসনা, হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা বজ্রকন্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে আর কেঁপে উঠেছিল পিন্ডির তখতেতাউস…

তারপর হলো ইতিহাস… অঙ্কিত হলো লাল-সবুজের এক পতাকা, জন্ম নিলো একটি মানচিত্র, একটি ভূখণ্ড, একটি বাংলাদেশ।

আমাদের কারো কি সাধ্য আছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেদিনটি, সেদিনের রেসকোর্স, লক্ষ জনতা, বিকেলের রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত সেই মঞ্চ, হাওয়ায় ভেসে আসা প্রতিটি শব্দ কিম্বা সেই বজ্রকন্ঠকে অস্বীকার করবার? তবে কেন অকর্মণ্য রাজনীতিক, স্বেচ্ছাচারী আমলা, অপশাসক আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাশ্রিত চোর-বাটপার ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর করবে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা?

(ছবিতে সেদিন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে ১৯ মিনিটের অলিখিত মহাকাব্য শুরুর আগে মঞ্চে বসে আছেন শেখ মুজিব।)

লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট