মহামতি কার্ল মার্ক্স থাকবেন… । দাউদ হায়দার

Comments

‘পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য তীর্থভূমি পর্যটন এবং মুনি-ঋষির আস্তানা দর্শন অবশ্য কর্তব্য’- রামায়ণ ও মহাভারতে বহুবারই বলা হয়েছে। মুনি-ঋষির গুরুদেব যিনি, তার জন্মভিটে না দেখলে মহাপাপ। পাপ স্খালনেই বোধ হয় হাজার হাজার মানুষ ট্রিয়ারে, কার্ল মার্ক্সের বাড়ির সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশের অপেক্ষায়। শনিবার সকাল ১০টা থেকে। রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা। “এমন দ্রষ্টব্য বাড়ি পৃথিবীতে কয়টি আছে? বাড়ির ‘পুংটা ছাওয়াল’ যদি কার্ল মার্ক্স হন, না দেখে মরা কি ভালো?” বলেই মৃদু হাসি বৃদ্ধার। তার সঙ্গে স্বামী। তিনিও বৃদ্ধ। এসেছেন জাপানের নাগাসাকি থেকে। ‘কার্ল মার্ক্সের দ্বিশত জন্মবর্ষের দিনটি (৫ মে) উপলক্ষেই কি এসেছেন?’ এই প্রশ্নে সরল উত্তর, ‘চার সপ্তাহের জন্য ইউরোপে এসেছি। প্রথমেই এখানে, ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে। সন্ধ্যায় ফ্রাঙ্কফুর্ট ফিরে যাব। ট্রিয়ারে কোনো হোটেল পাইনি। কোথাও ঠাঁই নেই।’

ক্ষুদ্রাকারে কার্ল মার্ক্সের জীবন

-আপনারা কি কমিউনিস্ট, কমিউনিজমে বিশ্বাসী?

বৃদ্ধের কথা, ‘প্রশ্নটি অবান্তর। কমিউনিস্ট বা কমিউনিজমে আস্থাশীল কারোর চোখেমুখে লেখা নেই। সব সৎ মানুষই সাম্য, সমাজবাদে দেশসমাজে দীপ্ত। কমিউনিজমের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতেই হবে- নিশ্চয় কেউ ফতোয়া দেয়নি। কার্ল মার্ক্স সর্বকালের মহামানব। ধর্মীয় নেতা নন। জাতি, ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে তিনি। মহামানবের জন্মভিটে আমাদের কাছে তীর্থভূমি। মরার আগে দেখতে এসেছি।’

কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বৃদ্ধা কেন বলেছেন ‘পুংটা ছাওয়াল’ (নটি বয়)? কার্ল মার্ক্সের জীবনী খুঁটিয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সন্দেহ নেই। কার্ল মার্ক্সের বয়স যখন ছয় বছর, খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষাপ্রাপ্ত (ব্যাপটাইজড) চার্চে, চার্চ থেকে বেরিয়েই ওই বয়সে বাবাকে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন। ‘ছাওয়ালে’র কাণ্ডজ্ঞানে বাবা হতভম্ব। এহ বাহ্য। ধর্মকে অবজ্ঞা। কিছুতেই ধর্মে মতি ফেরাতে পারেননি বাবা (হাইনরিশ) এবং মা (হেনরিয়েটা প্রেসবুর্গ)। যতদিন জীবিত ছিলেন। ‘ছাওয়াল’ যে কতটা ত্যাড়া, একগুঁয়ে- বাবা-মা হাড়ে-মজ্জায় জেনেছেন।

‘মহানায়ক মানব’ (দ্য গ্রেটেস্টম্যান) নামে একটি বই পড়েছিলাম অনেক বছর আগে। মূলত জীবনী (কাল মার্ক্সের)। এক অধ্যায়ে আছে মার্ক্সের নানা ত্যাদড়ামির কাহিনী। যুবক বয়সে মদ গিলে হুজ্জোতি, জেলে দিন কয়েক। মতবিরোধে বন্ধুকে পিটিয়েছেন। বন্ধু আহত। তাকেই আবার সেবা-যত্ন। সাহায্য। কিন্তু ক্ষমা চাননি। আপাতদৃষ্টিতে খুব রুক্ষ, অথচ অন্তরঙ্গে কোমল। প্রেমিক। কবিতা না লিখেও কবি সংঘের (পোয়েটস ক্লাব) সদস্য, মাতব্বর।

মার্ক্সের বাড়িতে, প্রদর্শনীশালায় যেসব ছবি প্রদর্শিত (চিঠিসহ), ছবির সংখ্যা (অধিকাংশই শিল্পীর আঁকা। তখন ‘ক্যামেরার যুগ’ নয়) বেশি নয়।

– কে জানত, পরবর্তীকালে বিশ্বের মহামানব হবেন!

প্রদর্শনীতে বাবাকে লেখা কিছু চিঠি (হাতের লেখা অসাধারণ। ঝকঝকে। স্পষ্ট। কাটাকাটি সামান্য), কমিউনিস্ট মানিফেস্টোর ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ, দাস কাপিটাল-এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ। আছে গত দেড়শ’ বছরে প্রকাশিত দুই বইয়ের প্রচ্ছদ-অলঙ্করণ। মজা লাগল দেখে, জার্মান বা রুশ ভাষায় নয়, চীনা ভাষায় দুই বইয়ের নানা প্রচ্ছদ (শতাধিক তো হবেই)। নানা সংস্করণ।

মহামতি কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে জীবনীসহ কত ভাষায় কত বই প্রকাশিত? প্রদর্শনীতে সব নেই নিশ্চয়, লক্ষাধিক কি? তালিকা কয়েক ফর্মার। বাংলায় প্রকাশিত গোটা ছয়েক বইয়ের নাম দেখলাম। কলকাতার বই।

‘শুনেছি, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি আছে, মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সের দ্বিশতবর্ষে কী কী অনুষ্ঠান করছেন?’

ট্রিয়ার মিউজিয়ামের একজন জিজ্ঞেস করেন। বললাম, ‘পুরো তালিকা অজানা।’ বলিনি, মার্ক্সে বিশ্বাসীরা আজকাল হজ করেন।

মার্ক্সবাদের বদলে ইসলামী। দে আর গ্রেট ন্যুইসেন্স।

কার্ল মার্ক্সের ২০০তম জন্ম দিবসে, ট্রিয়ারে বহুদেশের মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, মার্ক্সীয় দার্শনিক, বিশেষজ্ঞ, সমালোচক, রাজনীতিক। ভারত থেকেও আগত। কেউ নিমন্ত্রিত, কেউ গাঁটের কড়ি খসিয়ে। বাংলাদেশের কাউকে দেখলাম না। কেউ থাকবেন হয়তো। চেহারায় চিনি না। দু’তিনজন প্রৌঢ় বাঙালিকে দেখেছি। অন্তত চেহারায় বাঙালি। ভ্রামণিক হতে পারেন কিংবা এই শহরের বা জার্মানির অন্য শহরের বাসিন্দা।

মার্ক্সের পিতাসহ এবং বাবা গরিব ছিলেন না। বাড়িঘর নির্মাণে শৌখিন অবশ্যই। ব্যারাক ধাঁচে তথা স্থাপত্যকলায় নির্মিত বাড়ি। সামনে লন। একসময় লন বড় ছিল বোধ হয়। নগর পরিকল্পনায় লনের একাংশ কেটে সড়ক তৈরি।

ট্রিয়ার ঘিরে আছে মোজেল ভ্যালি। মোজেলের নামেই জার্মানির বিখ্যাত ওয়াইন ‘মোজেল’। হোয়াইট ওয়াইনই বেশি প্রস্তুত। ভেবেছিলাম, কার্ল মার্ক্সের দ্বিশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে ওয়াইনের দাম কম হবে। বরং উল্টো। এই মওকায় ব্যবসা।

ট্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে শুনলাম, বক্তা য়্যুর্গেন নেকে (নতুন আলোকে মার্ক্সের জীবনচরিত রচয়িতা। এই বছর মার্চে প্রকাশিত)। জানালেন, ‘২০০ বছর আগে, মার্ক্সের জন্ম সালেও ট্রিয়ারে মাত্র ১২ হাজার মানুষের বাস ছিল। প্রত্যেকেই প্রায়-প্রত্যেককে চিনতেন এবং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের হাঁড়ি-হেঁসেলের খবর রাখতেন। মার্ক্সের বাল্য-কৈশোরের গোপন প্রেমের কেচ্ছাও। যদিও প্রেমিকাকেই বিয়ে করেন।’ বলে মুচকি হেসে সংযোজন, ‘এখন পাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে কার সঙ্গে প্রেম করে জানা অসম্ভব। জানতে চাওয়া অসভ্যতা। অন্যায়ও।’

আরেক বক্তা, ইংরেজিভাষী লেখক, জ্যাসন বারকার, কমিউনিস্ট, অধ্যাপনা করেন দক্ষিণ কোরিয়ার কেয়ুং হে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফিলসফির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, মার্ক্সকে নিয়ে সাড়া জাগানো উপন্যাস লিখেছেন, নাম ‘মার্ক্স রিটার্নস্‌’। বললেন, ‘গত দেড়শ’ বছরে কার্ল মার্ক্সই শিখিয়েছেন, সঠিক যুক্তি প্রয়োগে কী করে প্রতিবাদ করতে হয়। প্রতিবাদী হতে হয়।’ তার আরও কথা, ‘ মার্ক্স ছিলেন বলেই একজন লেনিন, একজন মাও সে তুং, একজন চে গুয়েভারা, একজন ফিদেল কাস্ত্রো, এমনকি একজন গান্ধী হন। মূলে তিনিই (কার্ল মার্ক্স)। আজকের দিনে যে সামাজিক বিচার-বিধান নিয়ে সংগ্রাম (সোস্যাল জাস্টিস মুভমেন্ট), ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, অবদান মার্ক্সের। ধনী, বিত্তবান, প্রভাবশালী, সমাজরাষ্ট্রের কেউকেটার বেলেল্লেপনা, যৌন অত্যাচার নিয়ে নারীরা জানাচ্ছেন, নির্ভয়ে প্রতিবাদ করছেন, বিচার চাইছেন। (‘মি ট্যু’ নামে খ্যাত), প্রেরণাদাতা কার্ল মার্ক্সই।

রাষ্ট্রীয় সমারোহে মার্ক্সের দ্বিশত জন্মবর্ষ উদযাপনে মিছিল, প্রতিবাদ, হাঙ্গামাও কোথাও কোথাও। ট্রিয়ার শহরেও।

হালের রাজনৈতিক দল, গত বছর জাতীয় নির্বাচনে তৃতীয়, ১৩ পার্সেন্ট ভোট পেয়ে সংসদে আসীন, এএফডি (অলটারনেটিভ ফ্যুর ডয়েচল্যান্ড), চরম দক্ষিণপন্থি, মার্ক্সের জন্মদিনেই, ট্রিয়ারে মিছিল-বিক্ষোভ করেছে মার্ক্সের বিরুদ্ধে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। শহরের মেয়র-শাসকের বিরুদ্ধে। মার্ক্সের মূর্তি উন্মোচনের সময় আরও বেশি লম্ম্ফঝম্ম্ফ। দেখি, অনেকের হাতেই মার্ক্সের বিশাল ছবি। ছবিতে মার্ক্সের মুখে কালো কালি, ক্রস চিহ্ন।

মার্ক্সের ১৫ ফুট মূর্তি তৈরি করেছেন চীনের ভাস্কর য়্যু ওয়াইশান। মুখে দাড়ি (মার্ক্সের মতো গালভর্তি নয়)। চীন সরকারের অর্থে ব্রোঞ্জ মূর্তি নির্মিত। মার্ক্সের ২০০ জন্মবর্ষ উপলক্ষে চীন সরকারের উপহার ট্রিয়ারকে। উন্মোচনের আগে মার্ক্সের মূর্তি ছিল লাল কাপড়ে আচ্ছাদিত। তা নিয়েও এএফডির মিছিলে শুনলাম, ‘লাল কাপড় কেন? এ তো চীনা কমিউনিজম!’ মূর্তি স্থাপন এবং আবরণ উন্মোচন শেষে ট্রিয়ারের মেয়র ওলফ্রাম লাইবে বললেন, ‘কার্ল মার্ক্সের দ্বিশতজন্মবর্ষে মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষমাত্র। পৃথিবী যতদিন থাকবে, মহামতি মার্ক্স থাকবেন।’ দেখি, ২০০ বেলুন ওড়ানো হলো। নানা রঙের বেলুন। সব বেলুনেই কার্ল মার্ক্সের ছবি।

লেখক:
Dawood Haidar
দাউদ হায়দার, কবি

(লেখাটি কার্ল মার্ক্সের দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত। – বিভাগীয় সম্পাদক)

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.