মাদক দ্রব্য ইয়াবার ব্যবসায়ীর জন্য আইনের ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। ইয়াবা উৎপাদন, পরিবহন, বিপণন কারী এই শাস্তির আওতায় পড়বেন। ইয়াবা (অ্যামফিটামিন), শিশা ও ডোপ টেস্টসহ সব ধরনের মাদককে নতুন এই আইনে যুক্ত করা হয়েছে।
২৭ অক্টোবর, শনিবার, সংসদের কার্যক্রম শুরু হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন।
হেরোইন, কোকেন ও কোকা থেকে তৈরি মাদক, মরফিন, টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল, অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন, মেথাডন জাতীয় মাদকের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান আগের আইনেই ছিল।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, এসব মাদক ২৫ গ্রামের বেশি কেউ বহন, পরিবহন বা স্থানান্তর এবং আমদানি বা রপ্তানি করলে কিংবা চাষাবাদ, উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণে জড়িত হলে শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মুত্যুদণ্ড।
বিলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ এর অধীন প্রতিষ্ঠিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বহাল রাখার পাশাপাশি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় স্থাপন এবং প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে যে কোনো স্থানে অধিদপ্তরের অধঃস্তন বা শাখা কার্যালয় স্থাপনের বিধান করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এ সময় বলেন, ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা আছে, ৫০ গ্রাম মাদক পাওয়া গেলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৯৬ জনকে বিভিন্ন অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাদক আইনে কারো মৃত্যুদণ্ড হয়নি। এবারের আইনে ইয়াবার ব্যবহার এবং মাদকে অর্থলগ্নিকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করেন। জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, সেলিম উদ্দিন, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, বেগম রওশন আরা মান্নান, বেগম নূর-ই-হাসানা লিলি চৌধুরী, নূরুল ইসলাম ওমর, ডা. আককাছ আলী সরকার, নূরুল ইসলাম মিলন ও বেগম মাহজাবীন মোরশেদ বিলের ওপর জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাব আনলে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
এ বিলের ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করে জাতীয় পার্টির সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “নিষ্ঠুর আইন। ২৫ গ্রাম পরিমাণের মাদক পেলেই সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মুত্যুদণ্ড। অনেক বাহক নিজেও জানে না যে সে হেরোইন বহন করছে। এর সঙ্গে পুলিশও জড়িত।”
‘মৃত্যুদণ্ড’ বা ‘যাবজ্জীবন’ এর আগে ‘সর্বোচ্চ’ শব্দটি না থাকার কথা উল্লেখ করে শামীম হায়দার বলেন, “এ কারণে বিচারকের পক্ষে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। বেশ কয়েকটি ধারায় এই শাস্তির কথা বলা আছে। সুতরাং আইনটি পাসের আগে জনমত যাচাই করা দরকার।”
বিলে অ্যালকোহল ব্যাতীত অন্যান্য মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, মজুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইয়াবা, সিসা ও ডোপ টেস্টসহ সব ধরনের মাদককে নতুন আইনে যুক্ত করা হয়েছে।
বিলে অ্যালকোহল উৎপাদন সম্পর্কে বিধি-নিষেধ, অ্যালকোহল পানে বিধি-নিষেধ, মাদকদ্রব্য ব্যবস্থাপত্র প্রদান সম্পর্কে বিধি-নিষেধ, লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স প্রদানে বিধি-নিষেধ, লাইসেন্স ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, লাইসেন্স বাতিল, লাইসেন্স স্থগিতকরণ, মাদকদ্রব্যের দোকান বা পানশালাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিধান করা হয়েছে।
পাশাপাশি বিলে মাদকদ্রব্য প্রতিরোধে তল্লাশি, গ্রেফতার, আটক, ক্রোক, বাজেয়াপ্ত, তদন্ত, ব্যাংক হিসাব পরীক্ষা ও নিষ্ক্রিয়করণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
আগের আইনে অ্যামফিটামিনযুক্ত যে কোনো মাদককে ‘খ’ শ্রেণির মাদক হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ৫ গ্রাম পর্যন্ত মাদকের জন্য ছয় মাস থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং তার বেশি ওজনের মাদকের জন্য পাঁচ বছর থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। মেথঅ্যামফিটামিন জাতীয় মাদক ইয়াবা এই শ্রেণিতে পড়ে বলে এতদিন ওই শাস্তিই প্রযোজ্য হত। এখন ৪০০ গ্রাম ইয়াবার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিবৃতিতে বলেন, ‘শিশা বার’ এর অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ড সার্বিক আইনশৃঙ্খলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া মাদক সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ার আরও সম্প্রসারণের প্রয়োজনের কথাও তিনি বলেন।
‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১৮’ তে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটনে কাউকে প্ররোচনা দিলে, সাহায্য করলে বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তাকেও সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনে অর্থ বিনিয়োগ, সরবরাহ, মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিলে তার ক্ষেত্রেও একই শাস্তি হবে।মাদকের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, স্থানান্তর, আমদানি, রপ্তানি, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়, হস্তান্তর, অর্পণ, গ্রহণ, প্রেরণ, লেনদেন, নিলামকরণ, ধারণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, সেবন, প্রয়োগ, ব্যবহারকে এ আইনে অপরাধ গণ্য করা হবে।”
এ আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, অ্যালকোহল ব্যতীত অন্যান্য মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার হয় এমন কোনো দ্রব্য বা উদ্ভিদের চাষাবাদ, উৎপাদন, বহন, পরিবহন বা আমদানি-রপ্তানি, সরবরাহ, বিপনন, গুদামজাত, সেবন বা ব্যবহার, অর্থ বিনিয়োগ বা পৃষ্ঠপোষকতা করা যাবে না।”
৩৬ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি আইনের এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
১১ ধারায় বলা হয়েছে, পারমিট ব্যতীত কোনো ব্যক্তি অ্যালকোহল পান করতে পারবেন না। চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন বা সরকারি মেডিকেল কলেজের কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো মুসলমানকে অ্যালকোহল পানের পারমিট দেওয়া যাবে না। তবে মুচি, মেথর, ডোম, চা শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তাড়ি ও পঁচুই এবং পার্বত্য জেলা বা অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে তৈরি করা মদ পান করার ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।
৩৩ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি মাদকের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থেকে অবৈধ অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহে লিপ্ত রয়েছেন- মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার এমন সন্দেহ হলে তিনি সন্দেহজনক ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব বা আয়কর নথি পরীক্ষা করতে পারবেন এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
বিলে মাদকদ্রব্য সম্পর্কিত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৫ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। বিলে মাদকদ্রব্য জনিত অপরাধের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করারও বিধান করা হয়েছে।
এছাড়া বিলে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা, মাদকদ্রব্য অপরাধ আমলযোগ্যতা, জামিন, বিচারের বিশেষ পদ্ধতি, বিচার সমাপ্তির মেয়াদ, অভিযোগ শিশুর বিচার পদ্ধতি, ফৌজদারি কার্যবিধির প্রয়োগ, মোবাইল কোর্ট আইনের প্রয়োগ, জটিলতা নিরসনে সরকারের ক্ষমতা, বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়েও বিধান করা হয়েছে।
বিলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ রহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর প্রথম ও দ্বিতীয় তফসিলে মাদকদ্রব্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্যাদি ব্যবহারে মাদক শুল্কের হার, দ্বিতীয় তফসিলে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
বাঙালীয়ানা/টিএইচ/জেএইচ