মানবিক-অযান্ত্রিক । তরীকুল ইসলাম সৈকত

Comments

এয়ারপোর্ট। ছ’ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবী পড়া, সৌম্য চেহারার মানুষটা অপেক্ষা করছেন। নাম ভবা। তার বোন আসবে কুমিল্লা থেকে। নাম ভবী। তার আসতে দেরী হচ্ছে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটা উড়ে যাওয়ার জন্য তৈরী। বিমান যখন ছাড়বে তখন এলো বোন। এয়ার ইন্ডিয়ার কাছে দশ মিনিট সময় চেয়ে নেয়া হলো। একই মাতৃ জঠর ভাগ করে এই পৃথিবীর বুকে আসা দুই ভাই বোন জড়িয়ে নিলেন একে অন্যকে।

জমজ ভাই বোনের এই বিদায়ে পার হয়ে গেল এক ঘন্টা। অথচ বিমান কতৃপক্ষ বা বিমান যাত্রীরা কেউ কোন অভিযোগ জানালেন না। কারণ ধর্মের নামে দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার সীমা রেখা দাগ টেনে দিয়েছে ‘মানবিক-অযান্ত্রিক’ এই মানুষটা আর তার বোনের মাঝে। পৃথিবীতে এসেছেন একই মায়ের গর্ভে। কিন্তু আজ বোনকে দেখতে ভাইয়ের আসতে হলে পাসপোর্ট লাগে। ভবী বছর চারেক আগে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের নাগরিক আর ভবী ভারতের। বিমানে নিজের আসনে বসেই ছেলে মানুষের মত কাঁদতে লাগলেন ভবা। বিমানার জানালা দিয়ে শেষ বারের মত দেখে নিলেন পদ্মাকে। তার ওখানে যে এই পদ্মার নামই গঙ্গা।

কলকাতায় ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন মানুষটা। ওদিকে বোনটাও ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্টাররাও জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ ১৯৭৬-এর ৬ ফেব্রুয়ারী বোনকে একা ফেলে ওপারে পাড়ি জমালেন ভবা। আর দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর ভবি প্রাণে বেঁচে গেলেন। একই গর্ভ থেকে পৃথিবীতে ভবার সাত মিনিট পরে আসা ভবী তার ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেলেন তিন বছর পর।

ভবার ভালো নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক। ভবীর ভালো নাম প্রতীতি দেবী।

ঋত্বিক কুমার ঘটক। ঋত্বিক ঘটক নামেই আমরা যাকে জানি। শুধু পরিচালকই যার একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি একজন বিপ্লবী, গণনাট্যকর্মী, চিত্রনাট্যকার, বাবার সরকারী চাকুরীর সুবাদে প্রায় পুরো বাংলাই তার চেনা। ত্রিশের দশকে স্কুলে পড়ার সময় কাটিয়েছেন রাজশাহীতে। বাড়ির ছাদে দাড়ালেই পদ্মা দেখা যেত। বিকেলে ভবীকে নিয়ে সাইকেলে করে ঘুরে বেড়াতেন পদ্মার তীর ধরে। তাই পদ্মার প্রতি তার এতো আবেগ এতো ভালোবাসা।

দেশ ভাগ কে তিনি মেনে নিতে পারেনি কোনদিনই। বার বার তিনি বলেছেন তার শেকড় থেকে তাকে টেনে উপড়ে ফেলা হয়েছে। বাংলা বিভাগ ছিল তার ভাষায় ভাঙ্গা বাংলা । দেশ যখন পরিবারের সাথে ওপারে চলে গেলেন তখন বোন ভবী(প্রতীতি দেবী) রয়ে গেলেন এপারে। তার বিয়ে হয়েছিল ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের ছেলে সঞ্জীব দত্তের সাথে কুমিল্লায়। এদিকে বোনকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা আর কলকাতায় গিয়ে শুনলেন নাড়ি ছেড়া মানুষ গুলোর অসহায় আর্তনাদ। এ মানুষ গুলোর রাজনীতির সাথে কোন যোগ ছিল না, তারা রাজনীতি বুঝতো না। কিন্তু উপর মহলের লোভী মানুষ গুলোর লালসার শিকার হয়ে তারা সব হারিয়েছে।

সব দেখে যারা চোখ সরিয়ে নেয় ঋত্বিক তাদের দলে নাম না লিখিয়ে গল্প, নাটক, চলচ্চিত্র যাই করলেন, সব কিছুর মূল উপজীব্য হয়ে দাড়ালো সেই সব আহত মানুষ গুলো যারা সব হারিয়ে হয়েছে হয় ভিখিরি নয়তো বেশ্যা। এসব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ভুলে গেলেন নিজের ক্যারিয়ারের কথা। টাকার পেছনে ছুটলে তিনি হয়তো হতেন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রিন্সিপাল। কিন্তু তিনি বানালেন সিনেমা। মানবিক সিনেমা।

আটটি সম্পূর্ন কাহিনীচিত্রের মধ্যে পাঁচটিতেই আমরা পাই দেশ বিভাগের ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্তের দাগ। ‘নাগরিক, মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা এবং যুক্তি তক্কো আর গল্প’-এর প্রতিটি চরিত্রই তিনি নিয়েছেন তার চারপাশ থেকে। যারা আহত হয়েছে দেশ ভাগের হামলায়। নীলকন্ঠ বাগচী, হরপ্রাসাদ, বঙ্গবালা, ঈশ্বর, সীতা, উমা, সাগর, নীতা, শংকর, অভিরাম এরা কেউই কাল্পনিক ছিলেন না। বাঙালী ঋত্বিক তার চারপাশে যারাই ওপার বাংলা থেকে এসে আহাজারি করেছে তাদেরই তিনি বন্দি করেছেন সেলুলয়েডের ফিতায়।

শতভাগ বাঙাল ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। কলকাতায় এতো বছর কাটানোর পরেও তার কথায় ঢাকাই বাংলার টান কমেনি এতটুকু। তার সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছেন, “ওঁর ছবিতে যে হৃদয় নিংড়ানো ব্যথার প্রকাশ তা আর কারো সিনেমায় পাই নি আমরা। ঋত্বিক ছিলেন মনে প্রাণে খাঁটি বাঙালী, তার ছবির বিন্যাসে সেই বাঙালীয়ানার ছাপ প্রকট। ওঁর মত বাঙালিয়ানার বড়াই আমিও হয়তো করতে পারিনা।“

দুই বাংলার মিলন চেয়েছেন সব সময়। চেয়েছিলেন দুই বাংলাকে এক করতে। কারো ধার ধারেননি কোনদিন। টাকা পয়াসার পরোয়াও করেননি। তার মতে, “দুই বাংলার ভেতর যে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে সেটা প্রতারণা। বাংলা কিন্তু একটাই। বিভাজনটা হয়েছিল একদমই দ্বিজাতিতত্বের পথে। এটা অনেকটাই কৃত্রিম এবং এটাকে ক্ষমা করার অহিকার কারোর নাই। এটা যেহেতু হয়ে গেছে সেহেতু কিছু করার নাই-এই ধরনের নানা কথা বলা হয়। বিষয় হলো সাংস্কৃতিক ভাবে বাংলাকে আলাদা করা যাবে না।“

\
দেশভাগের বা তার ভাষাতে ভাঙ্গা বাংলাকে নিয়ে তার আক্ষেপ ছিল চিরকালের। তিনি ছিলেন পূর্ববাংলার শেকড় হারাদের একজন। সব কিছুকে ছাড়িয়ে তিনি হতে চেয়েছিলেন একজন প্রকৃত মানুষ। মানবতার পক্ষের শিল্পী। তাই তার ছবি ছিল মানবতাকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে। জীবনকে নিয়ে বার বার আশার গল্প চিত্রায়ন করেছেন সাবলীল ভাবে। এই মানবতাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শিক্ষকতা করেছেন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে দুই বছর। ছাত্রদের বুকের ভেতর লালন করতে শিখিয়েছেন মানবতাবোধকে। তিনি বলেছেন,“আমার জীবনে যে সামান্য কয়টি সিনেমা আমি করেছি সেগুলো যদি পাল্লার একদিকে রাখা হয়, আর মাস্টারি যদি আরেক দিকে রাখা হয়তবে মাস্টারিটাই ওজনে বেশি হবে।“

তিনি নিজেকে ফিকশনাল পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালক বলার চাইতে প্রামান্যচিত্রের পরিচালকই বলতে চাইতেন। কারন তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। নিজেও বলতেন যে মানুষকে ভালো না বাসলে প্রামান্যচিত্রের চিত্র গ্রহন সম্ভব না। আইজেনস্টাইনকে গডফাদার মানলেও ঋত্বিকের সিনেমায় সে প্রভাব খুব সামান্যই। সত্যজিৎও বলে গেছেন সে কথা। বাঙালিয়ান যে নিখুঁত স্বকীয়তা তিনি দেখিয়েছেন তার সিনেমায় তা অন্য কারো সিনেমায় দেখা যায় না আজও।

১৯৪৮ থেকে ১৯৭১। বাংলায় সে সময় আর পা রাখলেন না অভিমানী ঋত্বিক। ১৯৭২ সালে আবার বাংলাদেশে এসেছিলেন ২১ শে ফেব্রুয়ারির এক রাস্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। ১৯৭৩-এ বাংলাদেশে বানালেন অদ্বৈত মল্লবর্মনের উপন্যাস অবলম্বনে “তিতাস একটি নদীর নাম।“ তৈরি করলেন বাংলাদেশের সিনেমার এক অস্পৃশ্য মাইল ফলক।
বিপ্লবী এই মানুষটা বলতেন,”আমাকে আরও যন্ত্রণা পেতে হবে। আমার অধিকার আছে আমার মতো কাজ করে বেঁচে থাকার, মধ্যবিত্ত মার্কা লুতুপুতু জীবন আমার ভালো লাগে না। কোন শালা আমার জন্য সত্যিকারের কিছু ভেবেছে? আমিই হয়ে গেলাম উপহাসের পাত্র। আমি বুঁদ হয়ে থাকি সৃষ্টির জগতে। প্রতিদিন কিছু আহরণ করি জীবন থেকে, বেঁচে থাকাটাই যেখানে এক বিস্ময়। নিজের চরকায় তেল দাও… না হলে বসে বসে মাঝে মাঝে ল্যাজ নাড়াও!”

বাংলা সিনেমার এক অদ্বিতীয় আনসাং হিরো। কারো পরোয়া না করে কাজ করেছেন নিজের মত করে। টাকা বা পরিচয় কোন কিছুর পিছনে ছোটেননি। তার কাছে তার সবচে বড় পরিচয় তিনি মানুষ। আর মানুষের সবচে বড় কাজ মানবতার জন্য কাজ করা। তাইতো তার প্রতিটি সিনেমা পরিনত হয়েছে মানবতার অনন্য দলিলে।

 

এই লেখায় আমি সহায়তা নিয়েছি মনিস রফিকের দুটি বই ‘চলচ্চিত্র বিশ্বের সারথি’ ও ‘সুবর্ণরেখাঃ প্রসঙ্গ ঋত্বিক’ এবং উদিসা ইসলামের ‘মুখোমুখি ঋত্বিকসত্যজিৎ’ বই আর ইউটিউবের। -লেখক

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাঙালীয়ানা/এসএস/

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.