মাহবুবা খান দীপান্বিতার কবিতা

Comments

চিরকুট

এক বিকেলে ফুরিয়ে যাওয়া আলোর সাথে সে
ফুরালো। সে হারালো কিন্তু আমার মনের মাঝে
সকল কাজে গান হয়ে সে বাজে।
জলের তলে যেমনভাবে আগুন জ্বলে।
যেমন ভাবে মেঘ গর্জন ময়ূর শোনে তুমুল রাগে।
পেখম মেলে, ছন্দ তুলে- তেমন করেই
আকাশ থেকে তারই হয়ে পদ্য নামে।
তাকে আমি লুকাই আমার বুকের নিচে।
কখনো-বা খুলে দেখি, নিষিদ্ধ বই মলাট খুলে
যেমন দেখে। ওলটপালট স্বপ্ন তখন চিমটি কাটে।
ঘুমের ঘোরে নিয়মিত পদ্য লিখি কেটে-কুটে।
আরো সবি লেখা আছে সে চিরকুটে।

কবি ও বৃক্ষের স্বর

রাত গভীর হলে বৃক্ষেরা কথা বলে।
খুব পবিত্র সে কণ্ঠস্বর।
মানুষের এই ভাষা জানা নেই।
মানুষ চেনে না সে রূপ। বোবা-কালা
নারীর আকার ইঙ্গিতের মতো; অদ্ভুত
গোঙানির মতো গাছদেরও হয় সবি সংগোপনে।
তারা জোৎস্নায় কথা বলে সুনিবিড়, সুকোমল
অর্থবোধক বাক্যে। আবদ্ধতার যন্ত্রণাকে উগরে দিয়ে
আরাম পায়। তারপর তারা মায়াবতী হয়।
দুঃখ-আশ্রয়ী কবিদের মতো।
কবিদেরও দেখেছি যন্ত্রণা, বিষাদ আর
অসহায়ত্ব নিয়ে গৃহত্যাগী হতে। আম জনতারা
হাসে আর কবিদের বলে পাগল।
কেননা তারা বৃক্ষের আর্তনাদ শুনতে পায় না।
কেননা তারা দীর্ঘদিন ধরে বধির হয়ে আছে।
ঘুমন্ত শহর, গ্রাম, লোকালয় কিংবা আকাশের ওপারে
যারা বন্দি, স্বরচিত সংসারে যারা মাথা কুটে,
তাদের প্রতিনিধি হয়ে কবি একা উঠে যায়
বৃক্ষের গোপন মিনারে। নিজের বেদনা
নিজের প্রাণপাতালে ধারণ করে
পেরিয়ে যায় অলৌকিক শব্দের সিঁড়ি।
তারপর থেকে উভয়ের সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা।
এরপর নির্মেদ, নির্ভার জীবন।

আমার জন্মমাস

অতিথি পাখিদের কলরবে মুগ্ধ-প্রাণবন্ত 
একটি সকালে আমার জন্ম হয়। আমি নাকি
প্রচন্ড শীতে উদোম শরীরে বেশ বীরত্বের
পরিচয় দিয়েছিলাম। মুহুর্মুহু চিৎকার করছিলাম,
শীতের কাঁপুনি ছিলো; না তার বদলে হাত পা
ছুঁড়ছিলাম। চারটি আঙ্গুল গোগ্রাসে গিলতে
চেষ্টা করছিলাম আর ক্ষণে ক্ষণে উচ্চগ্রামে
বাজছিল আমার কন্ঠস্বর। মা-খালারা বলেছিল,
‘মাঘ মাসে বাঘ অইছে’।
বেশি বেশি আদর পেয়ে রাগী কিংবা বদমেজাজি
হয়ে ওঠলাম। তবে আমার এই সহজাত রাগ
সকলের সাথে নয় কেবল মায়ের মতো
গোপন আশ্রয়ে গোপনেই প্রতিফলিত হতো।
মা ছাড়া এত অকৃত্রিম ঔদার্য কোথায় পাবো?
প্রতিটি পৌষ-মাঘে অর্থাৎ আমার জন্মমাসে
শরীর ও মনে ফিনফিনে আনন্দের অনুভূতি
ঘিরে থাকতো আমায়। মাঠময় পাকা ধান,
অতিথি পাখির কিচিরমিচির, শীতের ভাপা-পুলি,
কুয়াশার চাদর ভেদ করে বেড়ে ওঠা মিঠেল রোদ
আমাকে খুব খুশি করতো। আমার জন্মমাসের প্রতি
কৃতজ্ঞ থাকতাম। এভাবে অনেকগুলো জন্মদিন
আমার কেটে গিয়েছে সানন্দে।
তারপর একদিন মাঘে আর মেঘে দেখা হলো।
আমার জন্মদায়িনী মা একরাশ উজ্জ্বল আলোকে
উপেক্ষা করে অস্তগামী সূর্যের মতো নিভে গেলো।
আমার আর কোনো জন্মদিন নেই, আর কোনো
মাঘ মাস নই। আমি আর মাঘ মাসের বাঘ নই।
জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা নিতান্তই এক নিরীহ প্রাণী।
যার বুকে ব্যাথা হয়, দম আটকে আসে
আর তখন ইচ্ছে করে-  কুয়াশা দু’হাতে সরিয়ে
যদি আমার মাকে দেখতে পেতাম। আমি
মাইলের পর মাইল হাঁটি। কুয়াশা সরে যায়
কিন্তু মাকে আর কাছে পাই না। প্রচন্ড শীতে
মরে গেলেও মায়ের আদর পাই না।
যদি পেতাম। মাকে যদি একবার দেখতে পেতাম!

মানুষ ছাড়াও

যার কেউ নেই- তার বাগানে রক্তজবা ফোটে না?
তার কিছু নেই?
মোটেই না।
যার কেউ নেই তারও কিছু স্বপ্ন থাকে,
তারও বুকের বাম কোণাতে কেউ তো থাকে!
তারও থাকে সুনীল আকাশ
হিমেল দীঘি চুইয়ে আসা সজীব বাতাস
তারও আছে একখানা চাঁদ
অন্ধকারে সেও তো গুনে আলোর প্রমাদ

যার কেউ নেই তারও তো এক নদী থাকে বুকের ভিতর
জল ছলছল চোখ বলে দেয় শান্ত পাহাড় নিরেট নিথর

পাহাড় ডাকে নদী ডাকে বৃক্ষ ডাকে যাকে
কোন মানুষের অবহেলায় হারাই দূর্বিপাকে!

বলছ সবাই কেউ নেই যার কিচ্ছুটি নেই কাছে
মানুষ ছাড়াও বুকের ভিতর ইষ্টিকুটুম আছে।

লেখক:
Mahbuba Khan Dipanwita
মাহবুবা খান দীপান্বিতা, কবি, ছড়াকার, গল্পকার

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট