আমি যখন নিতান্ত শিশু, আট নয় বছর বয়স হবে, তখন বাবার সঙ্গে বসে মানচিত্র দেখতে খুব ভালো লাগতো। আমাদের বাড়িতে একটি গ্লোব ছিল। বেশ বড়। আমার পড়ার টেবিলে থাকতো। এখনও দোকানে গ্লোব পাওয়া যায় কিনা জানি না। আরও ছিল অক্সফোর্ড অ্যাটলাস।
সন্ধ্যার সময় বাবা যখন ফ্রি থাকতেন আমার সঙ্গে বসে ওয়ার্লড ম্যাপ দেখতেন। আমাকে দেখাতেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ কোনটি। দেখতাম ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিশাল একটি দেশ। বাবা বলতেন এটা হলো কমিউনিস্ট দেশ। তারপর দেখাতেন চীনের মানচিত্র। বলতেন এটাও কমিউনিস্ট দেশ। এটাও বিশাল একটি দেশ। দেখাতেন পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ। এগুলোও সমাজতান্ত্রিক দেশ।
আমার কাছে মনে হতো দুনিয়ার বেশ বড় একটি অংশ জুড়েই তো তাহলে সমাজতন্ত্র। বাবা বলতেন একদিন পুরো বিশ্বই সমাজতান্ত্রিক হয়ে যাবে। বলতেন একেবারে নিশ্চিত বিশ্বাসের সঙ্গে।
বাবা ছিলেন শিশুর মতো সরল। শিশু যেমন অনায়াসে বিশ্বাস করে মেঘের উপর পরীরদেশ। কিংবা যেমন জানে সকালে সূর্য উঠবেই। বাবা ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতায় বিশ্বাস করতেন। বাবার কথা শুনে শুনে আমার মনে হতে থাকতো কমিউনিজমের চেয়ে সেরা আর কিছু নেই।
তখন পড়তাম ‘স্ফুলিংগ থেকে অগ্নিশিখা’, ‘রুশ ইতিহাসের কথা কাহিনী’। গল্প শুনতাম ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব, ১৯৪৯ সালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের। লেনিন ছিলেন বিপ্লবের মহানায়ক। মাও সেতুং, চৌএনলাই, চে, স্ট্যালিন, ক্রপস্কায়া, ফিডেল ক্যাস্ট্রো, মার্কস, অ্যাঙ্গেলস, ক্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভ কঠিন কঠিন সব নাম। কিন্তু একদম যেন ঘরের মানুষ এরা।
একটু বড় হয়ে পড়লাম কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির ইস্পাত, আর্কাদি গাইদারের ইশকুল, তিমুর ও তার দলবল, ম্যাক্সিম গোর্কির আত্মজীবনী, মা, হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পার্টাকাস। আরও কতশত বই।
বাড়িতে সোভিয়েত বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। উদয়ন, সোভিয়েত নারী, সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্পুটনিক, এসটিপি(সোশালিজম থিয়োরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস) পত্রিকাগুলো আসতো নিয়মিত। সেখানে গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস পড়তাম। সোভিয়েত নারী পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম, চিঠি দিতাম। ছাপাও হতো সেসব। সোভিয়েত কালচারাল সেন্টারে যেতাম সিনেমা দেখতে। সোভিয়েত নারী পত্রিকার সম্পাদিকা নিনা বালিয়াসনিকভার সই করা চিঠিও পেয়েছি বেশ কয়েকবার।
আমার কোনো রকম সন্দেহ ছিল না যে এই তো, আর ক’দিন পরেই মহাবিপ্লব হবে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। রূপকথার রাজপুত্র নয়, স্বপ্ন ছিল লেনিনকে ঘিরে। কবিতাও লিখেছি তাকে নিয়ে, অনেকগুলো। আমাদের বাপ-বেটির কথা শুনে মা হাসতেন। বলতেন ‘ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে।’
হ্যা, মগজ ধোলাই বোধহয় একেই বলে। মগজে একেবারে ছাপ পড়ে গিয়েছিলো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস। আজও বোধহয় সেই ছাপ মুছে যায়নি, বাস্তবের কষাঘাত সত্ত্বেও।
১৯৮৫ সালে আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি। মিখাইল গর্বাচেভের ছবি দেখলাম সোভিয়েত ইউনিয়নে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান এবং নতুন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট। চেহারাটা মন্দ নয়। বেশ ভালো মানুষের মতো । ব্রেজনেভ সাহেবের চেহারা বরং অনেক শক্তপোক্ত ছিল।
এরপর পরই আস্তে আস্তে শুনতে লাগলাম, পড়তে লাগলাম সংস্কারের কথা। সোভিয়েত নারীতে দেখতাম রাইসা গর্বাচেভের ছবি। তিনি ফার্স্ট লেডি। বেশ সুন্দরী, স্টাইলিশ। সোভিয়েত নারীর গেটআপ আর বিষয়বস্তুও একটু একটু করে বদলাচ্ছিল। সাজসজ্জার বিভাগ বাড়ছিল। এরপর ‘রাশিচক্র’ ছাপা শুরু হলো। মা সেটা দেখে বললেন, ‘সোভিয়েত নারীতে ভাগ্য আর রাশিচক্র? ওদের দেখি বারোটা বাজার দেরি নেই।’ বড় খাঁটি ভবিষ্যৎবাণী।
এদিকে গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোইকার কথা পড়তে পড়তে বাবার মুখ কেমন যেন আঁধার হচ্ছিল। বারে বারে বলতেন এটা ঠিক হচ্ছে না। বললেন, খোলা দুয়ার নয়, দরকার পার্টিতে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা, দরকার জনগণের সঙ্গে যথার্থ ভাগাভাগি, দরকার জনগণের সঙ্গে একাত্ম হওয়া।
স্ট্যালিনের লেখা ‘প্রবলেমস অব লেনিনিজম’ বইটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখ কি লিখেছে। স্ট্যালিন বলছেন যখন পার্টির পা আর মাটিতে থাকবে না, যখন পার্টির নেতারা নিজেদের স্বার্থে মগ্ন হবেন, যখন তারা জনগণের নয়, কেবল পার্টির শাসন কায়েম রাখতে ব্যস্ত হবেন, তখন পার্টির স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষোভ করবে।’ কমিউনিস্ট পার্টিকে হতে হবে জনগণেরই পার্টি। হতে হবে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থের ধারক।
সংশোধনবাদের ধারার যে সূচনা ক্রুশ্চেভ করেছিলেন তারই বিষময় ফল কি গর্বাচেভের আবির্ভাব? কেন একটা দেশ মোমের মতো গলে গেল? বাবা অবশ্য এরপরও কমিউনিজমের উপর বিশ্বাস হারাননি। তিনি বলতেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ভুল করতে পারে, কিন্তু সমাজতন্ত্র তো তাই বলে ভুল নয়।
নব্বইয়ের ঘটনা বিশ্লেষণে তিনি আরও বেশি করে মগ্ন হয়েছিলেন তাত্ত্বিক পড়াশোনায়। গর্বাচেভকে আমার কাছে মনে হয়েছিল হয় প্রচণ্ড বেকুব নয়তো বিশ্বাসঘাতক।
পরে গ্রিক মিথোলজিতে আমি তার একটি জুড়ি খুঁজে পাই। হেলিওস ছিলেন সূর্যদেবতা। তার সন্তান ছিলেন ফেইথন। ফেইথন উচ্চাকাংখী তরুণ। তিনি বাবার রথচালনা করার আবদার করেন। স্নেহবশীভূত হেলিওস ফেইথনকে তার সাত ঘোড়ায় টানা আগুনের রথ চালানোর দায়িত্ব দেন শুধু একদিনের জন্য। ফেইথন রথ চালানো শুরু করলেন বটে কিন্তু তার হাতে সূর্য দেবতার মতো জোর কোথায়। রাশ আলগা করতেই ঘোড়াগুলো ছুটে চললো বেপরোয়া গতিতে। চলে এলো পৃথিবীর খুব কাছাকাছি। আগুন ধরে যেতে লাগলো পৃথিবীতে। আগুনে ঘোড়ার রাশ সামলানোর ক্ষমতা ফেইথনের মোটেই ছিল না। অবশেষে পৃথিবীকে বাঁচাতে জিউস বজ্র ছুঁড়ে ফেইথনকে হত্যা করেন। সূর্যদেবতা আবার তার রথের নিয়ন্ত্রণ নেন শক্ত হাতে।
হায়, মিখাইল গর্বাচেভের কোন যোগ্যতা ছিল না যে গ্লাসনস্তের আর পেরোস্ত্রেইকার খোলা হাওয়া তিনি সূচনা করেছিলেন তাকে নিয়ন্ত্রণের। দরকার ছিল ভিতর থেকে পার্টির ভিতরে জমে থাকা জঞ্জাল আর আমলাতন্ত্রকে পরিস্কার করার। দুর্নীতিকে দূর করার। কিন্তু তিনি মাথা ব্যথা সারাতে গিয়ে মাথাটাকেই কেটে ফেললেন।
দরজা জানালা সব এমনভাবে খুলে দিলেন যে পুঁজিতন্ত্র হুড়মুড় করে ঢুকে ঘরটাকেই ভেঙে ফেললো। তিনি ডিপরুটেড এজেন্ট ছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের ফলে দুনিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য যে নষ্ট হয়েছিল সে কথা ঠিক।
গর্বাচেভের মৃত্যু অনেক কথা মনে পড়িয়ে দিলো। শোক জানাই। হয়তো ভাঙনটা অনিবার্যই ছিল। হয়তো ফিনিক্স পাখির নতুন জন্মের আগে মৃত্যুর মতোই সেটা ছিল অনিবার্য।
সাম্যবাদের মহান আদর্শর সাময়িক পরাজয়ও হয়েছিল।
তবে আমিও বাবার মতোই। এখনও বিশ্বাস করি সাম্যবাদের চেয়ে মহত্তম স্বপ্ন মানব জাতি আর কখনও দেখেনি। আর এই স্বপ্ন একদিন বাস্তবে রূপ নেবেই।
লেখক:
শান্তা মারিয়া, সাংবাদিক, মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র মুহম্মদ তকীউল্লাহর কন্যা