মিরপুর মুক্ত হলো

Comments

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের কূটচালের শিকার হয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে বিহার, উত্তর প্রদেশ, গুজরাটের উর্দুভাষী মানুষের একটি বৃহৎ অংশ পাকিস্তানের অংশ পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নেয়।

অবাঙালী এইসব মুসলমানদের জন্য ঢাকার মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরের আবাসিক এলাকা বরাদ্দ করা হয়। এদের মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকতো উর্দুভাষীদের শিক্ষিত, বড় ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবী শ্রেণী। অন্য দিকে মিরপুরে বসবাস করতো উর্দুভাষীদের মধ্যে যারা শ্রমিক বা নিম্ন আয় শ্রেণীর।

ঢাকার মিরপুর এবং মোহাম্মদপুর ছাড়াও দেশের আরো কয়েকটি জায়গায় উর্দুভাষী জনগণের বসবাস ছিল। এর মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরদি, সৈয়দপুর, খুলনার খালিশপুর, চট্টগ্রামের হালিশহর ও পাহাড়তলি।

পূর্ববঙ্গে আগত এইসব মানুষ এ অঞ্চলে ‘বিহারী’ নামেই পরিচিত হয়। এদের মাঝে ব্যতিক্রমী কিছু বাদে প্রায় সকলেই মনস্তাত্বিকভাবে পাকিস্তানকেই তাদের দেশ মনে করে। ফলে মুক্তি সংগ্রাম ও  মুক্তিযুদ্ধ কালে এই উর্দুভাষী বিহারী মুসলমানরা বিনা দ্বিধায় পাকিস্তানকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের অনেক যুবক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর ও ঈশ্বরদিতে পাক কর্তৃপক্ষ এদের মধ্যে প্রচুর অস্ত্র বিতরণ করে।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী বাহিনী যখন পিছু হটছিল তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী বিহারীরা মিরপুর এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় আশ্রয় নেয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করলেও বিহারীদের নিয়ে গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স আত্মসমর্পণ না করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিরপুরে আশ্রয় নিয়ে বিহারীদের শক্ত ঘাটি গড়ে তোলে। পাকিস্তানী বাহিনীর দলছুট কিছু সৈনিক ও রাজাকাররাও এদের সাথে যোগ দেয়। বিজয়ের পরেও মিরপুর অঞ্চলে ইয়ারা হত্যাযজ্ঞ অব্যহত রাখে।

এ অবস্থায় দেশের মানুষ বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হলেও ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে মিরপুর তখনো ‘স্বাধীন’ হয়নি। এ যেন স্বাধীন বাংলাদেশে ‘এক টুকরো পাকিস্তান’। এ অবস্থা সদ্য স্বাধীন দেশের নিরাপত্তা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী মিরপুরের অচলাবস্থা কাটাতে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল, চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল ও নবম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে মিরপুরের অচলাবস্থা নিরসনের দায়িত্ব দেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ জানুয়ারী বিকেলে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং পুলিশ সদস্যরা মিরপুর টেকনিক্যালের কাছে অবস্থান নেয়।

ভারতীয় বিহার রেজিমেন্টের সৈনিকদের সাথে বিহারীদের ভাষা ও সংস্কৃতিগত মিলের কারণে সে সময়ে ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্ট। মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে ভারতীয় বাহিনীর ১০০০ সৈন্য ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং মিরপুরের যেসব জায়গায় ভারতীয় সৈন্যরা ছিল সেসব জায়গা পরিদর্শন করে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সদস্যরা। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অনুরোধে ভারতীর সৈন্যরা সেখান থেকে সরে আসেন। তখন মিরপুরের দায়িত্ব নেয় দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট।

৩০ জানুয়ারী সকাল সাতটায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নেয়। পুলিশ এবং সেনা সদস্যরা মিরপুর ১২ নম্বর পানির ট্যাংক এলাকায় অবস্থান নেয়। সে অভিযানে অংশ নেয় দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮৬ জন সৈন্য এবং ৬৩ জন পুলিশ সদস্য।

বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের দুইদিন আগে স্বনামখ্যাত সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়সারকে ঢাকার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। তাঁর ভাই চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ধারণা ছিল শহিদুল্লাহ কায়সারের খোঁজ হয়তো মিরপুরে পাওয়া যাবে। সে কারণে জহির রায়হান মিরপুরে যেতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শরণাপন্ন হন এবং ৩০ জানুয়ারী সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আরো তিনজন সহযোগী নিয়ে জহির রায়হান সেখানে উপস্থিত হন। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের তরফ থেকে শুধু জহির রায়হানকে তাদের সাথে নিতে সম্মত হয়। বাকিদের ফেরত পাঠানো হয়। ঢাকার পুলিশ সুপার জিয়াউল হক লোদির গাড়িতে জহির রায়হানকে চড়তে বলা হয়।

অভিযানের শুরুতে পুলিশ মাইকিং করে বলে, ‘যাদের কাছে অস্ত্র আছে জমা দাও’।

এসব এলাকা নিরস্ত্র করার জন্য অভিযান হতে পারে, এমন আশংকায় সেখানকার প্রতিটি ঘরের দেয়ালে ছিদ্র করে অস্ত্র তাক করে রাখে বিহারীরা এবং বেলা এগারোটার দিকে আকস্মিকভাবে একযোগে বিহারীদের বাড়ি থেকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপর গুলি চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় সেনা এবং পুলিশ সদস্যরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের যোগাযোগের জন্য ওয়্যারল্যাস সিস্টেম ধ্বংস করে ফেলে বিহারীরা।

১১টার দিকে বিহারীদের গুলিতে পুলিশ সুপার জিয়াউল হক লোদি নিহত হন। ধারণা করা হয় এসময় গাড়ীতে থাকা জহির রায়হানও নিহত হন। অনেকেই মিরপুর ১২ নম্বর পানির ট্যাংকের কাছে জহির রায়হানের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন।

পুলিশ ও সেনা সদস্যদের অগ্রগামী দলের বেশিরভাগ সদস্য এ অতর্কিত হামলায় হতাহত হলেন। সেনা এবং পুলিশ সদস্যদের উপর বিহারীরা এমনভাবে চড়াও হয়েছিল যে পরিস্থিতি মোকাবেলা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

সন্ধ্যার পরে শক্তি বৃদ্ধি সেনাবাহিনী করে এবং এসময় তারা মর্টার ও আর্টিলারি ব্যবহার করে। ৩০ জানুয়ারী বেলা এগারোটা থেকে শুরু করে ৩১ জানুয়ারী সকাল ১০টা পর্যন্ত একটানা গোলাগুলি চলতে থাকে।

তীব্র যুদ্ধের পর ৩১ জানুয়ারী সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আত্মসমর্পণ করে বিহারীরা। সেদিন মিরপুর থেকে ১১ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

বিহারীদের সাথে সেই যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট সেলিম মো. কামরুল হাসানসহ ৪১জন সেনা সদস্য, পুলিশ সুপার জিয়াউল হক লোদিসহ ৫৩ জন পুলিশ সদস্য এবং পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতাকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করা তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাতা জহির রায়হান শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে তিন-চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জহির রায়হানসহ বাকি কারো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। ৩০ জানুয়ারী রাতেই সম্ভবত বিহারীরা মৃতদেহগুলো সরিয়ে ফেলে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৪৫ দিন পরে ঢাকার উপকণ্ঠে মিরপুর ‘শত্রু মুক্ত’ হয়েছিল তীব্র এক যুদ্ধ ও শত শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে।

বাঙালীয়ানা/এসএল

অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলো, পড়ুন

ডিসেম্বর ১৯৭১

নভেম্বর ১৯৭১

অক্টোবর ১৯৭১

সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আগস্ট ১৯৭১

জুলাই ১৯৭১

জুন ১৯৭১

মে ১৯৭১

এপ্রিল ১৯৭১

মার্চ ১৯৭১

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.