মিরাজুল ইসলামের কবিতা

Comments

শ্রুতি

যখনই কোমল গান্ধার সুরে
কাঁপা ঠোঁটের শব্দরেণু
বাতাসে হারিয়ে যায়,
তনুশ্রী বেতারে –
নব ঘুরিয়ে ততবার খুঁজে ফিরি
প্রিয় সংগোপন তরঙ্গ।

শব্দহীন, নিঃসীম আনন্দতটে
এরপর শুধু ভেসে যাওয়া।

শেষ জুনের আকাশটা সেদিন এমন ছিল
ছবি আর কবিতায় মাখামাখি।

নোনা বাতাসে আমিষের ঘ্রাণে
নীলাভ রোদ্দুরে শিস দেয় গাংচিল,
ফসফরাস বুদ্বুদ ঢেউয়ের তোড়ে
মাথার উপর মেঘগুলো এতোদিন ঝুলে ছিল,
বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়।

হাঁড়িমুখ

দুনিয়ার তামাশা দেখি,
মুখ হাঁড়ি করে নয়, হাসি মুখে।
বহু আগে 
আমার পূর্ব পুরুষগণ
এক বিলাতবাসী ভদ্রলোকের পাল্লায় পড়েছিলেন
লর্ড ক্লাইভ যার নাম।
ক্রিকেট খেলার আমন্ত্রণে বালক সিরাজ
সরাসরি বোল্ড আউট হয়েছিলেন 
ওভারের প্রথম বলে।
সেই থেকে ক্রিকেট আমাদেরও প্রিয় খেলা।
এখন বাংলার ঘরে ঘরে ক্লাইভ সাহেবরা কিলবিল করেন।
ভানুর ভাষায়, 
‘পৃথিবীতে গ্রাম আছে তো মাত্র দুটো। 
একটা শ্রীখণ্ড, আরেকটা সাগর পাড়ের ইংলণ্ড’।
সেই সুদুর গ্রামে বসে কারা যেন 
ক্লাইভ সাহেবের চামড়া গায়ে
আমাদের ভুজুং ভাজং করে মাতিয়ে দিয়ে যান। 
সাথে থাকেন 
লোকাল রায় বল্লভ, উমি চাঁদ ঘরানার মুদ্রা বেশ্যারা।
তারপরও যত দোষ মীর জাফরের।
এরপর যতবার তেতো মুখে 
দুনিয়ার হাটে আজিব তামাশা দেখি
গালিব স্বপ্নে এসে বলে যান,
মুখ হাঁড়ি করে মদ খাওয়া 
আমাদের মানায় না।

বিমূর্ত স্বদেশ

হাওরে নোঙর ফেলে সাগরের স্বাদে 
পোতাশ্রয় ভেবে কালো জলে লাফালাফি। 
নদীর দুই আঁজলা মুঠোয় নিয়ে 
ছোটো পোনার ছোটাছুটি। 
কবে এক মহাষষ্ঠীর ঢোল উৎসবে
ভুল করে প্রসাদ খেয়ে কুলুকুচি করেছিল 
শেখের ছোটো মেয়ে। 
সে এখন রঙিন হিজাবে নিজেকে আবৃত রাখে,
আড়চোখে দেখে নগর বালিকাদের নাচানাচি।
যুবক বয়সে আধখোলা ঘুম চোখে 
প্রেমিকার স্তনে ঠোঁট দিতো যে প্রেমিক শিশু
এখন সে পাক্কা নামাজী। 
গ্রাম এখন শহরে যায় না, 
শহর জুড়ে মেঘ।
শহর এখন গ্রামে যায় না, 
গ্রাম জুড়ে ভ্যান গাড়ী। 
চোখের পর্দা ভেদ করে মাছরাঙা ডুব দেয়,
ঠোঁটে তার মাছের স্বপন। 
মনে পড়ে না কি তার পালকের রং
লাল, বেগুণী নাকি সবুজ বরণ!

ক্ষয়

ভালোবাসা ক্ষয় হয় 
ক্ষতের প্রলেপ না শুকানোর জন্য
একটু একটু করে।
ধৈর্যের বাঁধন ভেঙে গেলে
কেবল মনকে পোড়ায় না,
শরীরও দগ্ধ হয়।
যে রুমের আসবাবগুলো ছিল শুধু নিজেদের
তা এক কঠিন বাংলা শব্দের মতো
ক্লেদাক্ত হয়ে গেলে,
দেখতে বিচ্ছিন্ন-বিচ্ছিরি লাগে।
প্রবল বর্ষণেও বিছানা বালিশ  
খাঁ খাঁ করে,
এক সময় যা ছিল 
দেহ বিনিময়ের দহলিজ ও দরগা।

বিম্ববতী

ফর্সা কপালে ভাঁজ এঁকে তুমি কাঁদলে,
গোলাপী অধরে কম্পন ঠেকানোর 
কোন চেষ্টা তুমি করলে না।
অনর্গল বলতে থাকলে ফেলে আসা 
দীর্ঘশ্বাসের দিন রাত্রি।
আমি চোখের সামনে 
চুপসে যাওয়া এক লাল আঙুর ফল দেখি।
যার গোপনে ছড়াচ্ছে মিষ্টি লোবানের ঘ্রাণ।

বুদ্ধা সাক্ষী

ঘুমন্ত আকুতিমাখা চেহারায় 
ক্ষণিকের বিস্মরণ দেখে
শিয়রে ঝোলানো সিদ্ধার্থ হাসিমুখে বুঝে নেন,
কুণ্ডলিত জ্যোৎস্না প্লাবনে
অদৃশ্য আলোর নাচনে
হৃদছবি জমা হয় মোবাইল স্ক্রিনের ডালিতে

করোনা-স্মৃতি

কি আছে চট্টগ্রামে?
কতদিন দেখি না আমার শহরকে। 
কি নেই চট্টগ্রামে?
কতদিন পাই না জন্মস্থানকে।

নগরের এ’মাথা থেকে সে’মাথা আঁকাবাঁকা ফ্লাইওভার,
আমাকে টানে না সেভাবে। 
নতুন আলোমাখা ছাদমাথার রেডিসন হোটেল?
বারান্দা থেকে দুই পাহাড়ের মাঝে দেখি।
কিন্তু আঁচড় কাটে না চোখে। 
বরং পাহাড়ের ঢালে লাল দালানের
কোর্ট বিল্ডিং অনেক বেশি ছবির মতো মনে হয়। 

এখানে সেখানে বিশাল শিলকড়ই আর বটগাছগুলো 
এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়ায় বসে ঝিমায়
রিক্সাওয়ালা, পথের ফকির, না হয় নতুন কোন প্রেমিক।
নিউমার্কেটের সিঁড়িওয়ালা এস্কেলেটর প্রায় বন্ধ থাকে,
আমার শৈশব যেন সেই একতলা-দোতলায় 
স্থির হয়ে আছে। বয়স বাড়ে নি তার। 
যেদিন থেকে ফয়’স লেক কৃত্রিম সাজে সাজলো,
এরপর থেকে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। 
কি ভাবে ভুলি?
চল্লিশ বছর আগে বিনা টিকিটে ঐ পাহাড়ের ঢালে 
ডোরাকাটা আঁশের টাকি মাছ ধরতাম আঁজলা ভরে।

কিছু কিছু এলাকায় যাওয়া বারণ ছিল আমাদের।
সেখানে গুণ্ডা নামের কিছু মানুষ 
কোমরে ড্যাগার নিয়ে ঘুরে! আমি দেখিনি কখনো। 
তবে এক নাম জানা গুণ্ডা মামা
আমাদের দুই বন্ধুকে লম্বা লাইন থেকে রেহাই দিতে 
কিনে দিয়েছিলেন দুষ্প্রাপ্য টিকিট, নূপুর সিনেমা হলে। 
কেমন করে তাকে আর ‘মন্টু গুণ্ডা’ বলি? 

কর্ণফুলী’তে দেখেছি 
জেলে নৌকাগুলোর পাশে রংচটা জাহাজের শরীর।
পতেঙ্গা সৈকত খাঁড়িতে অবসরে গুনেছি
বড়ো জাহাজের পাশে কালো সাম্পানের সারি।
এ’ যেন চট্টগ্রামের সারাংশ। 
কত কিছু ছিল আমার চট্টগ্রামে?
কতকিছু বদলে গেল।
তারপরও কতদিন পাই না তাকে। 

দেখি না চেনা রেল লাইন, 
বিরানী হাউস, আড্ডার ঘাটে নতুন চেহারা,
ব্যস্ত সড়ক পাশে পূর্বপুরুষের কবরস্থান!
আমার ঘুম ভাঙা চট্টগ্রাম।

নস্টালজিয়া

আকাশ ডাকে 
মৌন ভুবন চিল।
আমি তুমি
বেদনায় বর্ণহীন।

আকাশ শোনে
ভুবন চিলের শিস।
আমরা শুনি
যখন বৃষ্টিটা উষ্ণীষ।

লেখক:
Mirajul Islam 2
মিরাজুল ইসলাম, কবি

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট