কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা সাহিত্যে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, যতটা আলোচিত, যতটা সমালোচিত বা যতটা সম্মানিত তার সবটাই তাঁর রচনার শিল্পমান ও অভিনবত্বের কারণে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ধর্মান্ধতাই বাঙালীর অধঃপতনের কারণ। আর তাই তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের অন্ধকারকে বার বার আঘাত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
তাঁর জন্ম ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট, চট্টগ্রামের ষোলশহরে সৈয়দ (ডেপুটি) বাড়িতে। পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। এ কারণে পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পিতার কর্মস্থলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত হয়। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনকে নানাভাবে তাঁর দেখার সুযোগ ঘটে, যা তাঁর উপন্যাস ও নাটকের চরিত্র-নির্মাণ ও জীবন-অন্বেষণে প্রভূত সাহায্য করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র মা নাসিম আরা খাতুন উচ্চশিক্ষিত, রুচিশীল পরিবার ও বনেদি বংশের নারী ছিলেন। যদিও ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সে তিনি মারা যান, তবুও পরিবারের অন্যদের ধারণা, মায়ের প্রভাব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের মধ্যে ছিলো। তাঁর সাহিত্যিক প্রেরণার মানস গঠন হয়েছিল মায়ের ভিতর দিয়ে।
পিতার চাকরিসূত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন। তিনি কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৩৯), ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই.এ (১৯৪১) এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ডিস্টিংকশনসহ বি.এ (১৯৪৩) পাস করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়এ অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত তা শেষ করেন নি।
ফেনী হাইস্কুলে ছাত্র থাকাকালেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয়। এ সময় তিনি হাতে লেখা পত্রিকা ভোরের আলো সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল। তিনি কনটেম্পোরারি নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৪৫-৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার দৈনিক স্টেটস্ম্যান পত্রিকার সাব-এডিটর ছিলেন। সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, পরিচয়, অরণি, পূর্বাশা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতো।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্য চালান এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে ফরাসি একাডেমির সদস্য পিয়ের এমানুয়েল, আঁন্দ্রে মারলো প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ফরাসি নাগরিক অ্যান মেরির সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন (১৯৫৫)। মিসেস মেরি ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস লালসালু (১৯৪৮) ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন। পরে এটি Tree Without Roots (১৯৬৭) নামে ইংরেজিতেও অনূদিত হয়।
বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক আলোড়নে যখন নানাভাবে আলোড়িত, তখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলার গ্রাম ও সমাজ-জীবনের এক ধ্রুপদী জীবনধারাকে লালসালু উপন্যাসে রূপদান করেন। ধর্মের নামে ভণ্ডামি বা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে তিনি তুলে এনেছেন চরিত্রের মাধ্যমে আবার বিপরীত চরিত্রও তৈরি করেছেন কুসংস্কার থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে। লালসালু উপন্যাসে এমন কুসংস্কারের প্রতীক মজিদ, আর কুসংস্কার বিশ্বাসী রহিমা। কিন্তু জমিলা এসেই যেনো এই কুসংস্কার বা মজিদের ভণ্ডামির পায়ে আঘাত করল। তেমনিভাবে বহিপীর নাটকে বহিপীর মজিদেরই প্রতিচ্ছবি আর জমিলার প্রতিবাদী রূপ তাহেরা। যেখানে জমিলার মধ্যে আমরা নীরব চরিত্রের সাক্ষাৎ পাই, সেখানে তাহেরা প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে নারী জাগরণ তথা নতুনের আভাস দেয়। বিংশ শতকের নারী জাগরণের প্রতীক তাহেরা যার মাধ্যমে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আধুনিকের আহ্বান আর কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছেন। এসব চরিত্রকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তাঁর প্রতিটি চরিত্রই যেনো সমাজ, দেশ ও কালকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রকৃতিই যেনো তাঁর চরিত্র আর তাই তা জীবন্ত ও বাস্তব। যতোদিন যাবে সমাজ থেকে তৈরি তাঁর জীবন্ত চরিত্রগুলো আরও বাস্তব হবে এবং বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আরও বেশি আলোচিত হবে।
তাঁর অন্য দুটি উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) ও কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮) বাংলা সাহিত্যে দুটি ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি। তিনি এ দুটি উপন্যাসে ‘চেতনাপ্রবাহ রীতি’ ও ‘অস্তিত্ববাদ’-এর ধারণাকে অসাধারণ রূপক ও শিল্পকুশলতায় মূর্ত করে তুলেছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গভীর রাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু বাংলাদেশ তথা বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর ছাত্রজীবনের বন্ধু পরবর্তীতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, আবু সাঈদ চৌধুরী সৈয়দের মৃত্যুর সাত মাস পরে তাঁর স্ত্রীকে একটা আধা সরকারি সান্ত্বনাবার্তা পাঠিয়েছিলেন।
তাতে লেখা ছিলো, “আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মি. ওয়ালীউল্লাহর মাপের প্রতিভার সেবা গ্রহণ থেকে এক মুক্ত বাংলাদেশ বঞ্চিত হলো; আমাকে এটুকু বলার সুযোগ দিন যে আপনার ব্যক্তিগত ক্ষতি বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতি।”
এখনও ধর্মান্ধতা আর উগ্রতার আস্ফালন দেখে ভীত বাঙালী একজন ওয়ালীউল্লাহ’র তীব্র অভাব বোধ করে।
সূত্র: কুসংস্কারবিরোধী লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ- নীল রফিক; বাংলাপিডিয়া
বাঙালীয়ানা/এজে