মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা কাঁপানো বীর সাদেক হোসেন খোকা চলে গেলেন

Comments
মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকার সাবেক মেয়র, ক্রীড়া সংগঠক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা মৃত্যুবরণ করেছেন। সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৯, নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় ভোররাত ২টা ৫০ মিনিটে অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।  মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

কিডনির ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের ১৪ মে সপরিবারে নিউইয়র্ক যান খোকা। তখন থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিউইয়র্কেই বাস করছিলেন তিনি। 

উল্লেখ্য, পারিবারিকসূত্রে জানা যায় যে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হবে এবং তাকে ঢাকার জুরাইনে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন সম্পন্ন হবে।

১৯৫২ সালের ১২ মে সাদেক হোসেন খোকা জন্মগ্রহণ করেন মুন্সীগঞ্জের সৈয়দপুরে। পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকার গোপীবাগে বেড়ে ওঠেন। তার বাবা প্রকোশলী এম এ করীম।

গোপীবাগ রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল, কলতাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়দেবপুর রানী বিলাস মনি উচ্চ বালক বিদ্যালয়, জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে অনার্স ডিগ্রী লাভ করেন।

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র সাদেক হোসেন খোকা। এরপর ছাত্রাবস্থায় ১৯৭১ এর গণহত্যা শুরু হলে তিনি চলে যান ভারতের ত্রিপুরায়। সেখানে ট্রেনিং সম্পন্ন করে তিনি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মেজর এটিএম হায়দারের নেতৃত্বে তিনি কুমিল্লার সালদা নদীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। সেই রাতে সেই দুঃসাহসিক অপারেশনে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকায় যে ক’টি গেরিলাদল তৎপর ছিল তাদের মধ্যে সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে ছিল একটি দল। খোকার ওই গেরিলা দলে আগরতলা থেকে ট্র্রেনিং নিয়ে আসা যোদ্ধা ছিলেন ৪০ জন। ঢাকায় এসে আরও ২০-২৫ জনকে রিক্রুট করা হয়েছিল। প্রথমে সাদেক হোসেন খোকা তার নেতৃত্বাধীন ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ২০ জন করে দুটি সাব-কমান্ডে ভাগ করেন। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব পান আজম খান, অপরটির নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ শামসুল হুদা। তার নেতৃত্বে ঢাকার ‘প্রাদেশিক নির্বাচন কার্যালয় অপারেশন’, ‘ডিএফপি অপারেশন’, ‘ডেমরা অপারেশন’সহ বেশ কয়েকটি সফল গেরিলা হামলায় পাকিস্থানিবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে ১৯৭২-৭৩ সালে তিনি যুক্ত হন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সঙ্গে। সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্লাবটি ফুটবল ক্লাবে রূপান্তরিত হয় এসময়েই। তার নেতৃত্বেই ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব দেশের প্রথম সারিরি ক্লাবে পরিণত হয়। সাদেক হোসেন খোকা ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন এই ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবেই।

১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তি রাজনীতিতে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন এবং বিএনপির ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মত সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তার দল সরকার গঠন করলে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০০১ সালে তার দল সরকার গঠন করলে তিনি মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯০ সালে ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙার পর পুরান ঢাকায় হিন্দুদের উপর যখন হামলার চেষ্টা হয়েছিল সাদেক হোসেন খোকা শাঁখারী বাজার, স্বামীবাগে অবস্থান করে সে হামলা প্রতিহত করে সূত্রাপুর কোতোয়ালী এলাকার অমুসলিম জনগোষ্ঠীর অকুন্ঠ ভালবাসা আদায় করে নেন। যার ফলে পরের বছর এই এলাকা থেকে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পরাজিত করেন। 

২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল নির্বাচিত হয়ে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাদেক হোসেন খোকা। ঢাকার মেয়র থাকা কালে তিনি বিভিন্ন সড়ক ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও বরণ্যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের নামে নামকরণ করে সকলের প্রশংসা অর্জন করেন। আবার মেয়র থাকাকালের ঘটনার জন্যই দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হন তিনি।

তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে পরিচালিত দুটি অপারেশনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

প্রাদেশিক নির্বাচন কার্যালয় অপারেশন:

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ‘প্রাদেশিক নির্বাচন কার্যালয়’ অবস্থিত ছিল ঢাকার শান্তিনগর এলাকার মোমেনবাগের দু’টি ভাড়া করা বাড়িতে। এর মধ্যে একটি বাড়ির মালিক ছিল, আব্দুল মোমেন খান (জিয়া মন্ত্রীসভার খাদ্যমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা ড. আব্দুল মঈন খানের বাবা)।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেসব জাতীয় সংসদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তাঞ্চলে চলে গেছিলেন, একাত্তরের অক্টোবর-নভেম্বরে তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করে সেগুলোয় উপ-নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল কমিশনে।

সেই সাজানো অনৈতিক, অবৈধ নির্বাচন রুখতে ঢাকার প্রাদেশিক নির্বাচন কার্যালয়ে রোজাকালীন সময়ে ১ নভেম্বর, ১৯৭১, সোমবারের সেই অপারেশনে সাদেক হোসেন খোকা’র নেতৃত্বে গেরিলা দলে ছিলেন, ইকবাল আহমেদ সুফি, আমসল লস্কর, হেদায়েতুল্লাহ খোকন, জিন্নাহ ও রফিকুল হক নান্টু ।

1971_Election Office

বিধ্বস্ত প্রাদেশিক নির্বাচন কার্যালয়। ছবি: গেরিলা ১৯৭১

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জোরালো উপস্থিতির মাঝে এই অপারেশন সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করেছিলেন নির্বাচন অফিসের বাঙালি কর্মকর্তা আবুল কাশেম। তিনি সাদেক হোসেন খোকাকে আত্মীয় পরিচয়ে তার অফিসে ৩ দিন রেকি করতে নিয়ে যান ।

রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাটে জন উপস্থিতি অত্যন্ত কম ছিল ফলে প্রবল বৃষ্টি মূলত অপারেশনের সহায়ক হয়েছিল। গেরিলারা তিনজন করে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রাদেশিক নির্বাচন অফিসের দুই ভবনে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। শুরুতেই অস্ত্র দেখিয়ে ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীদের সবাইকে ভবন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ স্থাপনের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণে একটি ভবনের একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণের মুহূর্তে চিলেকোঠায় ঘুমন্ত এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছিল। এই নিরাপত্তারক্ষীর অবস্থানের খবর গেরিলারা আগে জানতে পারেননি।

অভিযান সফল করে দুর্ধর্ষ বীর ৬ যোদ্ধা শান্তিবাগের গুলবাগস্থ ওয়াপদা অফিসের কর্মচারীদের একটি মেসে গিয়ে আত্মগোপন করেন। মেস সদস্যরা  গেরিলাদের রাতযাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এবং খুব ভোরে তাদের নাশতার করিয়ে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ব্যাগের ব্যাবস্থা করে সহযোগিতা করেছিলেন।

ডিএফপি অপারেশন:

যখন ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধ করছেন আর দেশজুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন তখনও পাকিস্তানিরা সিনেমা হলগুলোতে সিনেমা শুরুর আগে ‘চিত্রে পাকিস্তানি খবর’ শিরোনামে তথ্যচিত্র দেখাত। ‘চিত্রে পাকিস্তানি খবর’ তথ্যচিত্রগুলোয় দেখানো হতো দেশের অবস্থা খুবই ভালো। দলে দলে নারী-পুরুষ বাজার-সদাই করে বেড়াচ্ছে। মিথ্যা খবর দিয়ে এই সব তথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব ছিল ডিএফপির। তাই গেরিলারা সিদ্ধান্ত নিলেন ডিএফপি উড়িয়ে দেবেন।

ডিএফপির তখনকার চিফ ক্যামেরাম্যান সাইদুল হক বাবু ছিলেন গেরিলা রফিকুল হক নান্টুর বড় ভাই। ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে নান্টু পুরো অফিস রেকি করে আসেন। ভবনটি সম্পর্কে জানাবার পর কী পরিমাণ বিস্ফোরক দিয়ে তা উড়িয়ে দেওয়া যাবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দেন তাদের সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল সুফির বাবা প্রকৌশলী এস পি আহম্মেদ, যিনি বিভিন্ন সময় গেরিলাদের তার গাড়ি, টাকা ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছেন।

ডিএফপির অপারেশনটি চালানো হয়েছিল পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারে। অপারেশনে যাতে করে নিরীহ কেউ মারা না যায় সে জন্যে দারোয়ান যিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে ডিএফপির ওই ভবনেই থাকতেন, তাকে তার স্ত্রী, শিশুসন্তান, এমনকি তাদের ব্যবহার্য হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেন গেরিলারা।

1971_DFP Operation

গেরিলা হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ডিএফপি। ছবি: এসোসিয়েটেড প্রেস

ডিএফপি অপারেশন দলের নেতা সাদেক হোসেন খোকা, ইকবাল আহমেদ সুফি, আমসল লস্কর জানতেন বিস্ফোরক যত চাপের মধ্যে থাকবে, তার ধ্বংসক্ষমতা তত বাড়বে। সে জন্য টার্গেট করা জায়গায় বিস্ফোরক রেখে দুটি স্টিলের আলমারি দিয়ে চাপা দিয়ে বের হয়ে এলেন তিনজন। বিস্ফোরণটি এত ভয়াবহ হয়েছিল যে, ডিএফপি ভবনের উত্তর দিকের অংশটি উড়ে গিয়েছিল।

অপারেশন শেষে সেই দারোয়ান তার কাছে থাকা ডিএফপির একটি মাইক্রোবাসের চাবি গেরিলাদের দিয়ে দেন এবং সেটি চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা।

এই বিস্ফোরণের খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু প্রচারমাধ্যম বারবার গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছিল খবরটি। পাকিস্তানিদের মিথ্যা প্রচারণার স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় বিশ্ববাসী।

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.