মুক্তিযুদ্ধের খন্ড চিত্র:
গোয়ালন্দ ঘাট ও দক্ষিণবঙ্গের পতন।
২১ এপ্রিল ১৯৭১ । খুব ভোরে গগনবিদারী আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেল। অচেনা এই শব্দটা শুনে প্রথমে ভাবলাম মেঘ ডাকছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম পাকিস্তানী মিলিটারী গোয়ালন্দ আক্রমণ করেছে আর এগুলো কামানের গোলা নিক্ষেপের আওয়াজ। ক্রমশ সেই আওয়াজে পায়ের নিচের মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠছিল। আমি কেনো যাদের অনেক সাহসী বলে জানতাম তারা পর্যন্ত ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন। অজ্ঞাত কারণে আমি নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করতে শুরু করলাম, আমার ভিতরের ভীতু মানুষটি ভয় পাবার বদলে হাতদুটি মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো।
২৫শে মার্চ ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যার পর থেকে আমার প্রয়াত মামা শহীদ বকু চৌধুরীর নেত্রীত্বে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও যশোর সহ দক্ষিণবংগ মুক্ত ছিল। আমি দুইবার সেই প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনা দেখতে গিয়েছিলাম, মামা নিজে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। দুইটি দুই ইঞ্চি মর্টার, গোটা দশেক এল এম জি, একটা এইচ এম জি। আর শ’খানেক মার্কফোর, থ্রি নট থ্রি ও জি থ্রি রাইফেল নিয়ে ইপিআর বাহিনী ও আনসার সদস্য তো আছেনই। নদীপথে পাকিস্তানি আর্মিদের প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট মনে হয়েছিল সেদিন।
কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের স্যাবর জেট ফাইটার এর বোমা বর্ষণ আর চতুর্মুখী আধুনিক অস্ত্রের আক্রমণের কাছে এই প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখা গেলো না, গোয়ালন্দের পতন হলো। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে এগিয়ে আসতে থাকলো হানাদার খুনী পাক বাহিনী। চারিদিকে মৃত্যুর মচ্ছব। নির্বিচারে চলছে নিরিহ মানুষ হত্যা। আমরা শ’তিনেক স্বপরিবারে স্ববান্ধব জানা অজানা মানুষ নিয়ে বাঁশ বাগানের গভীরে আত্নগোপন করে থাকলাম।
হেলিকপ্টার থেকে চলছে মুহুর্মুহু মেশিনগানের গোলাবৃষ্টি, নীচে চীনা রাইফেল ও জি থ্রী রাইফেলের বিরতিহীন গোলাগুলি। বাঁশে লেগে তা আরও ভয়াবহ করে তুলছিল। ঘন গাছের বাগানে এক শুকনো খাদে কয়েক’শ মানুষ, কুকুর, বেড়াল এমন কি শেয়াল, সাপ, বেজী সবাই নিরব। অবোধ শিশুও কান্না ভুলে ছিল সেদিন।
তারপর যখন সবকিছু চুপচাপ, দিনের পরন্ত বিকেলে চিরকালের ভিতু আমি ও আমার সমবয়সী মামাত খালাত ভাইয়েরা বেড়িয়ে এলাম জংগল থেকে। চারদিকে পোড়া গন্ধ আর মৃত্যুর আর্তনাদ।
একজন খবর দিল, অন্যান্য বাড়িতে হত্যাকান্ড তো হয়েছেই সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে চরচাদপুরে, সেখানে তরিপুল্লা বিশ্বাসের বাড়ীর সবাই নিহত। ছুটে চল্লাম। গিয়ে দেখি ৮০ বছরের অচল বৃদ্ধ থেকে ৮ দিনের শিশু, কেউ রক্ষা পায়নি নরপশুদের বন্দুকের গুলি থেকে। মাত্র একজন নড়াচড়া করছে তখনও, মাথার খুলি গেছে উড়ে, শরীরে অনেক গুলির আঘাত। জোয়ান শরীর থেকে প্রাণপাখী ছেড়ে যেতে চাইছে না। আমার ভেতরের আজীবন ভিতু মানুষটি হঠাৎ বদলে গেল। আমি প্রায় মৃত মানুষটিকে উল্টে পাল্টে দেখলাম। বাঁচবার কোনই আশা দেখতে পেলাম না। তার কষ্ট দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। কোমর থেকে ৩২ ক্যালিবারের পিস্তল টেনে বের করে তার থেতলানো মাথায় ঠেকিয়ে তিনবার ট্রিগার টেনে দিলাম। তার আত্মার শান্তি হলো। আমি নবজন্ম লাভ করলাম।
আজ এত বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমাদের ঠান্ডা হয়ে আসা রক্তেও শিহরণ জাগায়। নতুন প্রজন্মের যুবকেরা সেই সময়ের সঠিক ইতিহাস জানলে এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, এটাই আমার বিশ্বাস।
আর এজন্যই আমার এ স্মৃতিচারণ।
——————————–
৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
লেখক পরিচিত:
কাজী নুরুল করিম দিলু, মুক্তিযোদ্ধা, স্থপতি