৬ দফা প্রণয়নে যখন ভীত পাকিস্তানী শাসক আইয়ুব খানের গোয়েন্দা সংস্থা সামরিক বাহিনীর বাঙালী সদস্য ও বাঙালী আমলা ও বেসামরিক বাঙালীর সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে গ্রেফতার করে অসংখ্য বাঙালী সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে। জেল গেট থেকে শেখ মুজিবকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। ৩৫ জনকে আসামী করে শুরু হয় “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও গং” মামলা। এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের সাথে “ভারত” এর যুক্ততা বিশ্বাসযোগ্য করতে অনানুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ার কাছে এই মামলাকে পরিচিত করা হয় “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে। এই মামলার ১৭ নম্বর অভিযুক্ত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক।
জহুরুল হক ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী নোয়াখালী জেলার সুধারামপুর থানার সোনাপুর গ্রামে কাজী মজিবুল হক ও দিলারা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।
জহুরুল হক ১৯৫৩ সালে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫৬ সালে বাণিজ্য শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে তাঁর পোস্টিং হয়। ১৯৬৫-৬৭ সালে তিনি ট্রেনিং ইন্সষ্ট্রাকটার হিসেবে করাচীতে দায়িত্ব পালন করেন।
৫৮/৫৯ সাল থেকেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষুব্ধ বাঙালী অফিসার ও সিপাহী অতি গোপনে সংগঠিত হতে থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাঙালীদের স্বার্থ রক্ষা কখনও সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ লক্ষ্যে অতি গোপনে কাজ করে যেতে থাকেন। লাহোর, করাচী, রাওয়ালপিন্ডি, ঢাকা, চট্টগ্রামে চলতে থাকে কোথাও গোপন বৈঠক, কোথাও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন, কোথাও সশস্ত্র ট্রেনিং। এরই এক পর্যায়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক এই বিদ্রোহী দলে যুক্ত হন এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি তিনি নৌ ও বিমান বাহিনীর বাঙালী সদস্য যারা এই বিদ্রোহ পরিকল্পনার সাথে জড়িত, যাদের স্থল যুদ্ধের তেমন কোন ট্রেনিং নেই তাদের স্থল যুদ্ধের কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।
পড়ুন
পথিকৃৎ মুক্তিযোদ্ধা এবং আগরতলা মামলা
এ বিদ্রোহী দলের প্রধান নেতা পাক নৌ কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ আরো কয়েকজনের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বেশ কিছু বৈঠক করলেন।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানে যখন ব্যাপক গণসর্মথন লাভ করেছে তখন শেখ মুজিবের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে একযোগে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার দখলে নিয়ে অবাঙালী সেনাদের বন্দী করে বাংলাকে স্বাধীন করবার প্রত্যয়ে বলিয়ান বাঙালী সেনা অফিসার ও সেপাহীরা মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়।
ঠিক তখনই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্পোরাল আমীর হোসেন করল বিশ্বাসঘাতকতা, ১৯৬৭ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে গোয়েন্দাদের কাছে ফাঁস করে দিল সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতির কথা।
শুরু হল সরকারের গ্রেফতারী তৎপরতা। আইয়ুব খানের গোয়েন্দাবাহিনী সারা পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার বাঙালীকে গ্রেফতার করল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারী এক প্রেসনোটে ঘোষণা করল যে, সরকার ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। এ ঘোষণায় সিএসপি অফিসারসহ মাত্র ৮ জনের গ্রেফতারের খবর প্রকাশ করল। এতে অভিযোগ করা হল যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল। লাহোর, করাচী, রাওয়ালপিন্ডি, ঢাকা, চট্টগ্রামে হানা দিয়ে গ্রেফতার করল অসংখ্য বাঙালী সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারী নিরাপত্তা আইনে ১৯৬৬ সালের ৯ মে থেকে জেলে আটক শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার করে সরাসরি ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হল। ২২ জানুয়ারী গ্রেফতার হলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। তাকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, পরে ঢাকা সেনানিবাসে আটকে রাখা হল।
শুরু হল আটককৃতদের চরমতম শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন। সাক্ষ্য নেবার সবরকম চেষ্টা করা হল যাতে প্রমাণ করা যায় যে শেখ মুজিব পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল সশস্ত্র বিদ্রোহের। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রথমে কোর্ট মার্শাল করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা ভেবে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও উচ্চপদস্থ বাঙালী সামরিক-বেসামরিক অফিসারদের বেসামরিক আইনে অভিযুক্ত করল।
মামলার বিচারের জন্য ফৌজদারি দন্ডবিধি সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হল। ৩ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি এস এ রহমানকে চেয়ারম্যান এবং এম আর খান ও মুকসুমুল হাকিমকে সদস্য করা হল। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ৩৫ জনকে আসামি করে পাকিস্তান দন্ডবিধির ১২১-ক ধারা এবং ১৩১ ধারায় মামলার শুনানি শুরু হল। মামলায় শেখ মুজিবকে ১ নম্বর আসামী করা হল এবং ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং’ নামে মামলাটি পরিচালিত হল। ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসের সিগন্যাল অফিসার মেসে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম শুরু হল। মোট ১০০টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হল। সরকার পক্ষে মামলায় ১১ জন রাজসাক্ষীসহ মোট ২২৭ জন সাক্ষীর তালিকা আদালতে পেশ করা হল। আইয়ুবের সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে অভিযুক্ত সকলেই অস্বীকার করলেন তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ।
এদিকে সারা বাংলায় আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলন শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানি পুলিশ ও ইপিআর (প্যারা মিলিটারী বাহিনী) হত্যা করেছে আসাদ, মতিউরসহ অনেককে। জনতার দাবি একটাই, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকলের মুক্তি।
ফুঁসে ওঠা বাঙালীর তুমুল আন্দোলনে যখন কাঁপছিল আইয়ুব খানের মসনদ ঠিক সেই সময়ে ১৪ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য আগত বাঙালী কয়েকজন শিশুকে ধরে এনে বন্দী শিবিরের সামনে অমানবিকভাবে প্রহার শুরু করে অবাঙালী সৈনিকেরা। কয়েকজন বন্দী এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে অবাঙালী হাবিলদার মনজুর শাহ বন্দীদের নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে বলে। এসময় ষ্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক শিশুদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে বললে বন্দীশিবির পাহারারত হাবিলদার মনজুর শাহসহ সেন্ট্রিদের সাথে তুমুল বচসা হয়।
ঘটনার পরদিন, ১৫ ফেব্রুয়ারী ভোরবেলা সার্জেন্ট জহুরুল হক নিজের কামরা থেকে বের হলে মনজুর শাহ তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। সার্জেন্টের পেটে গুলি লাগে। সহবন্দি ফজলুল হকও আহত হন। অহেতুক সময় ব্যয়ের পর তাঁদের দুজনকে ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হলেও বিনা চিকিৎসায় জহুরুল হক মারা যান। অত্যাধিক রক্তক্ষরণে সেখানেই রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে আগরতলা মামলার ১৭ নম্বর অভিযুক্ত পথিকৃৎ মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন।
সার্জেন্ট জহুরকে হত্যা করে চলমান আন্দোলনে ঘি ঢালে আইয়ুব খান নিজেই। স্বৈরাচার আইয়ুবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আসাদ, মতিয়ুর, সার্জেন্ট জহুর এবং ১৮ ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার রক্তে রঞ্জিত আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯, মাথা নামিয়ে আইয়ুব খান মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়, বাধ্য হয় অভিযুক্ত বাকি ৩৪ জনসহ সকলকে মুক্তি দিতে।
অনমনীয় ও সৎ সৈনিক জহুরুল হক একজন চিত্রশিল্পী ও খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি কাঠের শিল্পকর্মেও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর কিছু চিত্রকর্ম বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নাম জহুরুল হক হল রাখা হয়েছে।
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা
বাঙালীয়ানা/এসএল
পড়ুন
পথিকৃৎ মুক্তিযোদ্ধা এবং আগরতলা মামলা