কমরেড মণি সিংহ ছিলেন আমাদের উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা, তার অন্যতম স্থপতি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ, তরুণ বিপ্লবীদের কাছে অনুপ্রেরণা ও উজ্জীবনের অনন্ত উৎস। ছিলেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক মতাদর্শে দৃঢ় আস্থাবান একজন খাঁটি কমিউনিস্ট নেতা। তার বিপ্লবী জীবনাদর্শ ও অক্ষয় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মাঝেই তার কালজয়ী পরিচয় লিপিবদ্ধ। এই কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে অন্য কোনোভাবে তার পরিচয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা বৃথা। এই পরিচয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতা। তার জীবন সংগ্রাম ছিল মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য এবং তার মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে মানবমুক্তি। ‘মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ’ তথা সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল তার আমৃত্যু সংগ্রামী প্রয়াস। মানুষই ছিল তার সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি সব সময় ‘বিপ্লবী মানবতাবাদ’-এর পক্ষে প্রচার করতেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মানবপ্রেমকে বিপ্লবী ধারায় সমাজে সার্বজনীন করে তুলতেই পরিচালিত হয়েছিল তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। সেই কর্মকাণ্ড এ দেশে ও বিশ্বে আজও অব্যাহত আছে। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হলেও নবজাগরিত শক্তি নিয়ে তা অগ্রসর হচ্ছে।
কমরেড মণি সিংহকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালের মে মাসের এক সন্ধ্যায়, ঢাকার কল্যাণপুর এলাকায় একটি বাঁশের বেড়ায় ঘেরা টিনের বাসায় অনুষ্ঠিত ছাত্র-কর্মীদের বৈঠকে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ অবস্থায় আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থায় কাজ করছে। পার্টির ঢাকাস্থ ছাত্র-কর্মীদের একটি সভা করে তাদের সামনে আত্মগোপনে থাকা পার্টি নেতাদের নিয়ে এসে তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক শক্তি সংহত করার জন্য মহান মে দিবস উপলক্ষে সেই বৈঠকের আয়োজন হয়েছিল। সাদা পায়জামার ওপর সাদা ফুল হাতা লম্বা কুর্তা-শার্ট গায়ে ফর্সা, লম্বা, কালো চশমা পরা কমরেড আজাদ নামে যে মানুষটির তেজোদীপ্ত বক্তৃতা সেদিন শুনেছিলাম, তিনিই যে কমরেড মণি সিংহ- সে কথা জানতে পারি পার্টির অন্য নেতাদের কাছে আরও কয়েক মাস পরে। এর পর ১৯৬৭ সালে তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি মুক্ত হয়ে আসেন। তখনই তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এবং সামনা-সামনি কথা বলার প্রথম সুযোগ পাই। সেই প্রাথমিক পরিচয় ঘনিষ্ঠতা লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন কয়েকবার তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। কয়েক দিন একই বাসায় কাটিয়েছি। আমি ছিলাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’র প্রথম দলের একজন কমান্ডার। তিনি আমার কাছে অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে, যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে, গেরিলা দলগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জানতে চাইতেন। এসবই যেন তার নিজস্ব বিষয়, একান্ত আপন ভুবনের ব্যাপার। তার সঙ্গে আলোচনায় গারো পাহাড় এলাকার টংক প্রথাবিরোধী সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের সেনাপতি অস্ত্র কাঁধে ঝুলানো সাদা ঘোড়ায় সওয়ার চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের মণি সিংহই আমার মানসচক্ষে সামনে এসে দাঁড়াত।
তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্যতম ব্যক্তিত্ব- স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এবং কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, আন্তর্জাতিক, আদর্শিকসহ বহুবিধ কাজে সে সময় ৭০ বছর বয়সের এই মানুষটি ৯ মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা সঠিক পথে প্রবাহিত করতে, তার প্রগতিমুখীনতা নিশ্চিত করতে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দেশি-বিদেশি শক্তির সমাবেশ ও ঐক্য গড়ে তুলতে এবং জাতির এই মরণপণ সংগ্রামকে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে অমূল্য অবদান রেখেছেন। এত কাজের মাঝেও আমার সঙ্গে দেখা হলেই তার উচ্ছ্বাস বেড়ে যেত। স্পষ্টই বুঝতে পারতাম, তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছে। যেন তার যৌবন তিনি ফিরে পেয়েছেন।
মণি সিংহ ছিলেন একজন অকৃত্রিম ‘জাত বিপ্লবী’। স্বাধীনতার পর আরও অনেক কাছে থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছে। অগণিত সভায়, প্রকাশ্য-গোপন বৈঠকে, আন্ডারগ্রাউন্ডে এক ডেনে, জেলা সফরে, জনসভায়, বিদেশ সফরে, পার্টির সমাবেশে, কৃষক সমিতি-ক্ষেতমজুর সমিতির কর্মসূচিতে তার সঙ্গে কাজ করেছি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং একপর্যায়ে পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীতে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগও আমার হয়েছে। তাকে কাছে থেকে দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি। তার মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছি অসাধারণ এক ‘মানুষ’কে।
এসব ছাড়াও আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল তার সঙ্গে অনেক মাস জেলখানায় একসঙ্গে একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি সিটে থাকার। আমার কারাজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল কমরেড মণি সিংহের নিবিড় সঙ্গ পাওয়া, কারাগারে আচার্যের সান্নিধ্য পাওয়া। বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনবোধের নিখুঁত প্রতিফলন তার মাঝে তখন দেখেছি। শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রাত্যহিক জীবনাভ্যাস, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-বিনোদন, বন্দিদের প্রতি মমত্ববোধ, সাধারণ কয়েদিদের প্রতি প্রীতিময় আচরণ- এসব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল তখনকার ৭৫ বছর বয়সী মণি সিংহের কারাগারের দিনগুলো। এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি অধিকার ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার নিরন্তর লড়াই চালানোর ঘটনা। বন্দি করে রেখেছ, তাতে কী? এখানেও লড়াই চলবে। বিপ্লবী জীবন অব্যাহত থাকবে কারাগারেও। হয়তো অন্য পথে, অন্য পন্থায়। জেলখানার বন্দি দিনগুলোকেও কাজে লাগাও- বই পড়, পাঠচক্র চালাও, আলোচনা সভা কর। উন্নত পরিবেশের জন্য জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরবার কর। রেশন কেন খারাপ এলো? পত্রিকা আসতে বিলম্ব হয় কেন? ডাক্তার রাউন্ডে থাকে না কেন? যা বিদ্যমান তাকেই ধ্রুব ধরে নিয়ে, ‘বাস্তবতা’ বলে অজুহাত দিয়ে চলতি অবস্থার কাছে, চলতি হাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করা চলবে না। এসব হলো ১৯৭৭ সালের কথা। এসবের মাঝে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেছিলাম একজন প্রকৃত বিপ্লবীর অন্তরের অবিরাম সঙ্গীত মূর্ছনার মর্মবাণী।
পাকিস্তানের শুরুর দিকে টংক আন্দোলনকে দমন-পীড়ন চালিয়ে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার পর নূরুল আমিনের সদম্ভ আস্টম্ফালন ‘কমিউনিস্টদের এবার কবর দিয়ে দিলাম’ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে মণি সিংহ তার ভাষণে প্রায়ই এ বিষয়ে উপসংহার টানতেন এই বলে- ‘কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। এই পার্টিকে যারা ধ্বংস করতে চাইবে, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। কমিউনিস্ট পার্টি জিন্দা আছে, জিন্দা থাকবে।’ পার্টির মধ্যে ক্রমপ্রসারমান দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদী, মধ্যবিত্তসুলভ প্রবণতা ও বিচ্যুতি সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি বহুবার সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। দু’এক সময় ক্রোধান্বিত হয়ে এও বলেছেন, এভাবে যদি চলে তা হলে পার্টি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আজ তোমরা যেসব কথা বলছ; দেখো, এসব কথার সুর ধরেই একদিন বলবে- পার্টিই বাতিল করা হোক, শ্রেণি সংগ্রাম বাতিল করা হোক। এসব এখনই তোমরা বন্ধ কর। নয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। পার্টির ভেতরে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা, শ্রেণি সংগ্রাম থেকে দূরে থেকে পার্টি নেতৃত্বের কাছে ভিড় করার প্রবণতা, নানা অজুহাতে পার্টির শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতার লঙ্ঘন, সার্বক্ষণিকদের কর্মকাণ্ডে ঢিলেঢালা ভাব ইত্যাদির তিনি কঠোর সমালোচক ছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারা থেকে প্রথম সুযোগেই মার্কসবাদী জীবনাদর্শ গ্রহণ করা, শ্রমিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, নিজ জেলায় পারিবারিক আভিজাত্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক সশস্ত্র টংক আন্দোলন পরিচালনা, সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রে সাহসের সঙ্গে তিলে তিলে গণতন্ত্র, স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিভূমি রচনা করা, ‘মাওবাদ’ বিষয়ে সঠিক অবস্থান নিয়ে বামপন্থি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা, দক্ষিণপন্থি পদস্খলনের বিপদ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক হুঁশিয়ারি দেওয়া, পার্টিতে বিভেদের বিরুদ্ধে সব সময় অবস্থান নেওয়া এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা কঠোরভাবে অনুশীলন- এসবই কমরেড মণি সিংহকে পার্টির স্বাভাবিক শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দিয়েছিল। নীতি-আদর্শ প্রশ্নে সব সময় অবিচল-অনমনীয় থাকলেও তিনি কখনও সংকীর্ণ ছিলেন না। মূল শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যের বিষয়কে বিপ্লবী কর্মকৌশল বলে জানতেন; রণনীতি ও রণকৌশলের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কখনও বিস্মৃত হতেন না এবং সব সময় পার্টির স্বাধীন রাজনৈতিক ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতেন।
কমিউনিস্ট আদর্শবোধই তাকে একজন বিশুদ্ধ, অনুপম, অনুকরণীয় দেশপ্রেমিকের পরিচয় এনে দিয়েছে। সততা, ত্যাগ, আদর্শ-নিষ্ঠা, কঠোর শৃঙ্খলাবোধ, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ, দায়িত্ববোধ, দেশমাতৃকার স্বার্থে আত্মস্বার্থ বিসর্জন, জনসেবা-দেশসেবাকে সাধনা হিসেবে গ্রহণ; প্রতিদিনের চিন্তা-কাজে মানবমুক্তি ও দেশপ্রেমের অধ্যয়ন, ছোট-বড় সব কাজে বিপ্লবী জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর নিরন্তর প্রয়াস কমরেড মণি সিংহের মাঝে দৃষ্টান্ত-স্থানীয় রূপে বিরাজমান ছিল। বর্তমানে যখন অপরাজনীতি, ব্যবসায়িক রাজনীতি, সুবিধা ও হালুয়া-রুটির রাজনীতি, আত্মস্বার্থের রাজনীতি এবং ‘বাজার অর্থনীতি’র দানবীয় বিস্তারের মুখে ‘বাজার রাজনীতি’ সবকিছুকে গ্রাস করে চলেছে, তখন জাতির সামনে আজ এক অগ্রগণ্য কর্তব্য ‘রাজনীতি বাঁচাও’। অপরাজনীতিকে পরাজিত করে ‘রাজনীতি’কে বাঁচানোর সংগ্রামে তিনি এক অজেয় শক্তিমান প্রতীক। নীতি-আদর্শ, ত্যাগ, দেশপ্রেম, প্রগতির রাজনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্য আজ ডাক এসেছে। এ ডাকে সাড়া দিতে হবে সব সৎ মানুষকে।
কাণ্ডারি হয়ে পথ দেখাচ্ছেন চিরঞ্জীব কমরেড মণি সিংহ- তোমাকে ‘রেড স্যালুট’!
লেখক:

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি
সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল