মুজিবের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর কোলকাতায়

Comments

১৯৭২ সাল ৬ ফেব্রুয়ারী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম বিদেশ সফর। স্থান কলকাতা। ৮ জানুয়ারী পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হবার পর কোলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীর আশা ছিল লন্ডন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় শেখ মুজিব দিল্লি থেকে ঢাকার পথে কোলকাতায় কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নামবেন। তাই নেতাকে এক নজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সময়াভাবে বঙ্গবন্ধু সেদিন দমদম বিমানবন্দরে নামতে পারেননি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গবাসীকে কথা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘প্রথম সুযোগেই আপনাদের মাঝে আসবো।’ কথা রেখে তিনি পৌঁছলেন কোলকাতায়।

ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জনতার উদ্দেশে দেবেন ভাষণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী থাকবেন তাঁর সাথে সেই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায়। জনসমাগমের দিক থেকে সেই জনসমুদ্রের আকার আজও কোলকাতার বুকে রেকর্ড হয়ে রইলো।

ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ স্বতঃস্ফূর্ত, উত্তাল পশ্চিমবঙ্গবাসীর সম্মুখে ভাষণ শুরু করলেন, “…আমার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের জন্য আমি সাত কোটি বাঙালীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি, কৃতজ্ঞতার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি…”

সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা কেবল এক সদ্য-স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ মাত্র ছিল না, ছিল দুই দেশের, দুই বাংলার মানুষের ভালবাসা ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও। তিনি বললেন, “যে জাতি মুক্তিপাগল, যে জাতি স্বাধীনতাকে ভালবাসে, সে জাতিকে বন্দুক কামান দিয়ে দাবাইয়া রাখা যায় না” বঙ্গবন্ধুর মুখে এ কথা শুনে সেদিন উদ্বেলিত হয়েছিল কলকাতা।

1972_6 Feb_Indira-Mujib_03

ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত লাখো জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী।

বার বার মুজিব উচ্চারণ করেছেন রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি, কখনও কৃতজ্ঞতা বোধের কথা, কখনও স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গড়ার পথে যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা, কূটনৈতিক ষড়যন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার দৃঢ়তার কথা। তাঁর আবেগী সম্ভাষণে উঠে এসেছিল বাংলা ও বাঙালীর স্বাধীনতাস্পৃহা যাঁদের উত্তরাধিকার সেই তিতুমির থেকে মাস্টারদা সূর্য সেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথা।

তিনি বলেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে”।

অগ্নিঝরা সে ভাষণে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য ভারতের জনগণ, সরকার, সশস্ত্রবাহিনী, বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসামের জনগণের প্রতি জানান সবিশেষ কৃতজ্ঞতা।

এর আগে সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিশেষ বিমান যোগে ঢাকা থেকে কোলকাতার দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমানবন্দরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেখানকার রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীসহ রাজভবনের উদ্দেশ্যে একটি হেলিকপ্টারে করে মোহনবাগান ময়দানে এসে নামেন। গাড়িবহর সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে রাজভবনে যাওয়ার পথে থামে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিমূর্তির সামনে। দুই নেতার মূর্তিতে শেখ মুজিবুর রহমান পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।

1972_6 Feb_Indira-Mujib_Brigade Parade Ground

ব্রিগেডের উত্তাল জনসমুদ্রে ভাষণ দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

কলকাতায় ৩ দিনের এই সফরে রাজভবনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী  দুই দফা আলোচনায় মিলিত হন। দমদম বিমানবন্দর থেকে রাজভবনে গিয়ে এই দুই নেতা প্রথম দফা আলোচনায় প্রধানত এশিয়ার বিভিন্ন সমস্যা এবং এসব সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করেন। বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কে পাকিস্তান যে মনোভাব গ্রহণ করেছে, প্রথম দফা বৈঠকে সম্ভবত তাও আলোচিত হবে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পায়। দুই নেতার আলোচনার বিশদ প্রকাশ করা না হলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে জানা যায় যে দুই নেতা যুদ্ধবন্দী বিষয় এবং পাকিস্তান থেকে বাঙালীদের ফেরত আনার বিষয়েও আলোচনা করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ সফরের প্রথম দিনের দমদম বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা ও ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড তাঁর ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, দূরদর্শন ও আকাশবাণী থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

বাঙালীয়ানা/এসএল

৭ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে কি ঘটেছিল 

মুক্ত মুজিব: লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন

মুক্ত মুজিবের ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ

ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়

অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলো, পড়ুন

ডিসেম্বর ১৯৭১

নভেম্বর ১৯৭১

অক্টোবর ১৯৭১

সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আগস্ট ১৯৭১

জুলাই ১৯৭১

জুন ১৯৭১

মে ১৯৭১

এপ্রিল ১৯৭১

মার্চ ১৯৭১

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.