‘মুজিব’ চলচ্চিত্র: একটি পর্যালোচনা । মোরশেদ শফিউল হাসান

Comments

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রটি দেখলাম আজ। ঠিক তিন ঘণ্টার ছবি। এমন ব্যাপ্তিকালের ছবি কবে শেষ দেখেছি, কিংবা আদৌ কখনো দেখেছি কি না, মনে করতে পারছি না। ভয় ছিল যাকে বলে ‘বোরড’ হই কি না। তাও আবার জানা ইতিহাসের কাহিনি! তাই এত তাড়াতাড়ি ছবিটি দেখতে চাইনি। তবে আমার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে তিনঘণ্টা আমি ঠিকই উন্মীলিত চোখে হলে বসে থাকতে পেরেছি। আমার সহদর্শক এবং ইতিপূর্বে, এমনকি নবীন প্রজন্মেরও অন্য যারা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাদেরও কারো কারো সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তারাও কেউ ছবিটি দেখতে গিয়ে মাঝপথে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন নি বা বিরক্ত হননি। আমার মতে এটাই এই ছবিটির সবচেয়ে ভালো বা প্রধান ইতিবাচক দিক। যারা চলচ্চিত্রবোদ্ধা হিসেবে পরিচিত, চলচ্চিত্রের নির্মাণ শৈলী বা তার খুঁটিনাটি নিয়ে যারা মাথা ঘামান, তাঁরা হয়তো একভাবে ছবিটির মূল্যায়ন করবেন। আমি একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে এখানে আমার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরছি।

এমনকি আমাদের মধ্যেও যারা ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এর দশক অবধি এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা কিংবা অন্তত খবরের কাগজ ও বইপত্র পাঠসূত্রে কমবেশি পরিচিত, এবং যারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বাপর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন,  তাঁরা এই চলচ্চিত্রটিতে সমালোচনাযোগ্য অনেককিছু খুঁজে পাবেন, সন্দেহ নেই। আমি নিজেও পেয়েছি। বেশকিছু ভুলত্রুটি, তথ্য ঘাটতি এমনকি ইতিহাসের অতিসরলীকরণ বা বিকৃতিও (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত জানি না) আছে ছবিটিতে, যেগুলো এড়াতে পারলে নিশ্চয় ভালো হতো।

তবে এটি একটি ‘বায়োপিক’। সেভাবেই ছবিটির পরিচয় দেওয়া হয়েছে। বায়োপিকে ইতিহাসের অবিকল অনুকৃতি আমরা খুঁজবো না। ডকুমেন্টারি বা প্রামাণ্যচিত্রের বস্তুনিষ্ঠতাও বায়োপিকে আশা করা উচিত হবে না। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে বায়োপিকের অর্থ বা সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে (আমি হুবহু উদ্ধৃত করছি) : “A film dramatizating the life of a particular person, typically a public or historical figure.” সুতরাং দেখা যাচ্ছে নাটকীয়তা বায়োপিকের একটি বৈশিষ্ট্য, অন্তত দোষের নয়। চলচ্চিত্রটি শুরু হওয়ার আগেও পর্দায় উৎকীর্ণ প্রারম্ভিক লিপিতে দর্শকদের এই ‘নাটকীয়তা’র কথাটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ‘নাটকীয়তা’ এবং ‘অতিনাটকীয়তা’র মাঝের সূক্ষ্ম ভেদরেখাটি সম্পর্কে  সচেতনতার পরিচয় এই চলচ্চিত্রের কাহিনিকার (স্ক্রিপ্ট রচয়িতা) এবং চিত্রনাট্যকাররা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, একথা বলতেই হবে। ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব কিংবা অতিমাত্রায় ‘রাজনীতি সচেতনতা’ এই দুটি কারণের যে-কোনো একটি এর জন্য দায়ী। কিন্তু এর ফলে ইতিহাসের ঘটনার চিত্রায়ন হিসেবে চলচ্চিত্রটি কোথাও কোথাও তার প্রামাণিকতা হারিয়েছে। সচেতন দর্শককে যা পীড়িত করবে।

আমরা ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাস পড়ে বিষাদাক্রান্ত হই, কিন্তু উপন্যাসে বর্ণিত সকল ঘটনাকে আজ ইতিহাস বলে ভুল করি না। একইভাবে শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক দেখে বীরত্ব ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হই। কিন্তু নাটকের ‘সিরাজউদ্দৌলা’কে অবিকল ইতিহাসের চরিত্র বলে মনে করি না। তবে কালোত্তরে মিথে পরিণত হয়ে কাব্য-উপন্যাস বা নাটকে বিধৃত এসব বীর বা ট্র্যাজিক চরিত্র সাধারণ জনমানসে স্থায়ী আসন লাভ করে। ইতিহাসের চরিত্রের চেয়েও তা বড় হয়ে দাঁড়ায়। এই মহাসত্যটি আমাদের মনে রাখা দরকার। কিন্তু তারপরও মুজিব কিংবা এই চলচ্চিত্রের অন্য মানুষগুলো যেহেতু কোনো পৌরাণিক বা দূর ইতিহাসের চরিত্র নয়, খুব নিকট ইতিহাসেই ছিল তাঁদের বাস এবং বিচরণ, আর তাঁদের এবং যে-সময়ে তাঁরা বেঁচেছিলেন সে সম্পর্কে জানার জন্য বইপত্র ও অন্যান্য উপকরণেরও অভাব নেই, ফলে চরিত্রগুলো নির্মাণ বা উপস্থাপনে আরেকটু বেশি মনোযোগ, দায়িত্ববোধ ও যত্নশীলতা আমরা আশা করতেই পারতাম। অন্তত আশা করাটা অন্যায় হতো না।

চলচ্চিত্রটির কাহিনি বা চিত্রনাট্য যারা রচনা করেছেন, তাঁরা তাড়াহুড়া থেকেই হোক বা অন্য কোনো কারণে বেশি বইপত্র ঘেঁটেছেন বলে মনে হয় না। এর মধ্যে মুজিব জীবনের যে-পর্বটুকুর ব্যাপারে তাঁরা খোদ মুজিবেরই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটির সহায়তা নিতে পেরেছেন, সেখানে তাঁরা অধিক সফল, অন্যত্র ততটা নয়। বরং মনে হয় শোনা কথা বা ধারণা অনুযায়ী কল্পনার আশ্রয় নিতে গিয়ে কোথাও কোথাও ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতাই শুধু নয়, শিল্পের শর্তকেও লঙ্ঘন করেছেন। যেমন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫০ এর দশকের অত্যন্ত মেধাবী একজন তরুণ রাজনীতিক শামসুল হক, মুজিব নিজে তাঁর আত্মজীবনীতে যার সম্পর্কে অতটা শ্রদ্ধা, এমনকি তাঁর অসুস্থতাজনিত মানসিক বৈকল্যের উল্লেখ করতে গিয়েও অতটা দরদ বা সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছেন, চলচ্চিত্রে ওরকম সার্কাসটিকালি তাঁকে উপস্থাপন নৈতিক দিক থেকেও কতটা সঙ্গত বা উচিত হয়েছে, সে প্রশ্ন তোলাই যায়। ছবিটি মুজিবকে নিয়ে, তিনিই এ চলচ্চিত্রের মুখ্য বা মূল চরিত্র। ফলে পুরো কাহিনিতে তিনিই প্রাধান্য পাবেন, ঠিক আছে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা পরবর্তী  সময়ে গান্ধী-সোহরাওয়ার্দী সাক্ষাৎকারের চিত্রায়নে গান্ধী-মুজিবের সরাসরি কথোপকথন, প্রাপ্ত একটিমাত্র স্থিরচিত্রের (যাতে সেখানে মুজিবকে পেছনে দরজার কাছে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়) ভিত্তিতে যা কল্পিত হয়েছে বলে মনে হয়, কিংবা সেই সাক্ষাৎকারে সোহরাওয়ার্দী-কন্যা আখতারের (বেবী) উপস্থিতি ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতাকে অনেকদূর ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করি। দেশবিভাগ-পূর্ব সময়ে মুজিবসহ বাঙলার তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীরা যার আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও নেতৃত্বে পরিচালিত হতেন, চলচ্চিত্রে সেই আবুল হাশিম দেখলাম পুরোপুরিই অনুপস্থিত। যুক্তবাঙলা প্রতিষ্ঠা প্রয়াসটিরও উল্লেখমাত্র নেই। ভাসানী-মুজিব সম্পর্ককে যেভাবে আগাগোড়া পিতা-পুত্রের মতো দেখানো হয়েছে, তা কারো কারো দ্বারা প্রশংসিত হতেও পারে। কিন্তু বলতেই হবে তা অতিসরলীকরণ দোষে দুষ্ট। তাঁদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য, দলবিভক্তি বা অন্যকথায় সম্পর্কের মধ্যকার টানাপড়েনের সামান্য ইঙ্গিত বরং বায়োপিক হিসেবেও বর্তমান ও ভবিষ্যৎকালের দর্শকদের এদেশের ইতিহাসের গতিধারা বুঝতে সহায়তা করতো বলে মনে করি। খন্দকার মোশতাক কি সব সময়ই মুজিবের মতের বিরোধিতা বা তাঁর সঙ্গে তর্ক করতেন? ছবিতে যেমনটি দেখানো হয়েছে?  বরং ভেতরে যে মনোভাবই পোষণ করুন, সামনে অতিভক্তি দেখিয়েই তো তিনি মুজিবের বিশ্বাস অর্জনে প্রয়াসী ছিলেন। তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রিসভার সিনিয়র মন্ত্রী মোশতাকের সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের দৃশ্যটি যে-কারো কাছেই একটি প্রক্ষিপ্ত ও আরোপিত দৃশ্য বলে মনে হবে (ষড়যন্ত্র বা মুজিব হত্যায় যোগসাজশ বোঝাতেও অমন একটি সাক্ষাৎকারের দৃশ্য কি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে?) তবু ভালো যে, এই দৃশ্যে অন্তত জিয়ার মুখে কোনো সংলাপ জুড়ে দেওয়া হয়নি।

তবে চলচ্চিত্রের কাহিনিকার বা চিত্রনাট্যকারের প্রশংসা এ কারণে করতেই হবে যে, অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম বা অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম প্রমুখ কারো কারো লেখা জীবনী বা ইতিহাস অনুসরণ করে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী আন্দোলনে মুজিবের নেতৃত্বের প্রসঙ্গটি আনেননি।  ১৯৪৮ সালে কার্জন হলের কনভেনশনে জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ঘোষণার মুখে নাঈমুদ্দীন আহমদ প্রমুখ যেসব ছাত্র স্নাতক সনদ নিতে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রতিবাদের দৃশ্যে মুজিবকেও দেখাননি (তাঁকে দেখানো হয়েছে কার্জন হলের বাইরে প্রতিবাদী তরুণদের নেতৃত্ব দিতে)। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনেও তাঁরা মুজিবকে দেখাননি ( তিনি তখন কারাবন্দি)। মুজিব নিজেও তাঁর আত্মজীবনীতে ইতিহাসের এসব ঘটনায় তাঁর নেতৃত্ব দান বা শারীরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। সেই ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কলাভবনের সামনে মুজিবের রিক্সা থেকে নামার দৃশ্য , কিংবা একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর হাসিনার হাতে ভারতীয় বিমান থেকে ছড়ানো যে বাংলা প্রচারপত্রটি দেখানো হয়েছে তার প্রামাণিকতা, বায়োপিক বিবেচনায় এসব খুঁটিনাটি ত্রুটির ব্যাপারে আমরা যদি উপেক্ষার মনোভাবও দেখাই। যদিও চিত্রনাট্যকারসহ  নির্মাণ সহযোগীরা অনেকেই যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ, এসব ডিটেইলের ব্যাপারে তাঁদের আরও মনোযোগী, অনুসন্ধানপ্রবণ ও যত্নশীল হওয়ার সুযোগ ছিল।

মুজিবকে নিয়েই এই বায়োপিক, তিনিই এর কাহিনির মূল বা কেন্দ্রীয় চরিত্র। তারপরও মুজিবের পাশাপাশি তাঁর পত্নী ফজিলাতুননেসা ওরফে রেনুর উজ্জ্বল উপস্থিতি ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রটিকে, আমি বলব, এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। শিল্প হিসেবে একে অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে। আমাদের ইতিহাসে বা শিল্প-সাহিত্যে কোনো নারীর অবদান এতটা গুরুত্ব দিয়ে আগে কখনো উপস্থাপিত হয়েছে কি না সন্দেহ। মুজিবের মুজিব হয়ে ওঠার, একটি স্বাধীন জাতির রূপকার হিসেবে তাঁর আবির্ভাবের পেছনে বেগম মুজিবের ভূমিকার কথা আমরা ইদানীং মুজিবের নিজের রচনা এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার লেখা বা বক্তব্য থেকেই জানতে পারছি। কিন্তু দৃশ্যপটের বাইরে থাকা একজন সাধারণ সংসারী নারী হয়েও যে ত্যাগ, মনোবল, অপরিসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে মুজিবকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন, ইতিহাসের সে সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য, অন্যান্য বইপত্র পড় ছাড়াও, এই চলচ্চিত্রটি দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও, এই চলচ্চিত্রটির আমি উচ্চ মূল্যায়ন করতে চাই। মাঝে মাঝে ধারাভাষ্য পাঠ ছাড়াও, নুসরাত ইমরোজ তিসা এই ছবিতে রেনু বা বেগম মুজিবের ভূমিকায় চরিত্রানুগ অভিনয় করেছেন। বলা যায় তাঁর সহজ সাবলীল অভিনয়ও ছবিটিকে এগিয়ে নিতে অনেক সাহায্য করেছে। ছবিটির জন্য অভিনয় শিল্পীদের কাস্ট করার পর্যায়ে অনেকেই মুজিব চরিত্রের আরিফিন শুভ কতটা উপযুক্ত হবেন তা নিয়ে সংশয়-শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বিশেষ করে টিভি নাটকে অভিনয়ের সুবাদে প্রতিষ্ঠিত তাঁর রোম্যান্টিক নায়ক ইমেজই হয়তো ছিল যার কারণ। কিন্তু ছবিটি দেখার পর আমার মতো অনেকেরই হয়তো মনে হবে, মুজিব চরিত্র রূপায়নের জন্য চেহারা, দৈহিক আকৃতি, কণ্ঠস্বর ইত্যাদি সব মিলিয়ে আরেফিন শুভর চেয়ে যোগ্য আমাদের অভিনেতাদের মধ্যে আর কে হতে পারতেন? এই ছবিটিতে তিনি তাঁর স্বাভাবিক ইমেজ রক্ষা করে ভালো অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন ও করেছেন (তবে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ চরিত্রে অভিনয়ের পর আনোয়ার হোসেনের যে-অবস্থা হয়েছিল, মুজিবের মতো এমন একটি চরিত্রে অভিনয়ের পর শুভকেও দর্শক আর তার পুরানো তরুণ  রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকায় মেনে নিতে পারবেন কি না কে জানে)। অন্যান্য অভিনয় শিল্পীরাও তাঁদের চরিত্র অনুযায়ী কমবেশি ভালো করেছেন। প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে একমাত্র নুসরাত ফারিয়া কোথাও কোথাও দর্শককে হতাশ করবেন বলে আমার আশঙ্কা।

ছবিটির দৃশ্যসজ্জা, ফটোগ্রাফি, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মেকআপ ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ করবার খুব একটা কিছু নেই। সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার অধিকারী বা যোগ্যও আমি নই। তবে ইতিহাসের এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র নিয়ে এমন একটি চলচ্চিত্র (হলোই বা তা বায়োপিক) নির্মাণের জন্য প্রতিটি যতটা প্রস্তুতি বা হোমওয়ার্ক করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি বলে ছবিটি দেখার পর অন্তত সচেতন দর্শকের মনে হবে।

শ্যাম বেনেগাল ভারতের জীবিত সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন। ভারতের সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রকারদের নেতৃস্থানীয় একজন হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয়। তাঁর ‘অংকুর’ ছবিটি দেখার পর থেকে আমি নিজেও তাঁর একজন ভক্ত। বায়োপিক নির্মাণেও তাঁর দক্ষতা স্বীকৃত। এর আগে সুভাষ বসুকে নিয়েও তিনি একটি বায়োপিক তৈরি করেছেন। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তাঁর বয়স এখন ৮৮। এই বয়সে তাঁর পক্ষে নিশ্চয় আগের মতো সক্রিয়তা বজায় রাখা সম্ভব নয়। দায়িত্ব নিয়ে তিনি মূলত তাঁর ভারতীয় সহকারী এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগীদের সহায়তা নিয়ে পুরো চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। দৃশ্য ধারণের সময় শুটিং স্পটেই যে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি শুধু তাই নয়। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন ও অনুধ্যানেরও যথেষ্ট সময়-সুযোগ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে তিনি তাঁর সুনামের প্রতি শেষ পর্যন্ত কতটা সুবিচার করতে পেরেছেন, সে সন্দেহ আমাদের থেকেই যায়।

তবে উপরিউক্ত সব ত্রুটিবিচ্যুতি বা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বলতেই হবে  ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ একটি ভালো এবং সকল বিবেচনায়ই দেখার মতো চলচ্চিত্র। বিশেষ করে আমাদের নবীন ও ভবিষ্যৎ  প্রজন্মের নাগরিকদের এই ছবিটি দেখা উচিত। আমাদের ইতিহাসের গতিধারা বুঝতে যা তাদেরকে সাহায্য করবেন।

লেখক পরিচিতি:
Morshed Shafiul Hasan
মোরশেদ শফিউল হাসান, গবেষক, লেখক, কবি

*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট