মুবিন খানের কবিতা

Comments

নিষ্পাপ

শোন, আমারে পাপী হইতে হবে
আমারে অনেক অনেক পাপ করতে হবে
শুনছি ঈশ্বর নাকি তার প্রিয় মানুষদের
ধরেবেন্ধে নিজের কাছ লয়ে যায়!
ঈশ্বরের কাছে যেয়ে কি করব আমি!
তার লগে তো আমার কোনো আয়ব্যয় নাই
এই না যাওয়ার তরে পাপ লাগবে আমার
আমার অনেক অনেক পাপ দরকার।
তুমি আমার পাপ হবা? হবা পাপের কারণ?
অরাজি হয়ে লাভ নাই গো
তোমার লোভে লোভে ঈশ্বররে আমি
বুইড়া আঙুল দেখায়ে দিছি।
তোমারে লয়ে তোমার লগে- দুজনে মিলে
পৃথিবীর সকল পাপ করব আমরা
বেহেশতে বসে সত্তর হুরেরা আফসোসে দেখবে
পৃথিবীই বেহেশত হয়ে গেছে তখন।

বর্ষা

বর্ষা মেয়েটা খুব অপরূপ, তোমার মতোই
রেগে গেলে বুকের ভেতর মেঘ গুড়গুড়
দুঃখ পেলে বুকের ভেতর মেঘ গুড়গুড়
টলটলে চোখ চেয়ে থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকে
তোমার মতোই।

বর্ষা মেয়েটা দুঃখী যে খুব
বুকের ভেতর মেঘ গুড়গুড়
ছলছলিয়ে ঝরতে থাকে ইলশে গুঁড়ি
ফিসফিসিয়ে খুব গোপনে কাঁদতে থাকে
তোমার মতোই।

অস্থিরতায় ছুটে আসে, তোমার মতোই
ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্তনাদে বলে ওঠে,
‘জীবনটা কেন কেমন যেন!’
বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে, মেঘ গুড়গুড়
আমার মতোই।

সুরুযের রোদ্দুর

সূর্য নয়, সুরুয আলীর ছেলেটার নাম ‘রোদ্দুর’
সুরুয আলী আমাদের পাড়াতেই থাকত
আমাদেরই সমবয়সি ছেলে সুরুয আলী
তবে শ্রেণিগত অহঙ্কারে আমরা অনেক বড়।

আমরা খুব অবলীলায় বলে দিতাম, ‘চল্ যাই’
সুরুয আলী বলত, ‘চলেন ভাই কই যাইবেন’।

কখনও গন্তব্য জানতে চাইত না সুরুয আলী
রিকশা চালাত, চালাতে চালাতে সুরুয আলীর
শরীর নিংড়ে সর্বাঙ্গ বেয়ে ঝরতে থাকত জল
একটু ফুরসতে জিরোলে কিচকিচ করত লবণ।

পেছনে আমরা গতিময়তার ফুরফুরে হাওয়াতে
একলা, পাশে বন্ধু কখনও, কখনও বিদূষী তরুণী
আপ্লুত কথোপকথন, সুরুয আলী শোনে কি?
শোনে না; আমাদের কথাদের শুনতে নেই ওর।

শোনে আসলে, কান পেতে রয় কথাদের আবিরে
দু পায়ে বিরতিহীন রিকশার চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে
শরীর নিংড়ে লবণ জল ঝরাতে ঝরাতে
বুকের গহীণে খুব গোপনে স্বপ্ন বোনে সুরুয আলী।

এক সকালে আমার দরজার কড়া নড়ে ওঠে
লাজুক মুখে সুরুয আলী একটা ঠোঙা হাতে দাঁড়িয়ে
বিস্মিত আমাদের দিকে ঠোঙা বাড়িয়ে বলে,
‘ভাই, বিয়া করছি, আপনের জন্যে মিষ্টি আনছি’।

আমাদের বড় ভালো লাগে, আহ্লাদিত আমোদ হয়
মিষ্টি মুখে সকৌতুক ঠাট্টা ছুঁড়ি সুরুয আলীকে
বছর না ঘুরতেই আবারও ঠোঙা হাতে একদিন
‘ভাই, একটা পোলা হইছে, আপনে নাম দিবেন’।

এবারে সকৌতুক ঠাট্টা নয়, ভীষণ বিমূঢ় বিস্ময়!
‘তুই তো সূর্য, তাহলে ‘রোদ্দুর’ রেখে দে নাম’
‘রইদ’ কখনও নাম হতে পারে! অবাক সুরুয আলী
ছেলেকে তবু পরম আদরে ‘রোদ্দুর’ নামেই ডাকে।

বুকের গহীণে খুব গোপনে স্বপ্ন আঁকে সুরুয আলী
সূর্যকিরণের মতোই ঝলমলিয়ে উঠবে ‘রোদ্দুর’
তার মতো রিকশা চালক নয়, লেখাপড়া করাবে,
বড় মানুষ হবে ছেলে, প্রশান্ত ভাবনা সুরুয আলীর।

কিন্তু বিত্ত দিয়ে গঠিত সমাজ আর শ্রেণি জানলেও
রাষ্ট্র বোঝে না সুরুয আলী, বোঝে না ব্যবস্থাদের
তাই বোঝে না শিক্ষাদের তিনরকম ব্যবস্থাও
সরকারি প্রাথমিকের গন্ডিতে ঝলমল রোদ্দুর।

তারপর হেঁটে হেঁটে মাদ্রাসায় পথ ধরে সূর্যর কিরণ
রাষ্ট্র শুধু বিত্তবানের ছেলেকেই বড় মানুষ হতে দেয়
রোদ্দুর তাই কাঠফাটা রোদ্দুরে শহরময় রোদ্দুর
সর্বাঙ্গে ঝরে জল, শুকালে কিচকিচ করে লবণ।

তোমার গল্পটা…

শুনছো? তোমার গল্পটা আমি বদলে দেব
আহা শোনই না, গল্পে তুমি হবে রাজকন্যা
যার সবকিছু একেবারে রূপকথার মতো
কিন্তু দূরের মানুষ নয়, ছুঁয়ে দেয়া যায়।

না না, সোনার কাঠি রূপার কাঠি দিয়ে
ঘুম পাড়ানো রাজকন্যা হওয়াবো না
সে তো পরাধীন, বন্দিনী দৈত্যের
তুমি হবে স্বাধীন রাজ্যের স্বাধীন নারী।

খুব সাধারণের মনের মাধুরীর রাজকন্যা
মুকুট পরাবো না মাথায়, নিজেই হবো ছায়া
বৃষ্টি চাইলে হবো মেঘ, যদি জ্যোৎস্না চাও, তবে
সূর্য থেকে ধার করতে আলো, ছুটব আকাশে।

কি বললে! রক্তকরবীর নন্দিনী হতে চাও?
নাহ্‌, নন্দিনী নয়, মকররাজ বড় নিষ্ঠুর
পুঁজিবাদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি, বড় জটিল লোক
আলোতে না আসা, অন্ধকারের মানুষ তিনি।

নন্দিনীর রঞ্জনের মৃত্যু নিশ্চিত করতে চান
আমাকে ‘বিশুপাগল’ বানায় কিনা কে জানে!
বিশুপাগলও নন্দিনীকে খুব ভালোবাসে
কিন্তু লোভীর মতো নন্দিনীকে পেতে চায় না।

না না, নন্দিনী নয়; কি বললে? লাবণ্য তবে?
লাবণ্য অবশ্য তোমার মতোই সৌন্দর্যে, রুচিতে,
হৃদয়ে, জ্ঞান আর কবিতায় অভিজাত বটে
তবু লাবণ্য নয়, লাবণ্য অমিতকে ছেড়ে যায়।

দেবী চৌধুরানীর প্রফুল্ল হবে তবে! হয়ো না।
জমিদার পুত্রবধু, কিন্তু সমাজ ডাকে জাতিভ্রষ্টা
শ্বশুর নেয় না,বিয়ের দিনেই তাই পিত্রালয়ে
শুরুর জীবনটা বড় কষ্টের প্রফুল্লর।

তারচেয়ে তোমাকে ইভ বানাবো, চেনো নি?
পৃথিবীর প্রথম নারী ইভ, খুব সুকৌশলে
ইশ্বরের কাছ থেকে পৃথিবীকে নিয়ে ফেলে
অ্যাডামকে দিয়েছিল, তারপর নিজেই…

পৃথিবীটার সঙ্গে সকল অনুরাগ মিশিয়ে
অ্যাডামের আপন ভুবন হয়ে উঠেছিল।

গল্পটা পৃথিবীর, কিংবা তোমার

তোমার সঙ্গে কথা হয় না।
কতগুলো বছর তোমার সঙ্গে কথা হয় না!
শত যুগ হবে কি? নাকি লক্ষ বছর?
তাহলে এক কোটি বছর হবে মনে হয়।

তারও বেশী! বল কি! আজন্ম নাকি!
না, তা নয় বোধ হয়, তাই না?
বিশ্বব্রহ্মান্ডর বয়স তো তেরো দশমিক
সাত, পৃথিবীর সাড়ে চার বিলিয়ন বছর।

জন্মের পর থেকে আমার মতো করেই
বিগব্যাংয়ের পর এই বিশ্বব্রহ্মান্ডটাও
নয় দশমিক দুই বিলিয়ন বছর ধরে
পৃথিবীর অপেক্ষায় ছিল, সে তো জানোই।

প্রথম যেদিন পৃথিবীর সঙ্গে দেখা, তখন
বলতে গেলেই উত্তাপ ছড়াতো পৃথিবীটা
তোমার মতো করেই, নয়ত ছুটে পালাতো
কক্ষপথে, চারশ’ ষাট কোটি বছর আগে।

তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে শীতল
হতে হতে একদিন হঠাৎ পৃথিবী কাঁদতে শুরু
করল; আহা! সে কি কান্না! সকাল দুপুর রাত
কোটি কোটি বছর বুক ভাসানো কান্না কেবল।

কান্না ঝরানো বৃষ্টিতে পৃথিবীর বুকের কঠিন
পাথরেরা গলতে গলতে মাটি হতে থাকে
তখনও পৃথিবী সবুজ নয়, নয় উর্বর,
নেই প্রাণ, অথচ কি ভীষণ অভিমান!

খুব প্রবল প্রাণীবিহীন প্রাণহীন তখন পৃথিবী
বিশ্বব্রহ্মান্ড পরম মমতায় জড়িয়ে থেকে
আগলে রেখে পৃথিবীর বুকে জমা দুঃখদের
প্রবহমান নদী আর সাগর গড়তে দিল চাঁদ।

পৃথিবীর ছোঁয়ায় মৃত চাঁদও জীবন্ত হলো
এল জোয়ার, বইলো হাওয়া, জাগলো স্পন্দন
নিষ্প্রাণ যৌগগুলো নড়ে উঠল প্রাণস্পন্দনে
কি অসম্ভব স্পন্দন আর জীবনীশক্তির প্রাণ।

তোমারও কি চলছে এখন ডায়নোসর কাল?
চারপাশ জুড়ে কেবলই মাংসাশী লড়াই?
চাঁদকে কি দিই নি তোমার জোয়ার তুলতে?
হাওয়াদের কি বলি নি ঝুমুরে দমকা বইতে?

বুকের গহীনে অষ্টাদশীর তন্দ্রাভাঙা আকুলতা
স্পন্দনে দোলে হৃদপিন্ডর ছন্দময়তা
চাঁদের টানে ফুসফুসের সবেগ হওয়া- তুমি
শোনই না! পৃথিবীর মতোই উত্তাপে পালাও।

আর আমি এখনও বিশ্বব্রহ্মান্ডর মতোই
চেয়ে চেয়ে তোমার কক্ষপথ পরিভ্রমণ দেখি
তোমার দিকে ছুটে যাওয়া গ্রহাণুদের বুকে নিই,
আবার কখনও তোমার বুকেই সুনামি তুলি।

লেখক:
Mubin Khan
মুবিন খান, কবি

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট