ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা — গোটা বিশ্বে শহিদ কবি-সাহিত্যিকদের মূর্ত প্রতীক। যাঁর নাম স্পেনের জাতীয় বিপ্লবী যুদ্ধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোবাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে যখন তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, তখন সারা পৃথিবীর জনপ্রিয় কবিদের মধ্যে উজ্জ্বল ছিল তাঁর নাম। কাব্যগুণে, বিষয়ভাবনা ও বৈচিত্র্যে এবং আধুনিকতম কাব্যরীতিতে লোরকা জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন কেবল স্পেনবাসীর নয়, সমগ্র পৃথিবীর কাব্যপ্রেমী মানুষের অন্তর। বিশ্বখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা তাঁর বন্ধু লোরকার মৃত্যু-সংবাদে বিপন্ন-কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন, ‘স্পেনের সেরা ফুল ঝরে গেল।‘
জন্ম ও শৈশব
১৮৯৮ সালের ৫ জুন স্পেনের ঐতিহ্যময় শহর গ্রানাদার অদূরে আন্দালুসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন লোরকা। দু’ভাই ও দু’বোনের মধ্যে বড়ো লোরকা জন্মের পর কঠিন অসুখে আক্রান্ত হন। ফলে তাঁর বয়সের শিশুরা যখন খেলাধুলায় মত্ত, তখন লোরকার বেশিরভাগ সময় কাটত বাড়ির আঙিনায় ও পড়ার টেবিলে। সেই সময় লোরকার সামনে খুলে যায় আরেক বর্ণিল জগৎ। তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে অভিনয় শুরু করেন। ছাপানো নাটক না পেয়ে নিজেই নাটক লেখা শুরু করেন, যা অভিনীত হতো পারিবারিক উৎসবে। লোরকার বাবা ফেদেরিকো গার্সিয়া রদরিগেজ এবং মা ভিসেন্তা লোরকা রোমেরো। মা ছিলেন পিয়ানো শিক্ষিকা। পারিবারিক ঐতিহ্যের আবহাওয়ায় ছিল শিল্প। আত্মীয় পরিমণ্ডলে ছিল শিল্পী ও দর্শনজানা মানুষজন। পরিবারে একটি বড়ো গ্রন্থাগার ছিল। লোরকা ছেলেবেলায় নিজেও এক সংগীতশিক্ষকের কাছে পিয়ানো শেখেন। সেই শিক্ষকই তাঁর মধ্যে সংগীতজ্ঞ হবার বাসনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর নাটকের প্রতি ছিল অফুরন্ত উৎসাহ। তাঁর ঠাকুমা তাঁকে নাটক রচনায় উৎসাহিত করেছেন। সেইসব নাটক দেশ গাঁয়ের ঐতিহ্য আর লোকসংস্কৃতির ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ থাকত।
শিক্ষা জীবন
ছেলেবেলায় অসুস্থতার কারণে পড়াশোনায় কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়েন লোরকা। তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় আলমোরিয়া বন্দর শহরে। গ্রানাদায় এসে তিনি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্কুলশিক্ষা শেষে তিনি গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের চেয়েও তাঁর আগ্রহ ছিল পাঠক্রমের বাইরের বই পড়তে। এছাড়াও তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়, প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সন্ধানে বেরিয়ে পড়া, বেদেদের জীবন পর্যবেক্ষণ, পিয়ানো ও গিটারে সুর তোলা এবং লোকসংগীত সংগ্রহ ও তাতে সুর দেওয়া প্রভৃতি নানা কর্মকাণ্ডে। এখানে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ছিলেন চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, কবি, গায়ক প্রভৃতি। এছাড়াও ঘনিষ্ঠতা হয় বেদে গায়ক ও নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে।
গ্রানাদায় থাকার সময়েই তিনি দন ফের্নাদো দে লোস নামের এক অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে ১৯১৬-১৭ সাল জুড়ে স্পেনের কাস্তিয়া, লেয়োন ও গালিথিয়া প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করেন। সেই অধ্যাপকের প্রণোদনাতেই তিনি রচনা করেন এক ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘ইমপ্রেসিয়োনেস ই পাইসাহেস’ বা ‘অনুভূতি ও ভূদৃশ্যাবলি’, যা প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে। এই রচনাতেই স্পষ্ট হয় লোরকার চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য, যা চেনাতে সাহায্য করে পরবর্তীকালের লোরকাকে।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।
মাদ্রিদে বর্ণময় জীবন
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ১৯১৯-এ মাদ্রিদের ‘রেসিদেন্সিয়া দে এস্তুদিয়ান্তেজ’-এ পড়তে আসেন। এখানেই লালিত হয়েছেন আন্তেনিও মাকাদো, হোয়ান রামোন হিমেনেথ, পেদ্রো ম্যালিনাস, রাফায়েল আলবেয়র্তি, জর্জ গিয়েন প্রমুখের মতো স্পেনের প্রতিভাবান কবি। এই অনুকূল পরিস্থিতিতে লোরকার গানে, ছবি আঁকায়, আবৃত্তিতে, কবিতা ও নাটক রচনায় এক নতুন প্রবাহের উন্মেষ হয়। এখানেই ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাঁর আগের প্রজন্মের কবি উনামুনো’র সঙ্গে। এছাড়া এই রেসিদেন্সিয়ার কল্যাণে বের্গসঁ, ভালেরি, ক্লদেল আরাগঁ, চেস্টারসন, ক্লিন্ স্, ওয়েলস্ প্রমুখ বিশ্বখ্যাত কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের সান্নিধ্যে আসেন। লোরকার সঙ্গে প্রীতিময় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে কবি জেরার্দো দিয়াগো, চিত্র পরিচালক লুই বুনুয়েল এবং চিত্রশিল্পী সালভাদোর দালির সঙ্গে। এখানে বেশ কয়েক বছর ছাত্রাবাসে অতিবাহিত করে লোরকা ক্লান্তিহীন নিবিড় শিল্প সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সৃষ্টির ভুবনে আপন প্রতিভাকে ভাস্বর করলেন। এই সময়েই (১৯২৮) প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রোমান্সেরো হিতানো’ বা ‘জিপসি গাথা’। এই বইটি পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়। এর আগে ১৯২৭-এ বার্সেলোনায় মঞ্চস্থ হয় তাঁর নাটক ‘মারিয়ানা পিনেদা’– যা দর্শকদের বিপুল প্রশংসা কুড়োয়। এই বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর গীতিমালা ‘কানসিয়োনেস‘।
আমেরিকা ও কিউবায়
১৯২৯- গ্রীষ্মের মাঝামাঝি লোরকা এসে পৌঁছান আমেরিকায়। ঘুরে বেড়ান হার্লেম ও ভের্মন্টে। তিনি ভর্তি হন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (কলম্বিয়া স্কুল অব জেনারেল স্টাডিজ) ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোর্সে। কিন্তু অচিরেই ছেড়ে দিলেন – মনে করলেন ইংরেজি ভাষা শিক্ষা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তিনি মগ্ন রইলেন কাব্য সৃষ্টিতে। কিউবা থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি গেলেন হাভানায়। সেখানে প্রায় দু’মাস কেটেছিল তাঁর। তারপর ফিরে আসেন দেশে। গ্রানাদার কাছে দেশের বাড়িতে খামার ঘেরা পারিবারিক জীবন কাটান তিনি। এটাই ছিল তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে ফলবান সময়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর একের পর এক কবিতা।

পরিবারের সাথে লোরকা।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন: রিপাবলিকান সরকার প্রতিষ্ঠা
১৯৩১-এ স্পেনে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানুয়েল আজানার নেতৃত্বে সাধারণতন্ত্রী (রিপাবলিকান) সরকার। এই সরকার অতি দ্রুত বিভিন্ন প্রগতিশীল কর্মসূচি রূপায়ণের চেষ্টা করে। ডাক পড়ে প্রগতিচিন্তাধারার কবি ও নাট্যকার লোরকার। তিনি যে পরিকল্পনা পেশ করেন তা গৃহীত হয়। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁকে নাট্য বিষয়ক সংস্থা ‘লা বারাকা’ র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন তাঁর নাট্যদলের অভিনেতা-অভিনেত্রী। লোরকা তাঁর এই নাট্যদল নিয়ে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে নাটক দেখাতেন, সংগ্রহ করে আনতেন লোকজ ঐতিহ্যের সম্পদ। স্পেনীয় ধ্রুপদি নাট্যকারদের নাটক যেমন অভিনয় করতেন, তেমনি তাঁর স্বরচিত নাটকও সফলভাবে অভিনীত হতো। বিশেষ করে তাঁর নিজের নাটক ‘বোদাস দে সাংগ্রে’ বা ‘শোণিত পরিণয়’, ‘ইয়েরমা‘ বা ‘বন্ধ্যা’ ও ‘লা কাসা দে বেরনার্দা আলবা’ বা ‘বেরনার্দা আলবার বাড়ি’। কাব্যগুণে সমৃদ্ধ এই নাটকগুলিতে বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। স্পেনে সাধারণতন্ত্রী সরকারের নানা প্রগতিশীল কর্মসূচি রূপায়ণে শঙ্কিত হয়ে ওঠে দক্ষিণপন্থীরা। শুরু হয় চক্রান্ত।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা
দক্ষিণপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি – পপুলার ফ্রন্ট গঠন– গৃহযুদ্ধ
১৯৩৩ -এর নির্বাচনে দক্ষিণপন্থীরা ফের শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু তাদের নীতি ও কার্যকলাপের ফলে দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ-ধর্মঘট ইত্যাদি শুরু হয় । এই অবস্থায় ১৯৩৬ সালে রাষ্ট্রপতি জামোরা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানান। এই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে প্রজাতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টদের জোট ‘পপুলার ফ্রন্ট’। কিন্তু বিরোধীপক্ষ অর্থাৎ দক্ষিণপন্থীরা প্রথম থেকে এই পপুলার ফ্রন্টের বিরোধিতা করতে থাকে। দেশের নানা প্রান্তে বিক্ষোভ শুরু করে। পপুলার ফ্রন্টকে ক্ষমতা থেকে সরাতে স্পেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যুত্থানে সর্বতোভাবে সাহায্য করে মুসোলিনি ও হিটলার।
এমনই এক ঘনঘোর দুর্দিনে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে লোরকা বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কলম্বিয়া বা অন্যত্র চলে যাবার পরামর্শকে উপেক্ষা করে থেকে যান গ্রানাদায়। এর আগেই মাদ্রিদ থেকে চলে এসেছিলেন তিনি। তাঁর ধারণা ছিল তিনি ‘অরাজনৈতিক’ ব্যক্তি বলে তাকে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট বাহিনী কোনো ক্ষতি করবে না। তাছাড়া গৃহযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে ছিলেন তাঁর বন্ধু বান্ধব অনেকেই। কিন্তু তাঁর এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা আঁকা চিত্রকর্ম।
১৯৩৬-এর ১৭ আগস্ট লোরকা ছিলেন তাঁর কবিবন্ধু লুই রোজালেসের বাড়িতে। ১৮ আগস্ট ভোরবেলা তাঁকে ফ্রাঙ্কোর বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। ১৯ আগস্ট তাঁকে গ্রানাদার অদূরে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় জল্লাদ বাহিনী।…..মাত্র আটত্রিশ বছরের এক দীপ্র, হাস্যময় জনপ্রিয় কবি ফ্যাসিস্ট ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন পাহাড়তলীতে, তাঁর মরদেহ গুম করে দেওয়া হলো। আজও কেউ জানলো না কোথায় কবর তাঁর! তবে তাঁর হারিয়ে যাওয়া কবি-শরীর কবিসত্ত্বা রূপে ছড়িয়ে পড়লো স্পেনে, স্পেন ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে, গোটা দুনিয়ার মুক্তিকামী, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের লড়াইয়ে; তাঁর কাব্যের ধ্বনি-সৃষ্টির বার্তা অনুরণিত হলো বিপ্লবীদের চেতনায়-মননে।
প্রসঙ্গত, স্পেনের বৈধ পপুলার ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর ১৯৩৬ সালের ২০ নভেম্বর ফ্যাসিস্ট বর্বরতাকে প্রতিহত করার জন্য মনীষী রমাঁ রলাঁ বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান। বিশ্বের প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীরা তারই পরিপ্রেক্ষিতে ‘ লিগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার’ গড়ে তুলে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ মঞ্চ গঠন করেন। এই পরিস্থিতির অনুষঙ্গে ক্রিস্টোফার কডওয়েল, ফ্যাসিলিয়া ব্রাউন, র্যালফ ফক্স, মিগেল এরনানদেস, মাথে জালকা প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী স্পেনের রণাঙ্গনে লড়াই করে প্রাণ বিসর্জন দেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন কলকাতায়। স্পেনে ফ্যাসিস্টদের অমানুষিক বর্বরতায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হন এবং ফ্যাসিস্ট বর্বরতার তীব্র নিন্দা করে স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে সাহায্যের জন্য তাঁর দেশবাসীর কাছে আবেদন জানান। এদিকে ১৯৩৭ সালের মার্চে গড়ে ওঠে ‘লিগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার’– এর সর্বভারতীয় কমিটি। এই কমিটির সভাপতির পদে বৃত হন রবীন্দ্রনাথ। এই বীভৎসতার বলি হন অন্তত ছয় লক্ষ (মতান্তরে দশ লক্ষ) মানুষ। এ এক বিস্তৃত প্রসঙ্গ, যা আলোচনার অবকাশ নেই এখানে।

ছোট বোন ইসাবেলার সাথে লোরকা।
সৃষ্টির ভুবনে
স্পেনের জল, মাটি, নিসর্গ, লোকসংস্কার, গাথা-গীতিকা, গ্রাম-গঞ্জ, যৌবন-প্রেম-মৃত্যুচেতনা, ষাঁড়ের লড়াই, উৎসব-ব্যসন ইত্যাদি মিলে-মিশে নতুন আঙ্গিকে উঠে এসেছে লোরকার কবিতায়। তিনি ‘বিদায়’ শীর্ষক কবিতায় উচ্চারণ করেছেন–
“মৃত্যু ঘনিয়ে এলে
ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।
দোহাই।
ছেলেটা কমলালেবু খাচ্ছে।
আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।
চাষি কাস্তে দিয়ে ফসল কাটছে।
আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট শোনা যায়।
মৃত্যু ঘনিয়ে এলে
ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।
দোহাই আপনার।”
(অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত)
তাঁর কবিতায় প্রকৃতিপ্রেম যেভাবে বাঙ্ময় হয়েছে—
“সবুজ, সবুজ, আমি তোমাকে ভালোবাসি,
ও সবুজ।
সবুজ হাওয়া,সবুজ গাছগাছালি।
সাগরে জাহাজ,পাহাড়ে ঘোড়া।
ছায়ার কোমরবন্ধ—খোলা বারান্দায় বসে স্বপ্ন দেখা–
…..
ওপরে জিপসি চাঁদ
নিচে সবাই চেয়ে তার দিকে
অথচ কারো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার
সবুজ, সবুজ,আমি তোমাকে ভালোবাসি,
ও সবুজ।”….
(‘ঝিম ধরানো গান’, অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত)
আরেকটি কবিতায় লোরকার অনুভব প্রকাশ পেয়েছে এভাবে–
“প্রতিটি গান হলো
জমাটবাঁধা ভালোবাসা।
প্রতিটি নক্ষত্র
জমাটবাঁধা সময়।
সময়ের একটি গ্রন্থি।
প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস
জমাটবাঁধা আর্তনাদ।“
(‘প্রতিটি গান’, অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত)
লোরকার আকাঙ্ক্ষা -অভিব্যক্তি যেভাবে আমরা ফুটে উঠতে দেখি তাঁর কবিতায়–
“যা খুঁজে বেড়াচ্ছি, না পেলেও, কোনো
অভিযোগ করব না আমি।
রসহীন পাথর আর ফাঁকাফুঁকো কীটপতঙ্গের কাছে
আমি সূর্য আর জীবন্ত কাঁচা মাংসের দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখতে যাবো না।
কিন্তু যাব সংঘাতমুখর প্রথম প্রকৃতি চিত্রের কাছে
মর্মর ধ্বনির কাছে, নবজাতকের কাছে এবং যেখানে
বাইরের প্রচ্ছদ এড়িয়ে যেতে হচ্ছে, বোঝার জন্যে–
যা খুঁজে বেড়াচ্ছি তা যেন আমায় আনন্দ দেয়
ভালোবাসা আর বালিতে-মেশা আমি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি।”….
(‘যা খুঁজে বেড়াচ্ছি’, অনুবাদ: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
লোরকা তাঁর কবিতার মতোই একই মেজাজে আন্দালুসীয় কৃষক জীবন ও নারীত্বের ক্ষোভকে তাঁর কাব্যনাট্য ও নাটকে অদ্ভুতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নাটকগুলি হলো, ”এল ম্যালেফিসিও দে লা মারিপোসা’, দ্য শুমেকার্স প্রডিজিয়াস ওয়াইফ’, ‘মারিয়ানা পিনেদা‘, ‘অ্যাজ ফাইভ ইয়ার্স পাস’, ‘দ্য পাবলিক’, ‘দ্য লাভ অফ দোন পেরলিম্পলিন অ্যান্ড বেলিসা ইন দ্য গার্ডেন, ‘ব্লাড ওয়েডিং‘, ‘দোনিয়া রোসিতা দ্য স্পিনস্টার’ ইত্যাদি।

নাট্য বিষয়ক সংস্থা ‘লা বারাকা’ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোরকা।
প্রতিবাদে-আন্দোলনে
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা শুধু স্পেনের কবি নন, সমগ্র পৃথিবীর সব মানুষের কবি। তিনি সরাসরি রাজনীতিতে আসেননি, কিন্তু একজন মননশীল মানুষের যে সামাজিক ভূমিকা তা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তিনি জার্মান জনগণ ও নাৎসি নিপীড়নের প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, ব্রাজিলের কমিউনিস্ট নেতা কার্লোস প্রেস্তেসের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন,আবার আন্তর্জাতিক রেড এইড সংস্থার আহ্বানে প্রতিটি কর্মসূচিতে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।
প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পৃক্ততা। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো – ব্যাপক জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনাকে খুঁজে পাওয়া যেত তাঁর কবিতার শরীরে, নাটকের চরিত্রে, ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা তাঁর ছবির মধ্যে। যে সময়ে গোটা ইউরোপ জুড়ে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, সেই সময়ে একের পর এক নাটকে অথবা গাথার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক কাহিনির সূত্রে লোরকা অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে, কখনো রোমান্টিক জিপসি একনায়কতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রোথিত করে দিয়েছেন তাঁর অনুরাগী দর্শকদের মধ্যে।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা
ফ্যাসিস্ট শক্তি লোরকাকে হত্যার অপরাধ স্খালন করতে তাঁর বিরুদ্ধে নানা কুৎসা করতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সাতাশি বছর পরেও সারা পৃথিবীতে তাঁর কাব্য প্রতিভা, জনপ্রিয়তা এবং শ্রদ্ধার আসন এতটুকু টলেনি, বরং উত্তরোত্তর প্রসারিত হয়েছে।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, লোরকা মৃত্যুর কয়েক বছর আগে যে কবিতাটি রচনা করেছিলেন, তার কয়েকটি পঙ্ ক্তি যেন তাঁর জীবনের অন্তিম পরিণতির সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়—
“আমি বুঝতে পারছি খুন করা হয়েছে আমাকে।
তারা কাফে,কবরখানা আর গির্জাগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজছে
তারা সমস্ত পিপে আর কাবার্ডগুলো তছনছ করছে।
তিনটে কঙ্কাল লুট করে খুলে নিয়ে গেছে সোনার দাঁত।
আমাকে তারা খুঁজে পায়নি।
কখনোই কি পায় নি তারা?”….
(‘লোরকার শ্রেষ্ঠ কবিতা’, অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত ও কবিতা সিংহ)
এই ঘটনার কয়েক বছর পর, স্পেনের রণাঙ্গনে ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে’র সদস্য হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রকর্মী,বিশেষকরে বিশ্বখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা যে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের স্মরণে ভারতের স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে, অখণ্ড বাংলার ঢাকায় একটি কবিতা রচনা করেছিলেন তরুণ কমিউনিস্ট লেখক সোমেন চন্দ। তাতে অন্যান্যদের সঙ্গে উল্লেখ ছিল লোরকার নাম ! তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছিল এই অসামান্য পঙ্ ক্তি—
“র্যালফ ফক্সের নাম শুনেছো?
শুনেছ কডওয়েল আর কর্নফোর্ডের নাম?
ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কথা জান?
এই বীর শহিদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে দিল,
সবুজ জলপাই বন হল লাল,
মা-র বুক হলো খালি—
তবু বলি,সামনে আসছে শুভদিন।
চলো,আমরাও যাই ওদের রক্তের পরশ নিতে,
ওই রক্ত দিয়ে লিখে যাই
শুভদিনের সঙ্গীত।“
কী অদ্ভুত সমাপতন ! সাম্যবাদী তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ বিপ্লবী আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে একদিন যে কবিতা রচনা করেছিলেন, সেটিই পরবর্তীতে ভয়ংকর সত্যের চেহারা নিয়ে নিয়ে তাঁর জীবনেই উদয় হয়েছিল! তাঁকেও ঢাকার রাস্তায় বর্বরোচিতভাবে খুন হতে হয়েছিল (৮ মার্চ, ১৯৪২) ফ্যাসিস্ট সমর্থকদের দ্বারাই! অসামান্য প্রতিভাধর তরুণ কমিউনিস্ট লেখক সোমেন চন্দ তাঁর মতাদর্শকে উড্ডীন রাখার জন্য মাত্র বাইশ বছরে শহিদ হলেন, তবুও এই অকাল মৃত্যুর মধ্যদিয়ে যেন বিপুল সমারোহে তিনি সজীব হয়ে উঠলেন।
স্পেনের অনন্য প্রতিভাধর কবি, নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক অভিনেতা, চিত্রশিল্পী ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে খুন করে ফ্যাসিস্টরা ভেবেছিল গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামীদের স্বপ্নকে চিরতরে বিলীন করে দেবে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে – লোরকারা মৃত্যুঞ্জয়ী, তাঁদের স্বপ্ন অবিনাশী। মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তাঁদের জীবন ও সৃষ্টির আলোকপ্রভা আরও প্রদীপ্ত হয়েছে, তাঁদের আসন স্থায়ী হয়েছে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রপ্রিয়, মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে, বিপ্লবীদের চেতনায়।
অপরাজেয় জীবনশিল্পী, বিপ্লবী চেতনার প্রতীক ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার ১২৫ তম জন্মবার্ষিকীতে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের মধ্য দিয়ে জ্ঞাপন করি অনন্ত শ্রদ্ধা ও বিপ্লবী অভিবাদন।
লেখক:
সন্দীপ দে, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত এ লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা