মেজর জলিলের বীরত্ব পায়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি । ফরিদ আহমেদ

Comments
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের সুবিধার্থে সমস্ত বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো। একটা বাদে এর সবগুলোতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। যে সেক্টরটা বাদ গিয়েছিলো সেটা হচ্ছে দশ নম্বর সেক্ট্র। এটা ছিলো নৌ সেক্টর। সারাদেশব্যাপী ছিলো এর যুদ্ধক্ষেত্র। যে কারণে এই সেক্টরে কোনো সেক্টর কমান্ডার দেওয়া হয়নি। নৌ যোদ্ধারা যখন যে সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, সেই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের আওতায় থেকেছেন তাঁরা।

এই দশটা সেক্টরে সর্বমোট আঠারোজন সেক্টর কমান্ডার নানা সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরে এদের সবাই-ই রাষ্ট্রীয় বীরত্বসূচক উপাধি পেয়েছেন। একজন শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি হচ্ছেন মেজর এম এ জলিল। নয় নম্বর সেক্টরের সর্বাধিনায়ক ছিলেন তিনি। এপ্রিল মাসের সতেরো তারিখে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। ওইদিনই এগারোটা সেক্টর গঠন এবং সেক্টর কমান্ডারদের নাম ঘোষিত হয়। সেই প্রথম দিন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি এই সেক্টরের প্রধান হিসাবেই কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব নিয়েও কোনো সংশয় নেই। কিন্তু, তারপরেও কোনো পদক তাঁকে দেওয়া হয়নি। এটা বেশ আশ্চর্যজনক এক ঘটনা।

এই আশ্চর্যজনক ঘটনার পিছনের কারণ নিহিত রয়েছে ভিন্ন একটা জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবার পরে তিনি অদ্ভুত একটা অভিযোগ করেন। তিনি বলেন যে  ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশের সম্পদ এবং পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। ৩১শে ডিসেম্বর যশোরে লুটের মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িবহরকে আটকে দেন তিনি। এই অপরাধে তাঁকে বন্দি করা হয়। যশোর সেনানিবাসের এক নির্জন প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হয় তাঁকে। তাঁর বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। সেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন আরেক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের। কর্নেল তাহের তাঁকে সসম্মানে মুক্ত করে দেন। পাঁচ মাস ছয়দিন বন্দি থাকার পরে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে তিনি মুক্তি পান। এ বছরের অক্টোবর মাসেই জন্ম নেয় নতুন এক রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে রাজনীতিতে নামের মেজর (অবঃ) জলিল। সদ্য স্বাধীন দেশে বিপুল জনপ্রিয় শেখ মুজিবের বিপক্ষে গিয়ে জাসদ এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। দলে দলে তরুণেরা তখন জাসদে যোগ দিয়েছিলো এর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আকর্ষণে পড়ে। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো জাসদ। তবে, একটা সময়ের পরে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে যেতে থাকে। গড়ে তোলে সশস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি গণবাহিনী। শুরু করে নাশকতার কাজ। এতে করে সুবিধা হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের। তারা প্যারামিলিটারি ফোর্স রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করে গণবাহিনীর হামলা রুখতে। কথিত আছে রক্ষীবাহিনীর হাতে জাসদের প্রায় বিশ হাজার তরুণ প্রাণ হারিয়েছিলো।  তো, এই রকম একজন ব্যক্তি, যিনি যুদ্ধের সময়ে ভারত বিরোধী ভূমিকা নিয়েছেন, স্বাধীন হবার পরে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তিনি যে রাষ্ট্রীয় বীরত্বসূচক খেতাব পাবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

ভারতীয়দের হাতে আটক হওয়া মেজর জলিলের জন্য এটা প্রথম নয়। যুদ্ধের সময়েও তিনি আটক হয়েছিলেন ভারতীয়দের হাতে। যুদ্ধ শুরুর আগে মেজর জলিলের কর্মস্থল ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে এক মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে আসেন অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও টালমাটাল ওই  রাজনৈতিক সময়ে তিনি কর্মস্থলে ফেরত যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। পাকিস্তান আর্মি স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র মানুষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে মার্চের ছাব্বিশ তারিখে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এপ্রিলের ২৪ তারিখ পর্যন্ত তিনি বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চলকে মুক্ত অঞ্চল হিসাবে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। এর মধ্যে তাঁকে নয় নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি তাঁর সেক্টরকে কয়েকটা সাব সেক্টরে ভাগ করে এপ্রিলের একুশ তারিখে কয়েকটা মোটর লঞ্চ নিয়ে সুন্দরবন হয়ে ভারতের দিকে রওনা দেন। উদ্দেশ্যে ছিলো ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা। ভারতে প্রবেশের পর বিএসএফের কমান্ডার মুখার্জী তাঁকে নিয়ে যান ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। সেখানে ছিলো লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অফিস। জেনারেল অরোরার তাঁকে শুরুতে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ফলে, সাক্ষী প্রমাণ দাবি করলেন। মেজর জলিল তখন রেফারেন্স হিসাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর রেফারেন্স দিলেন। জেনারেল অরোরা এই দু’জনকে ব্লাডি র‍্যাট হিসাবে গালি দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে এঁদের কোনো গুরুত্ব তাঁর কাছে নেই। অন্য সাক্ষী দাবি করলেন তিনি। দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের সম্পর্কে এমন অবজ্ঞার কথা শুনে মেজর জলিলও তাঁকে জানিয়ে দিলেন ভারতের অস্ত্রের তাঁর প্রয়োজন নেই। শূন্য হাতে দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ করে মারা যাবেন, তবুও অস্ত্রের জন্য তাঁর কাছে আসবেন না। মেজর জলিলের এই বিদ্রোহী ভূমিকা দেখে চমকে ওঠেন জেনারেল অরোরা। তিনি তাঁকে আটকে রেখে পাকিস্তান আর্মি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেন। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে চারদিন আটক থাকার পরে জেনারেল জ্যাকবের কারণে মুক্তি পান তিনি। জেনারেল জ্যাকবের কাছে তাঁকে বিশ্বস্ত মনে হয়েছিলো।

সেই তখন থেকেই মেজর জলিলের মধ্যে এই ধারণা ঢুকে যায় যে ভারত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহের চেয়েও তথ্য সংগ্রহের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। মেজর জলিল তাঁর ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ বইতে লিখেছেন, “ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তি যোদ্ধাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করার আগ্রহ প্রদর্শন যা করেছে তার তুলনায় অধিকতর উৎসাহ এবং আগ্রহ প্রদর্শন করেছে তথ্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র প্রদান নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জরুরী তথ্য সংগ্রহই ছিল যেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মূল উদ্দেশ্য।”

মেজর জলিলের ভাষ্যে ভারত শুরু থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপরে কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করেছে। কোলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশের অফিস থাকলেও ক্ষমতার সকল উৎস ছিলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কর্নেল ওসমানী একজন সম্মানিত বন্দির’ জীবন যাপন করা ছাড়া আর কিছু করতে পারেন নাই। নভেম্বরের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শিবিরগুলোর দায়িত্বও সরাসরি নিতে চেষ্টা করে তারা। মেজর জলিলের সেক্টরে এই কাজ করা সহজ ছিলো না। তারপরেও ট্রেনিং শিবিরগুলোতে ভারতীয় অফিসার নিয়োগ করেছিলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ট্রেনিং শিবিরের অস্ত্রগুলোও প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। এইসব অস্ত্র সব যে ভারতীয়দের দেওয়া ছিলো তা নয়। অনেক অস্ত্রই বাংলাদেশ সরকার কিনেছিলো। ফলে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করে মেজর জলিল সেগুলো ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, নৌ কমান্ডো নূর মোহাম্মদ বাবুল, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর এবং নৌ কমান্ডার বেগের মাধ্যমে লঞ্চে করে বাংলাদেশের ভিতরে নিয়ে আসেন।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে মেজর জলিল তাঁর বইতে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছেন, সেগুলো পড়লে অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন যে তিনি হয়তো ভারত বিদ্বেষী ছিলেন। বাস্তবে সে রকম কিছু নয়। তিনি ভারতের অনেক অলাভজনক সংস্থা এবং ব্যক্তিরই অকপট প্রশংসা করেছেন। এঁরা নিঃস্বার্থভাবে প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে অস্ত্র এবং রসদের সাপ্লাই দিয়েছেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ দুই বিপরীত মেরুতে বিভক্ত। একদল মনে করে ভারত তাদের নিজের স্বার্থেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে একে শক্তিহীন করা। এই অংশটা যে পাকিস্তান ভাঙায় অখুশি, তা নয়। তবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতাকে তারা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড বলেই বিবেচনা করে থাকে। যে কারণে এরা ভারতের প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে রাজী হয় না। এর বিপরীতে আরেকটা অংশ আছে যারা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতায় একেবারে নুয়ে থাকে সারাক্ষণ। এদের ধারণা হচ্ছে ভারত সাহায্য না করলে বাংলাদেশ স্বাধীনই হতো না। ফলে, উঠতে বসতে ভারতকে নমস্কার জানায় তারা। এই দুই বিপরীত মেরুর বাইরে গিয়ে ভারতের ভূমিকাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে আজ পর্যন্ত কেউ বিশ্লেষণ করে নাই। অবশ্য এই কাজটা সহজ কোনো কাজ নয়। আমরা নৈর্ব্যক্তিকভাবে কোন কিছু ভাবতে কিংবা চিন্তা করতে কিছুটা অক্ষমই বলা চলে। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কিংবা শত্রুতা, দু’টোই সাধারণত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। এক রাষ্ট্র যদি আরেক রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, তবে বুঝতে হবে সেখানে ভালবাসা কিংবা আবেগের চেয়েও স্বার্থবিন্দু এক জায়গাতে মিলে  যাওয়াটাই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। জনগণের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টা ভিন্ন। তারা সত্যি সত্যি আবেগ দেখায়। যেমনটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বা আসামের মানুষেরা। নিজেদের অনেক অসুবিধা করেও তারা আমাদের সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছে আন্তরিকভাবে।

মেজর জলিল তাঁর বইতে শুধুমাত্র ভারতেরই সমালোচনা করেন নাই। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদেরও ধুয়ে দিয়েছেন তাঁর বইতে। এরা কোলকাতাতে গিয়ে বিলাস-ব্যসনে জীবন কাটাতো। মদ এবং মেয়েমানুষ ছিলো তাদের নিত্য সঙ্গী। কোলকাতার অভিজাত এলাকার হোটেল এবং রেস্টুরেন্টগুলোতে জমজমাট আড্ডাতে ব্যস্ত থাকতো তারা। প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা কী রকম মানবেতর অবস্থায় বসবাস করছে, সে সম্পর্কে কোনো ধরনের খোঁজখবরই তারা রাখতো না। শরণার্থী শিবিরে এলেও এদের মূল লক্ষ্য থাকতো আশ্রয়হীন হিন্দু তরুণীদের দিকে। এদেরকে কোলকাতায় চাকরি দেবার নামে নিজেদের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত করতো তারা।

আহমদ ছফা তাঁর ‘অলাতচক্র’ বইতেও এইসব বিলাসী এবং বদমাশ লোকদের সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের কিছু কথা বলেছিলেন। যদিও সেটা উপন্যাস, তারপরেও  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়কার কোলকাতার একটা চিত্র আমরা সেখানে পাই। ছফা তাঁর বইতে লিখেছেন, “একেকজন লোক ভারত সরকারের অতিথি হিসাবে এখানে জামাই আদরে দিন কাটাচ্ছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া, ফুর্তি করা, কোনো কিছুর অভাব নেই। আরেক দল বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে সোনা লুট করে কলকাতা এসে ডেরা পেতেছে। আবার অনেকে এসেছে বিহারিদের পুঁজিপাট্টা হাতিয়ে নিয়ে। আপনি, এই কলকাতা শহরের সবগুলো বার, নাইট ক্লাবে খোঁজ করে দেখুন। দেখতে পাবেন ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশের মানুষ দুহাতে পয়সা ওড়াচ্ছে।

এইসব দ্বিতীয় শ্রেণীর নেতাদেরই শুধু নয়, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরাও মেজর জলিলের সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পান নাই। তিনি কোলকাতার বালিগঞ্জের যে বাড়িতে মন্ত্রীসভার লোকজন থাকতো, সেখানে গিয়ে মন্ত্রীসভার সদস্যদের বেকার যুবকদের মতো গড়াগড়ি  করে তাস খেলতে দেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর বইতে।

একাত্তরের যুদ্ধটা মূলত ছিলো আমাদের সাথে পাকিস্তানের। ভারত একেবারে শেষভাগে এসে যুদ্ধে জড়ায়। কিন্তু ষোলই ডিসেম্বরে পাকিস্তান বাহিনী যে আত্মসমর্পণ করে ঢাকায়, সেই রঙ্গমঞ্চে বাংলাদেশ ছিলো অনুপস্থিত। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক থেকে গিয়েছিলেন কোলকাতায়। এ নিয়েও মেজর জলিলের তীব্র সমালোচনা রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর কাছে পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন না কেন? আত্মসমর্পণের বেশ কয়েকদিন পরে কর্নেল ওসমানী ঢাকায় এলেন কেন? এ সময়কার তিনি কোথায় ক্ষেপণ করেছেন? তিনি কি তাহলে সত্যিই কোলকাতায় বন্দী ছিলেন?’

ভারতীয় বাহিনী শুধু ঢাকার মূল মঞ্চ থেকেই যে বাংলাদেশকে সরিয়ে রেখেছিলো তা নয়, আঞ্চলিক এলাকাগুলোতেও তারা একই কাজ করেছে। ডিসেম্বরের সতেরো তারিখে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। নবম সেক্টরের প্রধান হিসাবে তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু, ভারতীয়রা তাঁকে সম্মুখ সারিতেই আসতে দেয়নি। বার বার প্রচেষ্টা নিয়ে তিনি সামনে আসতে চাইলেও ভারতীয়রা সেটা করতে দেয়নি। মেজর জেনারেল দালবীর সিং আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন।

শুরুতেই বলেছি, আমাদের সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে মেজর জলিলই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনো বীরত্বসূচক উপাধি পাননি। অথচ, এই সেক্টরটা আয়তনে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেক্টর ছিলো। শুধু যে বীরত্বের উপাধি থেকেই তিনি বঞ্চিত হয়েছেন, তা নয়। তিনি বিস্মৃতির আড়ালেও হারিয়ে গিয়েছেন। এই বঞ্চনা এবং বিস্মৃতির পিছনে তাঁর নিজের দায়ও কম নয়। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি রাজনীতি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিলো বামপন্থা। তাঁর দল জাসদ একটা সময়ের পরে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গড়ে তোলে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি গণবাহিনী। এরা পঁচাত্তর সালে সশস্ত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে গিয়েছিলো। যদিও সেটা কাউন্টার প্রডাক্টিভ হয়। তাদের সেই বিপ্লব ছিনিয়ে নিয়ে যান জেনারেল জিয়াউর রহমান। মেজর জলিল এবং গণবাহিনীর গোপন কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে বন্দি করে বিচার করা হয়। বিচারে দুইজনেরই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিলো। পরে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা বিবেচনা করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

১৯৮০ সালে তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুক্ত হবার পরে বিয়ে-শাদি করে সংসার জীবন শুরু করেন তিনি। এই সময়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনাতে আমূল পরিবর্তন আসে। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত এক দিকে ধাবিত হয়।  ১৯৮৪ সালে জাসদ পরিত্যাগ করেন তিনি। ইসলামি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। জাসদ থেকে পদত্যাগের কয়েকদিনের মধ্যেই ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামের একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেন। চরম ডানপন্থী হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। সহজ ভাষায় একদা বাম নেতা পরিণত হন একজন ডানপন্থী নেতাতে।

মেজর জলিলের এই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান পরিবর্তন তাঁর জন্য কাল হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো দলই এখন আর তাঁকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না। বামপন্থীরা তাঁকে অস্বীকার করে, ডানপন্থীরাও তার বিষয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস দেখায় না। কারণ, তাদের সঙ্গে তিনি বেশিদিন ছিলেন না। ডানপন্থায় ঝোঁকার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর অকালমৃত্যু হয়। মধ্যপন্থীদেরও কোনো আগ্রহ নেই তাঁর বিষয়ে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়ে তিনি যে সব জরুরী প্রশ্নের অবতারণা করে গিয়েছিলেন, সেগুলোরও কোনো আলোচনা হয় না। যদিও ডানপন্থীরা, যারা ঐতিহাসিকভাবেই ভারত-বিদ্বেষী, তারা মাঝে মধ্যে এই প্রশ্নগুলো তুলে নিয়ে আসে। তবে, সেটা যতোটা না সমাধান পাবার আশায় করা হয়, যতোটা না মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভুমিকার নির্মোহ বিশ্লেষণ করার তাগিদে করা হয়, তার চেয়ে বেশি করা হয় ভারতকে ঘৃণা করার মন-মানসিকতা থেকে।

লেখক:
Farid Ahmed
ফরিদ আহমেদ, প্রবাসী, প্রাক্তন শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

*প্রকাশিত এ লেখার মতামত এবং বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা বানানরীতি বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট