কেমোথেরাপির দিন – ১
করোটিতে ঝিনুকের ঝাঁক
জীয়ল মাছের মতো ঘাই মেরে গেল কিছুকাল
নিবিড় বন্ধুর মতো আচ্ছাদিত করে আছে
আরোগ্য নিকেতন
যাবতীয় অসুখ শুষে নিয়ে নীলকণ্ঠ হবে
পাল্লা দিচ্ছে অহর্নিশ কর্কট আক্রমণের সাথে
কিংবা হাসপাতালের গায়ে তাই নীল রঙ মাখিয়ে দিয়েছে কবির বন্ধুরা
একজোট
দিগন্তে মুছে গেছে আপাতত অসুখের ক্রোধে ভরা সিডর আকারের মেঘ
ক্রমশঃ মুছে যাচ্ছে প্রিয়জনদের নৈরাশ্য
উদ্বিগ্নতা
সহিষ্ণুতার সবটুকু কাঁধ মেলে রাখছে পরিবার
২।৯।২০২১

কেমোথেরাপির দিন – ২
শিরায় শিরায় টেক্সটাইল রঙের ওষুধ, যাচ্ছে যাচ্ছে –
আমার দু হাতে শত সহস্র ফুটো নিয়ে
পরদিন অপেক্ষা করি কেমিকেল রঙের ইনজেকশন ফুটিয়ে দিবে ‘শুভ্র পোশাকের নার্স’,
‘সিরিঞ্জভরা দুঃখ’গুলো ফুটিয়ে দিবে
অপরাহ্ণে।
প্রিয়তমা অফিসে, কন্যা অদূরে ল্যাপটপে – অফিস চলছে, কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে যায় :
কষ্ট হচ্ছে?
প্রিয়তমা ফিরে আসে
দু চোখে বুঝিবা আইসিইউ’র সম্ভাবনাময় ভীতি লুকিয়ে
রঙিন বিষাক্ত শিরাময় সালসার
অবাধ প্রবাহের অন্তিম দিন গোনে।
স্বাদ গন্ধহীন, প্রায় চলৎশক্তিহীন
অলস বেদনার দিন
ভোরবেলা নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দিন
হাসপাতাল আর ঘরে দৌড়াদৌড়ির সাফা- মারওয়ার দিন;
হায় দিন!
[ শুভ্র পোশাকের নার্স আর সিরিঞ্জভরা দুঃখ কবি শাহিদ আনোয়ারের সুপরিচিত কবিতার শব্দবন্ধ ]
৬।১০।২০২১

কেমোথেরাপির দিন – ৩
আবার নিম্ন রক্তচাপের ভার্টিগো, শিহরণ
অসহায় শয্যাশায়ী;
কখনো মাথা নেড়ে নেড়ে
অকুস্থল থেকে মুক্তির চেষ্টা।
প্রিয়জনের কথাবার্তা, উৎকীর্ণ ডাকাডাকি
দূর নগরীর প্রতিধ্বনি – ভয়কে জয় করেছি কনিষ্ঠা কন্যার মুখ দেখে।

কেমোথেরাপির দিন – ৪
শ্রাবণ তুমুল
আমার জানালায়
বাগান তো নিষিদ্ধ
বারান্দাও অগম্য প্রায়
পোষা বিড়ালেরা
পরিত্যক্ত
সংক্রমণের ভয়ে
বন্ধুরাও বিচ্ছিন্ন
কত যুগ
কবিতাও জটলা করে না
এই শ্রাবণের জানালায়

কেমোথেরাপির দিন – ৫
এম্বুল্যান্স থেমে গেল যানজটে
পুলিশ নির্বাক এই নিশ্চল জটাজালে
কখন ভিড়বে তরী কখন শ্বাস
স্ট্রেচারে ঊর্ধমুখ বেদনার নীল

কেমোথেরাপির দিন – ৬
বলতে হয়, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাময় দিন;
বলতে হয়, ফি আমানিল্লাহ!
দীর্ঘদিন কথা বলতে না পেরেও
শিখে নিয়েছি কত সামাজিকতা
বাদলা হাওয়ায়
অসুখ – বিসুখের দিনে

কেমোথেরাপির দিন – ৭
প্রতিদিন ফটোকপির ভিড়ে একদিন পার্বন আসে,
স্বজনের অপেক্ষায় ছাদের বৃষ্টিস্নাত খাটিয়ায় বসে থাকি।
নতুন ফতুয়া গায়ে। কন্যারা এলো ঝলমল করতে করতে।
আকাশভরা চাঁদ, বুকভরা জ্যোৎস্না।
২৬।১০।২০২১

কেমোথেরাপির দিন – ৮
পারদে তো আর জ্বর দেখা যাচ্ছে না।
মৃত্যুঘোরমাতাল জ্বরমুক্ত হতে হতে ভাবছি
পৃথিবীর জ্বর কবে নেমে যাবে!
২৭।১০।২০২১

কেমোথেরাপির দিন – ৯
নিঃস্ব ধমনিতে জন্ম নিচ্ছে রক্তকণিকা –
আপাদমস্তক বেরসিক ধোপার মোচড়ে অবশ ব্যথাতুর;
বলেছিলাম বটে খালি আছে সন্ধ্যাটা –
হায়! এমনি করেই অসুখ আমাদের মিথ্যাবাদী বানায়!
নিঃস্ব ধমনিতে শুনি রক্তকণিকার গান।
২৯।১০।২১

কেমোথেরাপির দিন – ১০
(ওমর ফারুককে)
বেঁচে থাকা ডিমের এলবুমিনে,
বেঁচে থাকা দু একটা উজ্জীবিত সন্ধ্যায়
আন্দরকিল্লা মোড়ে যৌবনের অশ্বারূঢ়কে খুঁজে পেয়ে।
বেঁচে থাকতেও সাহস লাগে: দুরারোগ্য মাড়িয়ে যাও!
রোজ সকালে শপথ লাগে: আজকে আরো দুই কদম!
৩১।১০। ২০২১

লেখক:
মোশতাক আহমদ, কবি, গদ্যকার ও গণস্বাস্থ্য কর্মকর্তা