“তোমার মৃত্যুতে পৃথিবীর তিন ভাগ জল অশ্রু হয়ে গেছে, রাজপথ হয়েছে আজ সাহসী মিছিল”।
বসু ভাইকে (রাউফুন বসুনিয়া) উদ্দেশ্য করে সাড়াজাগানো এই উক্তিটি সেইদিন বিদীর্ণ করে দিয়েছিল সবার হৃদয়কে।
১৩ ফেব্রুয়ারি, তাঁর মৃত্যু দিবসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
বেশ কিছুদিন আগে অফিসে যাবার পথে মুহসিন হল মাঠের দক্ষিণপূর্ব কোনায় বসু ভাইয়ের আবক্ষ মূর্তিটা দেখে মনে পড়লো সেই দিনের হৃদয় বিদারক ঘটনাটি।
আর স্মৃতির মনিকোঠায় ভেসে উঠলো খুবই কাছ থেকে দেখা ছাত্র রাজনীতির, এমন কি জাতীয় রাজনীতির সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাবলী যা বলে শেষ করা যাবে না।

বন্ধুদের সাথে রাউফুন বসুনিয়া, বাঁ থেকে তৃতীয়। ছবি সৌজন্য: প্রথম আলো
এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে।
রাত প্রায় ১১টার দিকে বসু ভাইয়ের (বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক, সমাজবিজ্ঞান শেষ বর্ষের ছাত্র) নেতৃত্বে স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটা মিছিল সূর্যসেন হল থেকে বের হয়ে মুহসিন হলের পাশের রাস্তা হয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবোরেটারী স্কুলের সামনে দিয়ে মেইন সড়কে ওঠার মূহুর্তেই সরকার সমর্থক ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’ এর সন্ত্রাসীরা এফ রহমান হল থেকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মিছিলে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে।
একটি গুলি এসে বসু ভাইয়ের বাঁ চোখের উপরে কপাল ভেদ করে মাথার বাঁ দিক দিয়ে বের হয়ে যায় এবং স্পটেই মারা যান তিনি।
সাথে সাথে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ওনার লাশটি ঐখানে ফেলে রেখে।
এদিকে মিছিলে থাকা ‘বাসদ’ এর রানা ভাই (প্রয়াত) দৌড়ে এসে মুহসিন হল গেইটে অবস্থানরত ছাত্রদলের নেতাদেরকে বসু ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটি জানায় ।
ঐ পরিস্থিতিতে উনার লাশটি উদ্ধার করা খুবই জরুরী হয়ে পরে ছাত্রদের কাছে।
ফলে তাৎক্ষণিকভাবে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা নিরু এবং বাবলু’র নেতৃত্বে ছাত্রদলের কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এফ রহমান হলে অবস্থানরত ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’ এর সন্ত্রাসীদেরকে সশস্ত্র কাউন্টার দিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা বসু ভাইয়ের লাশটি উদ্ধার করে মুহসিন হলে নিয়ে আসে। না হলে লাশটি পাওয়া যেত কি না যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।
ঐ সময়টা আমি সূর্যসেন হলে ৫৩৩ রুমে বসে পড়ছিলাম, হঠাৎ নিচ থেকে আমাদের বন্ধু তাহেরের (তাহের চৌধুরী, তৎকালীন জিএস, সূর্যসেন হল ছাত্র সংসদ) চিৎকার শুনলাম: “জাকারিয়া জাকারিয়া, বসু ভাই গুলিতে মারা গেছে, লাশ মুহসিন হলে আছে”।
কথাটা শোনার সাথে সাথে হতভম্ব হয়ে গেলাম, সারাটা শরীর আমার ঠাণ্ডা হয়ে গেল, দুই পা অসাড় হয়ে গেল ভয়ে, কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না তখন।
সবার সাথে আমিও দৌড় দিলাম পাশের ছাত্রাবাস মুহসিন হলের দিকে, গিয়ে দেখলাম ডাইনিং হলের টেবিলের উপরে পড়ে আছে বসু ভাইয়ের নিথর দেহটা।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ঠুর ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো পুরো ছাত্রসমাজ।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে স্বচক্ষে দেখা যেসব মর্মান্তিক মৃত্যু এখনও আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে,তার ভিতর এটি হচ্ছে একটি।
পরদিন সকালে ভিসি স্যারের বাসার লনে রাখা হয় উনার লাশের কফিন।
হঠাৎ দেখলাম একটি মেয়ে এসে তার কফিন জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো যা ছিল খুবই অসহনীয় এবং হৃদয়বিদারক। ওখানে উপস্থিত এমন কেউ ছিল না যার চোখ দিয়ে পানি আসে নাই এই দৃশ্য দেখে।
তারপর দুপুরে অপরাজেয় বাংলার সামনে উনার নামাজে জানাজা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সাধারণ ছাত্ররা প্রচণ্ডভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে প্রতিশোধের স্পৃহায়।
হঠাৎ করে ছাত্রদের একটা বিশাল অংশ ছুটে যায় নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের (জেনারেল এরশাদের ছাত্র সংগঠন) সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল এফ রহমান হলের দিকে এবং ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় হলটিতে, মুহূর্তের মধ্যে।
ঐসময় সম্পূর্ণ হলটি ছিল টিন শেডের। সম্পূর্নভাবে পুড়ে যায় আগুনে লেলিহান শিখায় এফ রহমান হল।
আর বসুনিয়ার মৃত্যু স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে আরও গতিময় করে তোলে সারাদেশের ছাত্র সমাজের কাছে।
‘বসুভাইদের মত সাহসীরা দেশের গণতন্ত্র উত্তরণে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।
অথচ তাঁদের কথা আজ কেউ মনে রাখে না, জানে না তাদের আত্মদানের কথা বর্তমান প্রজন্মের কোন ছেলেমেয়ে। আর জানাবেই বা কে তাদেরকে দায়িত্ব নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে?
এমনকি তার আবক্ষ মূর্তি, শ্বেতপাথরের নামফলক এবং আশেপাশের জায়গাটাও পড়ে আছে সম্পূর্ণ অযত্নে অবহেলায়।
একটু পরিচর্যা করার মত কি কেউ নেই এই বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়?
লেখক:
এম কে জাকারিয়া, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা, লেখক