১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারী, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে ১১ দফা দাবীর মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের (বর্তমানে যা শহীদুল্লাহ হল) ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর সভাপতি আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। যাকে আমরা শহীদ আসাদ নামে চিনি।
আসাদ ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবী নেতা। তিনি একাধারে যেমন ছাত্র আন্দোলন করতেন তেমনি কৃষক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী যে হাট হরতালের ডাক দিয়েছিলেন নিজ বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদিতে সেই হাট হরতালে অংশগ্রহণ করেছিলেন আসাদ। এ কারণে তিনি পুলিশ হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন সেদিন।
তিনি মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই ঢাকায় চলে আসেন। আবারও যুক্ত হন ছাত্র আন্দোলনে ১১ দফার দাবীতে। ১৭ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশ থেকে এগারো দফা বাস্তবায়ন এবং ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ২০ জানুয়ারী গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহবান জানিয়েছিল। এ ধর্মঘট মোকাবিলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তথাপি বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং বেলা ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় দশ হাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি চাঁনখা’র পুলের কাছে তখনকার পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়।
প্রায় ঘন্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বাহাউদ্দিন খুব কাছ থেকে রিভলবারের গুলি ছোঁড়ে আসাদকে লক্ষ্য করে এবং আসাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।
হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী মেডিক্যাল কলেজের দিকে ছুটে আসে। বেলা ৩টায় কোনো রকম প্রস্ত্ততি ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় একটি বিরাট শোক মিছিল। মেয়েদের নেতৃত্বে এ মিছিল অগ্রসর হতে থাকলে সাধারণ জনগণও এতে যোগ দেয়। আসাদের মুত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বের হওয়া প্রায় দুমাইল দীর্ঘ মিছিলটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।
আসাদের এই মৃত্যুর খবর দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা দাবীর স্বপক্ষে এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও রাজবন্দীদের মুক্তি দাবীর যে আন্দোলন চলছিল সে অবস্থায় আসাদের মৃত্যু সবাইকে প্রচন্ড নাড়া দেয়। আসাদের মতো বিপ্লবী ছাত্রনেতাকে হত্যার ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন একটি অন্য স্তরে উন্নীত হয়।

আসাদের হত্যাকান্ডে ক্ষুব্ধ ছাত্ররা আসাদের রক্তাক্ত সার্ট হাতে তাৎক্ষণিক মিছিলে।
আসাদের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তিনদিনব্যাপী শোক ঘোষণা করে। এ ছাড়া কমিটি ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। ২৪ তারিখে হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গভর্নর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সর্বস্তরের মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার নামে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথে। সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান।
যার ফলে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সরকার দু’মাসের জন্য ১৪৪ ধারা আইনপ্রয়োগ স্থগিত রাখতে বাধ্য হন। আসাদ হত্যার এক মাস মধ্যেই আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন আইয়ুব খান।
পতন ঘটে আইয়ুব খানের। এরপরই স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দে্ন।
সত্তর সালের সেই অভূতপূর্ব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া ক্ষমতা না ছাড়ার জন্য নানা টালবাহানা শুরু করেন। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার ধারাবাহিকতায় একাত্তর সালে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পাক সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাক সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হবার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান এ ভূখন্ডের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার অপ্রতিরোধ্য জনতা ছিনিয়ে আনে বিজয় ১৬ ডিসেম্বরে।
আসাদের মৃত্যু তাই ইতিহাসের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আসাদের মৃত্যু গোটা জাতিকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছিল।
এই হত্যার প্রতিবাদে আইয়ুব বিরোধী ক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা মহম্মদপুরের তৎকালীন ”আইউব গেট” -এর শ্বেত পাথরের নাম ফলকটিতে আলকাতরা লাগিয়ে দেয় এবং “আসাদ গেট” নামাঙ্কিত করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সী গেটের পাশে আসাদের গুলিবিদ্ধ হবার স্থানটিতে পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
কবি শামসুর রাহমান লিখলেন কবিতা –
“আসাদের শার্ট”
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
আসাদ কেবল একজন ছাত্র সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ঐকান্তিক কৃষক সংগঠকও। নরসিংদীর শিবপুর-হাতিরদিয়া-মনোহরদি ও পাশ্ববর্তী এলাকাসমূহে তিনি একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। অত্যন্ত সংগ্রামী মানসিকতার অধিকারী আসাদ ‘জনগণতন্ত্র’কে মনে করতেন মুক্তির মন্ত্র। আসাদ মনে করতেন সাধারণ নিপীড়িত অসহায় মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন করতে হলে সুবিশাল জনশক্তিকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সেজন্য দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত বলে তিনি দাবী করতেন। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে শিবপুরে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
শুধু ছাত্র ও কৃষক সংগঠনে অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। তিনি উন্নত রাজনৈতিকে আদর্শ বহনকারী একটি পার্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনীতি পরিচালনার জন্য সংক্ষিপ্তভাবে Study Circle গঠন করার কথা লেখা আছে। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটির একজন অগ্রণী সংগঠক, যারা ১৯৬৮ সাল থেকেই সার্বভৌম ও শ্রেণীশোষণমুক্ত একটি দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন।
১৯৪২ সালের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে নিজ বাড়ীর বকুলতলায় চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।
বাঙালীয়ানা/এসএল
অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলো, পড়ুন
ডিসেম্বর ১৯৭১
নভেম্বর ১৯৭১
অক্টোবর ১৯৭১
সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আগস্ট ১৯৭১
জুলাই ১৯৭১
জুন ১৯৭১
মে ১৯৭১
এপ্রিল ১৯৭১
মার্চ ১৯৭১