বাংলা সাহিত্য ও গান, বাঙালীর স্বদেশপ্রেম যাঁদের প্রেরণায় ঋদ্ধ ও উজ্জীবিত হয়েছে তাঁদের অন্যতম কবি গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেন৷
১৮৬৫-এর ২৬ জুলাই রজনীকান্তের জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার তদানীন্তন সিরাজগঞ্জ (বর্তমানে জেলা) মহকুমার ভাঙাবাড়ি গ্রামে। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন, মা মনমোহিনী দেবী। রজনীকান্তের বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন ঢাকার মুন্সেফ পরে বরিশালের সাব-জজ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য পরিচয় হল তিনিও কবি ছিলেন। গুরুপ্রসাদ সেন একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ফলে পিতার সাহচর্য্যেই শৈশবে সঙ্গীত অনুশীলন করার সুযোগ ঘটে তাঁর। রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে কিশোর রজনীকান্তের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই আলাপ পর্যালোচনা তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি রজনীকান্তের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ছোটবেলায় একটি বাঁশিতেই চলত তাঁর সঙ্গীতের অনুশীলন।
এফএ পাশ করে রজনীকান্ত কলকাতায় সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। বিএ পাশ করেছিলেন ১৮৯১তে । এরপরে বিএল পাশ করে রাজশাহী শহরে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। তবে তাতে তিনি মনোনিবেশ করতে পারেননি। একদিকে চলতে থাকে ওকালতি অন্যদিকে গান ও কবিতা রচনা। তাঁর নিজের লেখাতেই পাওয়া যায়, ‘আমি আইন ব্যবসায়ী কিন্তু ব্যবসা করিতে পারি নাই।’ এক সময় প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়ায় জীবনটা ছিল তাঁর কাছে একটা বড় পরীক্ষা। আর সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
চোদ্দ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বন্ধু তারকেশ্বর চক্রবর্তীর। তারকেশ্বর ভাল গান গাইতেন আর সেই কারণেই যেন গানের প্রতি রজনীকান্তের অনুরাগ বেড়ে গিয়েছিল। রজনীকান্তের কন্যা শান্তিলতা দেবীর একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘এক অর্থে এই তারকেশ্বর চক্রবর্তীই হলেন রজনীকান্তের সঙ্গীতগুরু— যদিও ঠিক নিয়ম মেনে প্রথাগত সঙ্গীতাভ্যাস রজনীকান্ত করেননি।’ তবে জানা যায় তিনি নিজেও সুগায়ক ছিলেন। রাজশাহীতে বিভিন্ন সাহিত্যসভা, মজলিশ এবং অনুষ্ঠানে তিনি স্বরচিত গান গেয়ে আসর মাত করে দিতেন। হিন্দু হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করার সময় তিনি স্বরচিত গান খঞ্জনী বাজিয়ে গেয়ে পথ পরিক্রমা করতেন।
প্রমথনাথ বিশী তাঁকে ‘উৎসবরাজ’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯০২-এ তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাণী’ প্রকাশিত হয়। শোনা যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েও সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ভয়ে তিনি এই বইটি ছাপতে চাননি। পরে জলধর সেনের কলকাতার বাড়িতে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর গান শুনে সেগুলি গ্রন্থাকারে ছাপাতে বলেন। এরপরে ১৯০৫-এ তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কল্যাণী’ প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনটি এবং মৃত্যুর পরে পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।
তাঁর মেয়ে শান্তিলতা দেবী একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। যদিও এটি সম্পূর্ণ সংখ্যা নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। রজনীকান্তের গানগুলিকে মূলত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল ভক্তিমূলক, দেশাত্মবোধক, হাস্যরসের গান এবং জীবনের গান। ভক্তিরসাত্মক গানে রজনীকান্ত ঈশ্বরভক্তির কাছে কি ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তা ফুটে উঠেছে সরল সৌন্দর্যে। তেমনই হাস্যরসের গান রজনীকান্তের সঙ্গীতবৈচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
রজনীকান্ত স্বদেশী আন্দোলনের যুগের কবি। ১৯০৫-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যাঁরা সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রজনীকান্ত। সেই সময় দিকে দিকে রব উঠেছিল বিদেশী বস্ত্র বর্জন করার। বিভিন্ন দেশীয় কাপড়ের কলগুলি মোটা কাপড় তৈরি করতে লাগল। সেই সময় রজনীকান্ত গেয়ে উঠেছিলেন সেই বিখ্যাত গানটি ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই, দীন দুখিনী মা যে মোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।’ চট্জলদি গান বাঁধতে তাঁর কোনও জুড়ি ছিল না।
রজনীকান্তের এই গান বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে এই গানটি রচনার নেপথ্যে একটি কাহিনী রয়েছে। রজনীকান্তের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র। রজনীকান্ত কলকাতায় এসে তখন একটি মেসে থাকতেন, সেখানে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতেন অক্ষয়কুমার। একবার সেখানেই সকলে মিলে গান করার জন্য অনুরোধ করলেন রজনীকান্তকে। তখন তিনি নতুন রচিত ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি ধরলেন। সবেমাত্র অন্তরার অংশটুকু রচনা করে গেয়েছেন, অক্ষয়কুমার এমন সময় রজনীকান্তকে সোজা নিয়ে এলেন বউবাজারে বসুমতীর অফিসে তৎকালীন সম্পাদক জলধর সেনের দফতরে। বললেন সেই গানের কথা। অসমাপ্ত সেই গানটি পড়ে জলধর বললেন বাকিটুকু রচনা করে দিতে। সেখানে বসেই রজনীকান্ত গানের বাকি অংশটুকু রচনা করেছিলেন।
রজনীকান্ত কখনই সরকার মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তেমনই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হননি। আবার শুধু স্বদেশী গান লিখে কিংবা গেয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছিলেন গ্রামে গঞ্জে। সেখানে সাধারণ মানুষকে স্বদেশী আন্দোলনের তৎপর্য বুঝিয়েছিলেন।
স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধীতায় তাঁর গান ছিল প্রেরণার উৎস। তাঁর উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো;
১। নমো নমো নমো জননি বঙ্গ
২। আমরা নেহাত্ গরীব আমরা নেহাত্ ছোট
৩। তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে
৪। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
৫। ভারত কাব্যনিকুঞ্জে ইত্যাদি
এখনও বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীদের কন্ঠে তার গানগুলো গীত হয়।
জীবদ্দশায় তার তিনটি বই প্রকাশ হয়; বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫) ও অমৃত (১৯১০)। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়; অভয়া (১৯১০), আনন্দময়ী (১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩) ও শেষদান (১৯১৬)। এর মধ্যে বাণী ও কল্যাণী গানের সঙ্কলন।
জীবনের মধ্যভাগে আক্রান্ত হয়েছিলেন গলার ক্যানসারে। কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেই তাঁর শেষ ঠিকানা ছিল ১২ নম্বর কটেজ। রোগশয্যায় তাঁর পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্য পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে পরে লিখেছিলেন, ‘মানবতার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি … … শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই …।’ ১৯১০-এর ১৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৫ বছর বয়সে রজনীকান্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
লেখক পরিচিতি:
সুপ্রিয়া রায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, কলকাতার মডার্ন হাই স্কুল।