রাজু, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে

Comments

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমরা কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং নিয়ে কথা বলছিলাম টিএসসির সবুজ চত্বরে। সে সময় আমরা প্রতি বছর ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিয়মনীতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করতে ‘প্রজ্ঞা কোচিং সেন্টার’ নামে একটি একটি স্বল্পকালীন ভর্তি-কোচিং চালু করেছিলাম। এর পুরোভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন সংসদের তৎকালীন সমাজকল্যাণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মঈন হোসেন রাজু। কোচিং সেন্টারটির নামও ছিল রাজুর দেওয়া।

এর উদ্দেশ্য, যেসব মেধাবী ছাত্রছাত্রী টাকার অভাবে কোচিংয়ের সুযোগ পায় না, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিয়ম-নীতি, প্রশ্নপত্রের ধরন ইত্যাদি বিষয়েও তাদের তেমন কোনো ধারণা থাকে না, সেসব বিষয়ে তাদের ধারণা দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে সহজভাবে প্রত্যেকটি বিষয় সহজ ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা।

আমরা ভর্তি পরীক্ষার ঠিক আগে আগে এই কোচিংয়ের আয়োজন করতাম। এতে করে ঢাকার বাইরে থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী যাদের পক্ষে দীর্ঘদিন ঢাকায় থেকে কোচিং করা সম্ভব হত না তারা বেশ উপকৃত হত। রাজুর আকাঙ্ক্ষা ছিল ছাত্রদের উপকার করা, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ভূমিকা পালন করা। তাই তো গতানুগতিক মিছিল-মিটিংয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের সরাসরি কল্যাণ হয় এমন সব উদ্যোগের দিকেই রাজুর ঝোঁক ছিল বেশি।

যাহোক, সেদিন পড়ন্ত বিকেলে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অস্ত্রধারীরা টিএসসিতে বন্দুকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। আমরা শত শত সাধারণ ছাত্রছাত্রী অস্ত্রধারী গুণ্ডাদের সন্ত্রাসের কাছে টিএসসিতে জিম্মি হয়ে পড়ি। অথচ কী আশ্চর্য, সে সময় ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল স্রেফ দর্শকের!

পুলিশের এই ভূমিকার প্রতিবাদে প্রথম সোচ্চার হয় মঈন হোসেন রাজু। সে পুলিশকে অস্ত্রবাজদের গ্রেফতার করার আহবান জানায়। ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে পুলিশ ভূমিকা পালন করে বটে, কিন্তু তা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের পক্ষে। তারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্রদলের গুণ্ডাদের প্রটেকশন দিয়ে বিপরীত দিকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। তা ক্রমেই বিস্তৃত হয় পুরো টিএসসি, যেখানে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আটকা পড়ে।

এর প্রতিবাদে রাজুর নেতৃত্বে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল বের করি। প্রথম দিকে সেই মিছিলে রাজু, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, সুনীল দাস, ভাস্কর চন্দ, সেলিম রেজা নিউটন, কাজী এনামুল হক ইনু, আবদুর রহিম হারমাছি, কামাল পাশা, পলাশ রাউথ, গোপাল সাহা, ধনঞ্জয় মল্লিকসহ আমরা কয়েকজন মাত্র ছিলাম। এরপর মিছিলে আরও শরিক হন মোস্তাক আলম টুলু, খায়রুল ইসলাম চৌধুরী রূপমসহ ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্য’ ভুক্ত বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। টিএসসির সড়কদ্বীপ প্রদক্ষিণ করার সময় ডাসের (Dhaka University Snacks) সামনে ‘অস্ত্র শিক্ষা একসাথে চলবে না’, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ এক হও’, ‘সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই, নিরাপদে পড়তে চাই’, ‘হল থেকে দল থেকে সন্ত্রাসীদের বহিষ্কার কর’ এ স্লোগান যখন উচ্চারণ করছিলাম, তখন হাকিম চত্বরের সামনে থেকে ছাত্রদলের চিহ্নিত গুণ্ডারা সরাসরি মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এর একটি গুলি কপালে লাগে মিছিলের সামনে থাকা রাজুর।

স্লোগান মুখে নিয়েই সে লুটিয়ে পড়ে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে সড়ক দ্বীপের পাশের রাস্তায়। আমরা হতবিহ্বল হয়ে থমকে যাই। মিছির ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে দ্বিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। তখন সময় সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা। রাজুর রক্তাপ্লুত দেহ নিয়ে আমরা রওনা হই ঢাকা মেডিকেল কলেজে, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে। রাজুর দেহ থেকে অবিরাম টপ টপ করে রক্ত ঝরতে থাকে। তার শার্ট রক্তে ভিজে যায়। রক্তাক্ত রাজুকে এক ঝলক দেখেই কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, রক্ত চাই, অনেক রক্ত। মুহূর্তে রাজুর সহযোদ্ধারা দল বেঁধে রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়ার শামিল হন।

সব প্রক্রিয়া দ্রুত এগোতে থাকে। সেই সঙ্গে এগোয় সময়। সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা, শঙ্কা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীতে ভরে যায়। সবারই দুঃসহ প্রতীক্ষা।

কিন্তু রাজুকে আর রক্ত দিতে হয়নি। সবার সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে, কাউকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে মঈন হোসেন রাজু চিরতরে চলে যায়।

এরপর থেকে ১৩ মার্চ এলে খুব বিপন্ন বোধ করি। নিজেকে কিছুটা অপরাধী মনে হয়। কারণ রাজুকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। পারিনি রাজুর স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠিত করতে। এমনকি রাজুর হত্যাকারীদের বিচার করতেও আমরা পারিনি। আমরা যারা রাজুর সহযোদ্ধা ছিলাম, তারা প্রত্যেকেই আজ ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। সমাজ বদলের স্বপ্ন হয়তো আমরা এখনও দেখি, কিন্তু যৌবনের সেই উদ্দাম উচ্ছ্বাস নিয়ে আমরা এখন আর কেউ-ই রাজপথ কাঁপানো মিছিলে পথ চলি না! ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চের সেই মিছিলের রাজুর সহযোদ্ধারা আজ যেন হতাশার চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে!

যে সংগঠনের পতাকাতলে একসময় জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছিলাম, আজ তা কেবলই বিবর্ণ স্মৃতি! বার বার মনে হয়, তবে কী আমরা পরাজিত? আপোষকামী? প্রথাগত জীবনের দৈনন্দিন দাবির কাছে আত্মসমর্পণকারী, সুবিধাবাদী? ক্ষণিকের আবেগে পরিচালিত চেতনারহিত হুজুগে?

কেন এমন হলো? কেন ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার আগেই আমাদের সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেল? কেন কখনও সংবাদকর্মী কখনও এনজিওকর্মী হিসেবে নিজের আদর্শ ও চেতনাবিরোধী অবস্থানের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আপোষ করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে? অথচ এমন তো কথা ছিল না! জনকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ আমি কেন এমন বদলে গেলাম? কোনো লোভ-মোহ-অসাধুতাকে জীবনে কখনও প্রশ্রয় দিইনি! তাহলে কেন এই অর্থহীন ক্লীবত্বকেই বেছে নিতে হলো? কেন ‘বাস্তবতা’ নামে একটা নিরেট পাথরের নিচে সব শক্তি, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে চাপা দিতে হলো?

অথচ জীবনে কিসের অভাব ছিল? শৌর্য-বীর্য-তেজ-স্বপ্ন? আমারও তো কথা ছিল তাজুল হবার। সমাজবিপ্লবের কারিগর হিসেবে মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিযানে অংশ নেবার! আমারও তো কথা ছিল মনিসিংহ, কমরেড ফরহাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য জীবন উৎসর্গ করবার! কিন্তু তা হলো না কেন? কেন আমার আদর্শের সংগঠন আমাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হলো? আমিই বা কেন সংগঠনের আদর্শের পতাকাকে এগিয়ে নিতে পারলাম না? কৈশোরে যাদেরকে অনুসরণীয় মনে করে যৌবনকে পরিচালিত করেছি বিপ্লবের সোপান অভিমুখে, সেই স্বপ্নের নায়কেরা কেন পড়ন্ত-যৌবনে আমার কাছে তুচ্ছ কিংবা দিশাহীন পথের পথিক হিসেবে আবির্ভূত হলো? একি হিসেবের ভুল? বোধের ঘাটতি? বিবেচনার অভাব? না অন্যকিছু?

এখনও দেখি, একই মিছিলের সঙ্গী কেউ কেউ নিজেকে সাচ্চা ‘বিপ্লবী’ মনে করছে, আরেকজনকে ‘প্রতিবিপ্লবী’ আখ্যায়িত করে কাছা টেনে ধরছে! এই কাছা টানাটানির রাজনীতি আর কত? কবে আমরা সমমনা সবাই মিলে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সমাজটাকে বদলে দেওয়ার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ব? কবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না!

আজ কেবলই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো করে বলতে ইচ্ছে হয়-

রাজু, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় …
আমি হেরে যাইনি আমি মেনে নিইনি
আমি প্রস্তুত হচ্ছি
সব কিছুর প্রতিশোধ নেব আমার নিজস্ব নিয়মে….!

লেখক:
Chiroranjan Sarker
চিররঞ্জন সরকার, শহীদ রাজুর সহযোদ্ধা, প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট