‘বরাখহনিয়া’ আবুল হোসেনের কাহিনী অন্যরকম। তাঁর জমি ছিল ২ বিঘা বেকী নদীর পাড়ে। বাংলা প্রবাদ আছে “যাদের নদীর পাড়ে বাস, তাদের ভাবনা বারোমাস”। আর আসামে এদের বলা হয় ‘বরাখহনিয়া।’ যন্ত্রণা তাঁদের জীবনের অঙ্গ। সেই আবুল হোসেনের জমি গেছে নদীর কবলে। আর তাঁর ‘দেশ’ কেড়েছে এনআরসি! আবুল হোসেনের বললেন, ‘‘কিন্তু মজা কী জানেন? আমি এখনও খাজনা দিই। সেই জমির, যার কোনও অস্তিত্বই নাই। সরকার হাত পেতে খাজনাও নেয়। সেই জমির দলিল দিয়েছিলাম আবেদনের সঙ্গে। ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের বাস এখানে। এখন জানলাম আমি দেশের লোকই না। আমার ছেলেরাও কেউ না। কারও নাম ওঠেনি। কারণ তাঁরা আমার সন্তান। আর আমি হলাম গিয়ে ‘ডি’।” আবুল হোসেনের বাড়ির ৩ ছেলে, ২ মেয়ে, স্ত্রী, ২ পুত্রবধূ, কারও নাম ওঠেনি এনআরসি-তে।
‘রাষ্ট্রহীন’ হয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত বায়ুসেনা আধিকারিক ছবীন্দ্র শর্মা আর স্ত্রী। এনআরসি’তে এবারও জায়গা হয়নি কারগিলে জান কবুল লড়াই চালিয়ে আসা সেনা জওয়ান সানাউল্লার। চূড়ান্ত তালিকায় নাম নেই তাঁর পরিবারের কারোরই। শোনিতপুরের ছবীন্দ্র শর্মার বাবা তেজপ্রসাদ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। ছোট থেকেই ছেলেকেও উৎসাহ দিয়ে গেছেন দেশসেবায়। মোদীর শাসনে এবার সেই স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার হয়ে পড়ল ‘রাষ্ট্রহীন’।
এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ল কাছাড় জেলার সিআরপিএফ জওয়ান সুমন দাস। দিগরখালের সুমন এখন ‘অবরুদ্ধ’ কাশ্মীরে ভারত রক্ষায় ডিউটি করছেন। রবিবার সকালেই কাশ্মীরের আধা সেনাক্যাম্প থেকে ফোনে বাড়িতে কথা বলেছেন। বাবা সমর দাস জানালেন, নাম নেই শুনে বেশ কিছুটা ভেঙে পড়েছেন সুমন। ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে বাড়িতে আসতে চাইছেন। ছুটির অ্যাপ্লাই করলেও ছুটি মিলবে কিনা কে জানে? আলাদা করে বাদ পড়াদের কোনও তালিকা প্রকাশ করেনি এনআরসি কর্তৃপক্ষ।
করিমগঞ্জেই এশিয়ার বৃহত্তম বিল শনবিল। বিলের পাশে হাজার কুড়ি মৎস্যজীবী মানুষের বাস। দেশভাগের সময় নোয়াখালী থেকে ওদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসে বসতি গড়েছেন। আবেদনপত্রে চৌষট্টির শরণার্থী প্রমাণপত্র জমা দেন। সঙ্গে ’৬৬-র ভোটার তালিকাও দেন। এনআরসি’র খসড়ায় বেশিরভাগেরই নাম আসেনি।
ভোটের সময় বিজেপি’র লোকজন এসে বলেছিল, মোদী ফিরলে কারোর নাম বাদ যাবে না। তা শুনেই শনবিলের মানুষ সমর্থন উজাড় করে দিয়েছিল গেরুয়ার পক্ষে। আর শনিবার সেই শনবিল দেখল, বাদ গেছে ষাট থেকে পয়ষট্টি শতাংশের নামই। সুদীপ দাস, কৃষ্ণ দাস, জয়গোপাল দাস, রথীন্দ্র দাস, হরিকান্ত দাস, বীরেন্দ্র দাস ও হীরালাল দাসের পরিবারের কারোর নাম নেই। এখন ওঁরা মোদীকেই দুষছেন, ‘‘বিজেপি-কে বিশ্বাস করেই আজ আমরা রাষ্ট্রহীন’’।
করিমগঞ্জের তফসিলি অংশের বড় অংশেরই নাম তালিকায় নেই। জেলা সদরের চরবাজারের মীনা নমশূদ্র ও তার পরিবারের সাতজনের নাম নেই। শ্যামাপ্রসাদ রোডের সত্যজিৎ নমশূদ্র ও তার গোটা পরিবারের নাম নেই। শিলচর শহরের সোনাই রোডের ডিআইসিসি সেবাকেন্দ্রে এনআরসির আবেদন জমা দেন ২,৪২৭ জন। ১০০৩ জনের নামই বাদ পড়েছে। শিলচরের তারাপুর সেবাকেন্দ্রে আবেদন করেন ৩১৬৮ জন। নাম বাদ পড়েছে ১৮৪৬ জনের। নর্মাল ট্রেনিং সেন্টার সেবাকেন্দ্রে আবেদন জমা পড়ে ১৬৮৯ টি। এরমধ্যে ৮০০ জনেরই নাম বাদ পড়েছে।
দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের পাঁচ জনের নাম নেই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আনোয়ারা তাইমুরের নাম বাদ। কাছাড় জেলার লেবারপুতা গ্রামে একটি পরিবারে আটজন সদস্য। এরমধ্যে বাড়ির কর্তা ইশাক আলি ’৫২ সাল থেকে ভোট দিচ্ছেন। তাঁর পরিবারের ছয় বছরের নাতনি আজমিনা বেগম দেশী হলেও বৃদ্ধ ইশাক সহ বাকি সকলেই বিদেশী।
মানুষকে ‘রাষ্ট্রহীন’ করার ষড়যন্ত্র এবার বেআব্রু হয়েছে। মানুষের উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। নাম থাকবে না এ আতঙ্কে শনিবার, ৩১ আগষ্ট, ২০১৯, কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক মহিলা। নাম নেই, এমন নিষ্ঠুর সত্য জানার ধাক্কা আর নিতে পারেননি চুয়াত্তর বছরের হৃদযন্ত্র। করিমগঞ্জের খলা গ্রামের ফয়জুর রহমান শনিবারই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল। রবিবার ভোরে মারা যান। তালিকায় নাম নেই ফয়জুরের স্ত্রী, দুই ছেলে আর তিন মেয়েরও। জমির দলিল, ভোটার তালিকা, আবেদনে সবই জুড়ে দিয়েছিলেন। নাম আছে শুধু বিবাহিত দুই মেয়ের। এদিন হাসপাতালে ‘রাষ্ট্রহীন’ ফয়জুরের ‘রাষ্ট্রহীন’ স্ত্রী রুশনা ফেটে পড়লেন ক্ষোভে, ‘‘ওঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী বিজেপি।’’ আর ভোটের আগে যে দিলীপ পাল গলা চড়িয়ে বলতেন, ‘মোদী থাকতে হিন্দুদের নাগরিকত্ব হারানোর ভয় নেই।’ শনিবার ঘুম থেকে উঠে শিলচরের সেই বিজেপি বিধায়ক জানতে পারেন, ছাঁটা গেছে তাঁর স্ত্রী অর্চনা পালের নামও। এখন তাই বিধায়কের মুখে কুলুপ।
বাঙালীয়ানা/এসএল