।। স্বাতী চক্রবর্তী ।।
বাংলা কথাসাহিত্যের রবীন্দ্র পরবর্তী তিন মহারথী, তিন ‘বাঁড়ুজ্যের’ একজন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তিনজনের বেলাতেই আমরা দেখি এরা শুধু উপন্যাস নয় ছোটগল্প রচনাতেও সিদ্ধহস্ত। তিনজনেই লেখার উপাদান সংগ্রহ করেছেন গ্রামীণ জীবন থেকে, অথবা শহুরে নিম্নবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন থেকে। এরমধ্যে তারাশঙ্করের সাহিত্যকর্মের পরিমাণ সবচেয়ে বিপুল। কম করে ২০০টি গ্রন্থের লেখক তিনি!
১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদারবংশে তাঁর জন্ম। বাল্যকালে পিতৃহীন বালক মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন। পিসিমা ছিলেন জাঁদরেল জমিদারনী, পিসিমা ও মায়ের জটিল তিক্তমধুর সম্পর্ক তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছে। আর ছোটবেলা থেকে মনে গভীর ছাপ ফেলেছে রাঢ়বঙ্গ, তার উচ্চাবচ ভূপ্রকৃতি এবং সেই মাটির কোল ঘেঁষা মানুষের বন্ধুর জীবনযাত্রা, যা তিনি দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। ১৯১৬ সালে গ্রামের যাদবলাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আইএ তে ভর্তি হন। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন। ফলে তাঁর শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। পরে তিনি পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন ১৯৩০ সালে। কারামুক্তির পর কিছুকাল গ্রামে কাটিয়ে ১৯৪০ সালে তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতার বাসিন্দা হন এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া কালিকলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এই প্রথম রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন সাধারণ পেশাজীবী মানুষ, বেদে, পটুয়া, মালাকার, লাঠিয়াল, মাঝি, চৌকিদার, বাগদী, বোষ্টম, ডোম, লোকশিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব ভাষা ভঙ্গি নিয়ে সম্পূর্ণ সজীব মূর্তি ধরে উঠে এল, স্থায়ী চিহ্ন রেখে গেল বাংলা সাহিত্যে। এই মানুষেরা নিতান্তই রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদের প্রেম, লোভ, হিংসা, ক্রূরতা, কাম, ক্রোধ সব মিলিয়ে দোষে গুণে মানুষ। মানবচরিত্রের নানা জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য তাঁর উপন্যাসে জীবন্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর নারীচরিত্ররাও এর ব্যতিক্রম নয়।
তিনি নিজে জমিদারবংশের সন্তান হয়ে কাছ থেকে দেখেছেন কীভাবে জমিদারি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়; পাশাপাশি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং দিকে দিকে কল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তখন একদিকে চলছিল গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহরজীবনের বিকাশ। সমাজের এ নীরব পরিবর্তন তাঁর রচনায় নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। একদিকে স্বাধীনতা আন্দোলন, অন্যদিকে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় এ সবের ছবিই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে।
তাঁর বিখ্যাত গণদেবতা ট্রিলজি বা হাঁসুলিবাঁকের উপকথায় আমরা পাই শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত প্লটের জটিলতা ও বিশালতা। যেখানে একজন নায়ক নয়, বরং ব্যাপক জন-চরিত্র, একটি বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবন চিত্রকে ফুটিয়ে তোলা এর অন্যতম লক্ষ্য। অথচ তাঁর রচনায় ক্ষুদ্র-বৃহতের প্রতি সমদৃষ্টি রেখেছেন তিনি। এই উপন্যাসগুলিতে বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সংশ্লেষে গড়ে উঠেছে যে প্রবহমানতা যা বর্তমানকে ভবিষ্যৎগামী করেছে।
রাজনীতি থেকে তিনি কখনই একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তারাশঙ্কর ১৯৪২-এর বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন এবং বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংগঠন যখন তৈরি হয় তাঁর প্রথম সভাপতি হন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায় তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন। তাঁর দুই পুরুষ, কালিন্দী, আরোগ্য নিকেতন, গণদেবতা, সপ্তপদী, হার মানা হার, হাঁসুলীবাঁকের উপকথা উপন্যাসগুলি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৪৭) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৬) লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৫৫), ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
বাঙালীয়ানা/এসসি/জেএইচ