রোকসানা শাহ্‌নাজের কবিতা

Comments

কথোপকথন ১

অনিকেত: কাশ ফুলের পোড়া গন্ধ টের পাচ্ছ দিঠি?

দিঠি: গতকাল এক বকুলগন্ধী বিকেলের খামে, নীল পদ্মের পাতায়; তোমায় পাঠিয়েছি চিঠি—

অনিকেত: বৈরী বাতাস জানে,
কতটা চৈতালী হাওয়া এলে পুড়ে যায় বন,
কতটা নগ্ন হয় মুগ্ধ জীবন! 

দিঠি: আবার পোড়া গন্ধ কেন অনিকেত!
এখনও শোননি তুমি?
আমার বুকের প’রে হেমন্ত বাতাস–
সমৃদ্ধির সোনালি উদ্ভাস?

অনিকেত: পেছনে দৌড়ে আসে দুরন্ত শৈশব,
ঐখানে ফেলে গেছি অচেনা ভুবন–
ঐখানে ফেলে গেছি কিছুটা জীবন! 

দিঠি: জীবন কী শঙ্খিনী নদী?
নীল পদ্মের পাতায় কবিতার নীল–
উন্মুক্ত আকাশ খোঁজে ভুল শঙ্খচিল?

অনিকেত: ইন্দ্র মেঘে ডুবেছিল তমস্বিনী তট–
আর্দ্র চৈতন্য জেনেছিলো,
কাশবনেও জন্ম নেয় অনিন্দ্য গোলাপ এক! 

দিঠি: মুদে থাক চোখ, মুদে থাক চোখ
মন বলে, শুধু ভালোবাসা হোক!
                –ভালোবাসা হোক!!

কথোপকথন ২

অনিকেত: ল্যান্ডস্কেপ বিকেলের আলিঙ্গনে আনত তুমি
তোমার শাড়ির ভাঁজে বিভা ছড়ানো 
বিপ্রতীপ ক্যানভাস,
আঁচলে বেঁধেছ জাফরানি আকাশ–

দিঠি: সে তো তোমারই জন্যে অনিকেত!
রৌদ্রের পেছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত তুমি– 
উত্তাপে উত্তাপে উৎসব তোমার
কখনও বসবে এসো, অপরাজিতার আসরে।

অনিকেত: সবুজ হেঁটে চলে যায়–
হলুদ হেসে ওঠে করুণ কটাক্ষে! 
বাস্প জমে জমে কখন বজ্র হয় 
দেখেছ তুমি?

দিঠি: তোমার কণ্ঠে কেবলই বজ্রের হুংকার! 
জাননা কী? চকিত আলোর নিশানা খোঁজে অমিত আঁধার? 
ভৃত্য নীতি আগেও ছিলো, আজও তেমনি আছে–
তুমি চাইলেই বদলাতে পারবে না বৃত্ত।

অনিকেত: মিথ্যের নির্লজ্জ আলিঙ্গনের ভয়–  
সত্য সহজেই মুখ লুকায়!

কথোপকথন ৩

অনিকেত: বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে দিঠি,
পত্র-পল্লবে তবুও কী ভীষণ খরা
পারবে কী ধুয়ে দিতে 
সামাজিক জরা?

দিঠি: তুমি চাইলেই, বৃষ্টির পাখনা জুড়ে মৃত নগরী 
তুমি চাইলেই, বিমর্ষ শালিকের ডানায় কালপুরুষ 
অজন্তা-ইলোরায় শতাব্দীর মৌন অন্ধকার 
তুমি চাইলেই–

অনিকেত: নগ্ন নিশিথে দুঃস্বপ্ন আলিঙ্গন।
দিঠি: স্বপ্নকে একবার আলিঙ্গন করেই দেখ অনিকেত! 

অনিকেত: শব্দহীন স্রোতের বুকে কখনও কান পেতেছ দিঠি?
ঢেউ এর উন্মত্ততা নেই, জলতরঙ্গ নেই
শুধু বয়ে চলা বিস্তার–
স্বপ্নকে দিয়েছি বিদায়।

কথোপকথন ৪

অনিকেত: নির্ঘুম কবিতার কাছে জানতে চেয়েছি ঠিকানা আমার,
সে বলে দিয়েছে তোমার নাম। 

দিঠি: গোটা রবীন্দ্র সরোবর ঘুরে 
চারটে মাত্র লালকমল পেয়েছি। 
তোমার ঠিকানায় চলে এসো– 
বরমাল্য পরিয়ে দেব কাল।

অনিকেত: অরণ্য অভিযানে যাবে দিঠি? 

দিঠি: অরণ্য অভিযান!

অনিকেত: ধরে নাও অর্বাচীন বিলাস।
কাঁচের কার্ণিশে প্রতিদিন কুয়াশার নিঃশ্বাস,
ক্লান্ত আমি–ক্ষণকাল নির্জনতায় নিবাস–
অরণ্যের আঙুল ছুঁয়ে পাহাড়ি ঢল, 
তোমার চোখের তারায় অরুন্ধতী-স্বাতী-কালপুরুষ।
সবুজ মখমলি চাদরে কিংশুকের উন্মত্ত উল্লাস– 

দিঠি: তুমি ভালোবাসার কথা বললেই 
আমার মাথার ভেতরে উল্কাপাত 
বুকের ভেতর গত শতাব্দীর সহস্র নিনাদ।  
আমার বড়ো ভয় হয় অনিকেত! 

অনিকেত: বেদনাহীন ভালোবাসা কে বেসেছে কবে?
জানো না কী–
তোমার পায়ের নূপুরে, লালকমলের পাপড়িতে,
অনিকেত নামের অদৃশ্য শৃঙ্খল! 
শৃঙ্খল খুলে দাও দিঠি। 
একদিন চলে যাব দূরে–
নীল আর নীলিমায় মিশে রব গহন আঁধারে। 

দিঠি: কত কথা বলে যায় নিন্দুকে–
আমি শুধু ভালোবাসা তুলে রাখি জং ধরা সিন্দুকে!

কথোপকথন ৫

অনিকেত: 
নিশ্চিন্ত সকাল চেও না দিঠি– 
দিতে পারি অতর্কিতে অগ্নুৎপাত 
অনিদ্রার অন্ধকার এনে দিতে পারি।

দিঠি: 

যখন আমি কুয়াশা ভোর, যখন আমি ঘাস
দিতে পার এনে অনিকেত উদ্ভাস!
ধরো, একটি হাওয়াই মিঠাই আকাশ মেঘনার চরে–
কিংবা আস্ত একটি বালুচরি বিকেল পানাম নগরে–
দিতে পারো লিখে দিঠির নামে,
বেনামী খামে।

অনিকেত:
অজন্তা ইলোরার পুরো প্রত্নতত্ত্ব ঘুরেও 
আমি পাইনি সে বিকেলের সন্ধান– 
জন্মান্ধ জীবনের বাঁকে বাঁকে 
লুকিয়ে থাকে কিছু বৃহন্নলা বিকেল,
নিকেল করা সকাল তাকে ছুটি দেয়
রোজনামচায়।  
মুণ্ডিত দিবাকর যামিনীকে অভিসম্পাত দিতে ভুলে যায়।
ভুলে যায় অস্তাচলের মধুর হাসি, 
ভুলে যায় চেনা পৃথিবীর অচেনা পালঙ্ক!

দিঠি:

কালের কলঙ্ক মুছে যাক মুছে যাক তার দাগ–
তোমার মুকুটে শোভিত হোক পলাশ পরাগ।

লেখক:
Roksana Shahnaj
রোকসানা শাহ্‌নাজ, কবি

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট