লড়াইয়ের সহযোদ্ধা স্মরণে । কামাল লোহানী

Comments

জীবন সংগ্রামের নিত্য লড়াইয়েই নয়, পাকিস্তানী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জাগ্রত গণআন্দোলনেও যিনি আমার সহযোদ্ধা ছিলেন, তিনিই আমার ৪৮ বছরের সহধর্মিনী শিক্ষাব্রতী শব্দসৈনিক দীপ্তি লোহানী। ওঁর আজ ৮৪তম জন্মদিন। কিন্তু আজ ২৪ শে নভেম্বর তাঁর প্রয়াণ দিবসও। তিনি ৪৮ বছরের দাম্পত্য জীবন ধারণের পর ২০০৭ সালে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে জনযুদ্ধে। আমি ওদের ফেলে রেখে চলে গেছি ত্রিপুরার আগরতলা হ’য়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। যোগ দিয়েছি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। কর্মী-সংগঠক হিসেবে দিবারাত্রি কাজ করে চলেছি। দায়িত্ব বার্তা বিভাগের। পুত্র ও জেষ্ঠ্য কন্যাকে নিয়ে শাশুড়ী বেলা মজিদ ছোট ছেলে সৈয়দ দীপেন মজিদকে নিয়ে চলে গেছেন কলকাতায়। দীপ্তি কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র স্কুল মতিঝিলে শিক্ষকতা করেন। তাই থেকে গেছেন ছোট শিশুকন্যাকে নিয়ে। এর মধ্যে বন্ধু জিয়া হায়দার দীপ্তিকে জানাল দেশের বৈরী পরিস্থিতির কথা আর আমাকে সরে যেতে বললো। দীপ্তি বুঝতে দিল না কাউকে যে আমি দেশত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে গেছি।

Dipti Lohani_Family

দীপ্তি লোহানী- কামাল লোহানী দম্পতি তিন সন্তানসহ।

মতিঝিল কলোনীর এফ টাইপের একটি ফ্লাটে তিনতলায় থাকেন দীপ্তি। একমাত্র ভরসা ওঁর দাদা সৈয়দ মনজুর হোসেন। এই ভদ্রলোক দুঃসাহসের সাথে আমাকে সীমান্ত পার করে ওপারে নিয়ে যাচ্ছেন আবার আসছেন অন্য কাউকে নিয়ে যাবার জন্যে।

মতিঝিল কলোনীর ঐ ফ্লাটটি কমলাপুর রেলস্টেশন আর ই পি আর টি সি-র কেন্দ্রীয় বাস ডিপোর খুবই কাছে। গেরিলা কমান্ডের ‘বিচ্ছু বাহিনী’ একদল এসে উপস্থিত দীপ্তির কাছে, আশ্রয়ের তাগিদে। দীপ্তি বিচ্ছুদের আগে থেকেই চিনতেন। তাই তাদের থাকতে দিতে কোন দ্বিধা করলেন না। খুলে দিলেন ঘরের দুয়ার। ফ্লাটটি গেরিলাযোদ্ধাদের ‘অস্ত্রাগার’-এ রূপান্তরিত হলো। দিনে ওরা সবাই ‘রেকি’ করতে বেরিয়ে যায় আর নির্ধারিত লক্ষ্যভেদ করতে সন্ধ্যের অন্ধকারে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ে। …হঠাৎ লোকজনের যাওয়া-আসা প্রতিবেশী সরকারী চাকুরে-কে উৎসাহিত করল পাকিস্তানীদের কৃপা পাবার আশায়। খবর দিলেন সামরিক বাহিনীর কাছে। স্কুলে যেতেই সেদিন প্রধান শিক্ষিকা রওশন সালেহা বললেন, “দীপ্তি তুমি এক্ষুনি চলে যাও কোথাও। তোমাকে খুঁজতে আর্মি স্কুলে এসেছিল।” তাঁর পরামর্শ শুনে দীপ্তি মগবাজারে এক বাড়ীতে গোপন আশ্রয়ে চলে গেল। আর বেশ ক’দিন আত্মগোপনের পর ছোট মেয়েকে নিয়ে দাদা মনজুর হোসেনের সাথে সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা পাড়ি জমালেন। আশ্রয় পেলেন ত্রিপুরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও বিধানসভায় বিরোধী দল প্রধান কমরেড নৃপেন চক্রবর্তীর বাসায়। ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবের সহযোগিতায় দীপ্তি পৌছলো কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধে আমরা একত্রিত হলাম। দীপ্তি শিক্ষিকা। বাংলা তাঁর প্রিয় ভাষা। তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে অংশগ্রহণ করে যে রাজনীতির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলা বেতারের সাথে যুক্ত হতে দ্বিধা করলেন না। কণ্ঠস্বর তাঁর সুমধুর ছিল। একসময়তো গান গাইতেনই। সংসার জীবনে ছাড়তে হয়েছিল গান। এবার সেই কণ্ঠকে দীপ্তি কাজে লাগালেন মুক্তিযুদ্ধে মনস্তাত্বিক প্রচার প্রচারণায়। লিখলেন কথিকা। উল্লেখযোগ্য কথিকা হলো ‘ঢাকায় স্বাধীনতার সূর্য’। প্রচারিত হলো ১৬ই ডিসেম্বর সকালের অধিবেশনে। তারপরে আমরাতো বিজয়ী হলাম পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনীর সকল দর্প চূর্ণ করে। তিনি লিখলেন “নেতাকে ফিরিয়ে আনবই”। কী অসাধারণ এক প্রত্যয় দেশপ্রেমের… মনে পড়ছে, বিজয় অর্জনে আর পাকিস্তানী সেনা হানাদারদের আত্মসমর্পনের পর ২২ শে ডিসেম্বর ১৯৭১ আমি সরকারের নির্দেশে ঢাকা চলে এলাম। একবারও ভাবলাম না। দীপ্তি সকলকে নিয়ে কলকাতার মতন জায়গায় কি করবেন। ফিরবেনই বা কি করে? হ্যাঁ, স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যদের সাথে একত্রে চলে এসেছিলেন মুক্ত স্বদেশে, কিছুদিন পরে।

Dipti Lohani_Mother & Siblings

মা এবং চার ভাইবোনের সঙ্গে দীপ্তি লোহানী।

জীবন ও সংগ্রামের বন্ধুটি ২৪ শে নভেম্বর ১৯৩৬-এ জন্মগ্রহণ করে প্রয়াত হলেন ৭২ বছর বয়সে ২০০৭ সালের এই জন্মদিনেই। কিন্তু পারিবারিক নিষেধাজ্ঞার বেড়া ডিঙিয়ে দীপ্তি কিন্তু রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে ১৯৫৩ সালেই। এ বছরই খুনী নূরুল আমিনের পাবনা সফরের প্রতিবাদে মেয়েদের স্কুলে ছাত্র ধর্মঘট সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বান্ধবী মনোয়ারাকে নিয়ে। নির্ভীক এই গোপন কর্মী কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলন, কলেজ সংসদ নির্বাচন আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। বিএ পাশ করে বিটি পড়তে যান ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। তারপর পাবনা, গাইবান্ধা হয়ে বৈরী পরিবেশ এড়িয়ে কলকাতা চলে যান। বর্ধমানের বাগনান আর কলকাতার ভবানীপুরে স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করলেও দেশে ফিরে ১৯৬০ সালে ঢাকা আসেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে সাথে নিয়ে। এ বছরই আমাদের বিয়ে হয় দীর্ঘদিনের প্রেম শেষে। আজ তিন সন্তানের মা-বাবা। ওরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত। মা-বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে সংস্কৃতি তাদেরও হাতিয়ার। সাগর, বন্যা ও উর্মি সবাই নিজ নিজ সংসারে। দীপ্তি ১৯৭০- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে  স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য এর আগে তিনি সমাজকল্যাণে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ফার্স্ট পার্টও পাশ করেন।

Dipti Lohani_Kamal Lohani02

দীপ্তি লোহানী ও কামাল লোহানী

বন্ধু তুমি চলে গেছ আজ বারোটি বছর। মনে তোমার প্রবল প্রত্যাশা  ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটাকে সমৃদ্ধ দেখতে। কিন্তু আজ বড় দুঃখ বন্ধু, দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বাষ্প সমাজে-রাষ্ট্রে ছড়িয়ে গেছে ব্যাপক হারে। ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগানে অর্জিত বাংলাদেশে আজ কেন এই দূর্বিপাক তার অনুসন্ধানে নেই কোন রাজনৈতিক আন্দোলন, অভ্যূত্থান। দেশে দুর্নীতি, বাণিজ্যে দুর্বৃত্তায়ন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শূন্যগর্ভ রাজনীতি, মৌলবাদী অপশক্তির আস্ফালন এতো চাওনি কোনদিন। তারপরও আমরা সকলে তোমাদের মতন আশাবাদী, দেশ পাল্টাবেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাম্প্রদায়িকতা প্রত্যাখ্যান করে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ সামনেই গড়ে উঠবে। তাই তোমার মত আমরাও জনগণের বিশ্বাসে আস্থাবান হতে চাই।

(২০.১১.২০১৯)

লেখক:
কামাল লোহানী
কামাল লোহানী, ভাষা সংগ্রামী, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.